দুপুর গড়িয়ে বিকাল ছুঁই ছুঁই। পশ্চিম জানালা দিয়ে হালকা তেজী কোমল রোদ জানালার গ্রিল, বইয়ের সাদা কালো পাতা হয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে টুম্পার গাল। টুম্পা এমনিতেও নাকি অদ্ভুত সুন্দরী। টুম্পার দাদী বলেনÑ তিনিও তার মতন সুন্দর ছিলেন ছোটবেলায়। আর তাই পরীরা নাকি তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আর এখন রোদের হলুদ আলো টