হঠাৎ স্কুল বন্ধ ইয়ামিনদের। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে স্কুল বন্ধ হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ইয়ামিন। তবে ওদের গ্রামের অবস্থা আগের মত নেই, সে বিষয়টি অবশ্য টের পেয়েছে সে। কেমন একটা থমথমে ভাব সবখানে। সবাই কেমন ভীত-সন্ত্রস্ত। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হয় না। মানুষের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। খুঁজতে খুঁজতে একরাতে ভয়ের কারণ পেয়ে গেলো ইয়ামিন। ওর বাবাকে বলতে শুনলো- ‘দেশের অবস্থা ভালো না। বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার বেড়েই চলছে। শেখ সাহেব আর আইয়ুব খান বৈঠকে বসেছিলেন। কোন লাভ হয় নি। শেখ সাহেবের কোন কথাই শুনেননি আইয়ুব খান। তাই গত সাত তারিখে শেখ সাহেব যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। সবাইকে আমরণ সংগ্রাম করতে বলেছেন। যার যা আছে তা দিয়েই লড়াই করতে বলেছেন। কারণ আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।’ দেশের কথা শেষ করে বললেন- ইয়ামিনকে বাইরে যেতে দিও না। কখন কী হয়, তাতো বলা যায় না। পড়ার ঘরে বসে সবই শুনলো ইয়ামিন।
২.
ষোলবছর বয়স ইয়ামিনের। ক্লাস নাইনে পড়ে। ভালো ছাত্র বলে পাড়ায় সুনাম আছে। সেই সুবাদে বন্ধুও আছে অনেক। রাতে বাবার মুখে যুদ্ধের কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠলো ইয়ামিন। তাই বন্ধুদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে চাইলো। সকালবেলা মাকে না বলেই ছুটে গেলো আরীফদের বাড়িতে। তারপর এক এক করে ইয়াসিন, মুবাশ্বির, আবু বকরসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে স্কুলের মাঠে বসলো সবাই। ইয়ামিন সবকিছু খুলে বললো। সবার ভেতর স্বাধীকারের আগ্রহ জেগে উঠলো। যদি যুদ্ধ হয়, তবে ওরাও যুদ্ধ করবে বলে সীদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু ওরা সবাই তো কিশোর বয়সী। এতোসব অস্ত্রশস্ত্র পাবে কোথায় ওরা? হঠাৎ আতাউল্লাহ বলে উঠলো- আমাদের পাড়ার হুসাইন ভাইকে বলা যেতে পারে বিষয়টি। তিনি হয়তো কোন উপায় বলে দিবেন।
৩.
গ্রামের শিক্ষিত আর ভদ্র ছেলেদের মধ্যে হুসাইন আহমাদের নাম সর্বাগ্রে। শহরে পড়াশোনা করে। গ্রামে এসেছিলো বেড়াতে। দেশের অবস্থা খারাপ। তাই তার মা বারণ করেছেন এখন যেতে। তিনি অনেক আদর করেন ছোটদের। বিশেষ করে ইয়ামিনের বয়সীদের। তাই ইয়ামিনরা সকল বিষয়েই পরামর্শ করে তার সঙ্গে। একদিন সকালবেলা। ইয়ামিন তার বন্ধুদের নিয়ে হাজির হলো হুসাইন আহমাদদের বাড়িতে। সবাইকে একসাথে বাড়িতে আসতে দেখে খুব খুশি হলেন হুসাইন আহমাদ। সবাইকে মুড়ি গুড় খেতে দিলেন হুসাইনের মা। খাওয়া শেষ হলে, হুসাইন নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করলো- তা কী উদ্দেশ্যে এলে তোমরা? সবার পক্ষ থেকে ইয়ামিন বললো- শুনেছি দেশের অবস্থা ভালো না। যুদ্ধ হতে পারে। আমরাও যুদ্ধে শরিক হতে চাই। কিশোর বয়সী ছেলের মুখে যুদ্ধের কথা শুনে অবাক হলেন হুসাইন। তবে তৎক্ষণাৎ কিছু না বলে, আরেকদিন আসতে বললেন।
৪.
পঁচিশে মার্চ রাতে হঠাৎ হামলা করলো হানাদাররা। মরলো অনেক মানুষ। শহরে বন্দরে আন্দোলনের ডাক উঠলো। যুদ্ধ শুরু হলো। ইয়ামিন ওর বন্ধুদের নিয়ে আবারো উপস্থিত হলো ওদের হুসাইন ভাইদের বাড়িতে। এবারো হুসাইন ওদের ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কারণ এই কিশোর ছেলেগুলোর জীবনকে তিনি ঝুঁকিপূর্ণ করতে চান নি। কিন্তু ওদের পীড়াপীড়ির কারণে শেষে বললেন- তোমরা এখনি যুদ্ধে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নয়নপুর বাজারে আমরা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প করেছি। তোমরা সেখানে খাবার পৌঁছে দিবে। এখন এটাই তোমাদের কাজ।
সিরাজ বললো- ভাইয়া! এতে কী আমরা মুক্তিযুদ্ধে শরিক হতে পারবো?
হুসাইন বললেন- অবশ্যই।
৫.
চলছে মুক্তির সংগ্রাম। মরছে অনেক হানাদার। শহিদ হচ্ছে শত শত মুক্তিযোদ্ধা। সেই সাথে পালাক্রমে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে খাবার পৌঁছানোর কাজও চলছে ইয়ামিনদের। একদিন। মে মাসের পড়ন্ত বিকেল। শনিবার। খাবার নিয়ে ক্যাম্পে যাচ্ছে ইয়ামিন। আজ ওর দায়িত্ব। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে কোনকারণে। তাই দ্রুত চলছিলো নয়নপুর বাজারের দিকে। যদিও বেশি দূর নয়। কিন্তু বাদ সাধলো এক মিলেটারি। এসেই বললো- এ ল্যারকা! তু নে কাহাঁ চ্যালা?
ইয়ামিন প্রথমে ভয়ে চুপসে গেলো। পরক্ষণই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো- নয়নপুর বাজারে।
মিলিটারি বললো- তু নে বাঙ্গাল হো? এ্যা ল্যারকা! বলো- পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
এবার রাগ চড়ে গেলো ইয়ামিনের মাথায়। ক্রোধে ফেটে পড়তে চাইলো যেনো। তারপর চিৎকার করে বললো- জয় বাংলা! বাংলাদেশ জিন্দাবাদ! হঠাৎ দুটো গুলির আওয়াজ হলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ইয়ামিনের নিথর দেহটা।
৬.
নয়মাস যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলো। বাংলার বুকে পতপত করে উড়তে লাগলো বিজয়ের পতাকা। খুশির রোল পড়ে গেলো সারা দেশে। সবার মুখে বিজয়ের গান। কিন্তু যেসব শহিদের রক্তের বিনিময়ে এলো বিজয়, সেই শহিদি কাফেলায় ইয়ামিনও যে শামিল ছিলো- তা কী জেনেছিলো তার বাবা-মা। কিংবা তার বন্ধুরা?