আমাদের মধুমাস মাসউদুল কাদির

আমাদের মধুমাস মাসউদুল কাদির

একটি মাস-তার নাম মধু মাস। মধু মাস বললেই আমরা চিনতে পারি- ওটা জ্যৈষ্ঠ মাস। বৈশাখ যতটা ভীতির জ্যৈষ্ঠ ততটাই মধুময়। মৌ মৌ করতে থাকা মধুমাসের ফলের ঘ্রাণে মন ভরে যায়।
আমরা জানি, বাংলাদেশের প্রকৃতিতে ছয়টি ঋতু রয়েছে। একেকটি ঋতুর একেক রকম সাজ। প্রকৃতির দিকে তাকালেই বোঝায় কার রঙ কী? কোন রঙ কার পছন্দ। আসলে আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে ঋতুগুলোকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলোর নাম : গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত।
গ্রীষ্মের শেষ মাস, অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাসকে আমরা মধুমাস বলি। রঙবেরঙের ফলের সমাহার থাকে এ মাসে। বর্ষার ফর্সামুখো চেহারা দেখা যায়। বন্যার পানিরও দেখা মিলে। সাদা সাদা কাশফুল দেখেই বোঝা যায় এখন প্রকৃতিতে শরৎকাল চলছে। সকালে দূর্বাঘাসের উপর রোদের আলো পড়ে দূর্বার ডগা ঝিকঝিক করতে থাকে। তখন যেনো হেমন্ত বাতাসে দোল খায় মানুষ। শেষরাতে শীতের আভাস অনুভব করা যায়। শীতের প্রহরে শিশুর মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কোন কাল চলছে। গ্রামে মুড়ি-মুড়কি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুন পোহানোর দৃশ্যও চোখে পড়ে। শীতকালটা তখন বাস্তব হয়ে ওঠে।
বসন্ত যেনো রাজাধিরাজ। বসন্ত বাতাসে প্রকৃতি সাজে নতুন সাজে। ফুলগাছগুলোতে নতুন কুঁড়ি জন্মায়।
বিশ্বজুড়ে বিরাজ করা প্রকৃতি মহান আল্লাহর দান। তা যেনো মহান আল্লাহ নিজ হাতে গড়েছেন। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম বিবিধ উদ্ভিদরাজি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ।

(সূরা কাফ : আয়াত ৭-৮)।

কী কারণে মধুমাস প্রিয়? মধুমাসে মানুষ খুশি হয় কেন? কারণ মধুমাস মানে ফলের মাস। সব ফল পাকতে শুরু করে এই মাসে। গ্রীষ্মের দাবদাহের সঙ্গে সঙ্গে আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, জামরুলসহ নানা জাতের ফল পুষ্টু হতে থাকে। এ মাসেই সেগুলো খাওয়ার উপযোগী হয়। তাজা ফলের এ স্বাদ আর কোনো মাসেই পাওয়া যায় না। সম্ভবও নয়। এ তো শুধুই প্রকৃতির আশীর্বাদ নয়, আল্লাহর সেরা দান। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা ফুলপাখিরাও শরীরে গ্রহণ করে স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপাদান। পাখিরা মিছিল দিয়ে ফল জাতীয় গাছে গাছে বসতে থাকে। পাকা ফলের রসে টইটুম্বুর গাছে পাখিদের মেলা বসে। এ মেলা চলতে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। পাখিরা মাঝে মাঝে বাধার মুখেও পড়ে। কিছু কিছু আম, লিচু ও জাম গাছ ফল ব্যবসায়ীরা জাল দিয়ে ঢেকে রাখে। এতে পাখিদের গতিপথ বদলাতে হয়। উড়ে উড়ে যেতে হয় বহু দূরে। যেখানে স্বাধীনতা আছে- সেখানে। প্রণভরে তারা ফলের স্বাদ গ্রহণ করে। পাখিদের এটা অন্যরকম অনুভূতি।
জ্যৈষ্ঠ মাসের সন্ধ্যার আকাশ আরো মায়াবী। লাল আভার সঙ্গে সঙ্গে বাদুড়ের ঘুম ভাঙ্গে। ওরা ফল গাছে ভিড় জমায়। রাতভর প্রকৃতির সঙ্গে ফলের জুস আহরণে ব্যস্ত থাকে। বাদুড় রাতে কেন বের হয়? রাত কেন পছন্দ তাদের? এটা আরেক গল্প। পাখির মতো করে উড়ে বেড়ায় বলেই কি বাদুড়কে আমরা পাখি বলছি? না। আসলে বাদুড় কিন্তু পাখি নয়। পাখির মতো ওরাউড়ি করতে পারে। বাদুড়ের চোখের শক্তি অনেক দুর্বল। খুব কম দেখতে পায়। ঘ্রাণে ঘ্রাণে বা শবণশক্তির উপর নির্ভর করে এরা খাবার সংগ্রহ করে। শব্দতরঙ্গ শুনতে পায়।
পাকা কাঁঠাল গাছে কখনও কাঠবিড়ালি দেখেছো? মনের সুখে কাঠবিড়ালি কাঁঠাল গাছ দখলে নেয়। নিজের মতো করেই কাঁঠালের উপর চড়াও হয়। গাছের নিচ দিয়ে কত মানুষ হেঁটে যায়, ঘুরে বেড়ায়, দাঁড়িয়ে বা বসে থাকে- কাঠবিড়ালির এসবে কিছুই যায় আসে না। তারা মধুমাসের মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। কখনও এই গাছ, কখনও ওই গাছ ছুটে বেড়ায়। এভাবে চলতে থাকে তাদের মিশন।
স্বাধীন পাখিরা এভাবে যা খায় তার চেয়ে বেশি মাটিতে ফেলে দেয়। নষ্ট করে। লোকালয়ের গাছের নিচে তো মানুষজন আসা যাওয়া করে। তখন অনেকেই নিচে পড়ে থাকা ফল কুড়িয়ে নেয়। কিন্তু পাহাড়ে এমন করে অনেক ফল নষ্ট হয়। পাহাড়ে যদি তুমি যাও, সেখানকার ফলের স্বাদ আরো বেশি। সেই স্বাদ ভিন্নরকম। পাকা পাকা রসে ভরা ফল যেনো উপচে পড়ছে। খাবারের লোক নেই। পেয়ারা গাছের নিচে গেলে দেখবে, কী দারুণ দারুণ পেয়ারা গাছের নিচে পড়ে আছে। তোমার মন চাইবে ওখান থেকে তুলে ধুয়ে মুখে নিতে। তবে পাহাড়িরা এ দৃশ্য দেখলে তোমাকে কিছুতেই গাছের নিচ থেকে পেয়ারা খেতে দেবে না। কারণ, বিষাক্ত কোনো সাপ-বিচ্ছু খেয়ে নিচে ফেলতে পারে এই পেয়ারা। এই সতর্কতার কারণে কেউ নিচে পড়ে থাকা পেয়ারা খায় না। গাছ থেকে পেড়ে এনে তাজা পেয়ারা খায়।
রসে রসে ভরপুর মধুমাস। জ্যৈষ্ঠ। আসলে কি মধু ফলে থাকে? ভুল ভাঙলো? মধুমাস বলতে কিছু আছে? মধু আসলে কোথায় থাকে? ফলে না ফুলে? মধু ফলে নয়- থাকে ফুলের মধ্যে। এ সমাজ ধরেই নিয়েছে, মধুমাস মানেই মধুময় আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুর মওসুম। পাকা ফলের গন্ধে মৌ মৌ করে প্রকৃতির পারদ।
মধুমাস এলে আমাদের সতর্ক থাকতে হয়। মধুমাসের মতো রসালো ফল আর সুন্দর সুন্দর ফুলে ভরা মজার মাসে কেন আমাদের সতর্ক থাকতে হয়? একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী তাজা ফলের সতেজতা বিষ মিশিয়ে নষ্ট করে দেয়। এসব ব্যবসায়ীর কারণে শহুরে মানুষেরা জিম্মি হয়ে পড়ে। তাদের মধুমাসের স্বাদগ্রহণের সুযোগও নষ্ট হয়। তাই আমাদের সতর্ক হতে হয়। এর কোনো বিকল্প নেই।
প্রকৃতির কল্যাণে যত ফল-ফুল বা অন্য সমারোহ আছে সবই মহান আল্লাহর দান। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের জন্য একটি নিদর্শন মৃত ধরিত্রী, যাকে আমি সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, যা তারা আহার করে। ’

(সূরা ইয়াসিন : আয়াত ৩৩)
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমিনে আছে সেসব।’

(সূরা বাকারা : আয়াত ২২)
মহানগ্রন্থ কুরআনে ছয়টি ফলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নিশ্চয়ই তোমাদের জানতে ইচ্ছে করছে কোন কোন ফল। এক. খেজুর, দুই. ডালিম/আনার, তিন. আঙুর, চার. ডুমুর, পাঁচ. কলা ও ছয়. জয়তুন।
প্রত্যেকটি ফলই স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। সাধারণত মানুষও এসব ফল বেশি বেশি খেয়ে থাকে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা অনেকটা খেজুরের উপরই বেঁচে আছে। দুনিয়ার সব মানুষই খেজুর পছন্দ করে। শিশুরাও এই ছয় প্রকারের ফল পছন্দ করে।
শেষ করবো পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াতের তরজমা দিয়ে। মহান আল্লাহ জান্নাতে মোমিনকে জায়গা দিয়ে কী দেবেন। সেখানেও অনেক ফলমূল থাকবে। ফলের সমাহার দেখে জান্নাতী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে প্রচুর ফলমূল, তা থেকে তোমরা আহার করবে।’ (সুরা: জুখরুফ, আয়াত : ৭৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘সেখানে তাদের জন্য থাকবে ফলমূল এবং যা চাইবে (তা-ই পাবে)’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৫৭)। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের জন্য রয়েছে নির্ধারিত রিজিক। ফলমূল এবং তারা সম্মানিত। সুখদ-কাননে। ’

(সূরা : সাফফাত : আয়াত ৪১-৪৩)

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য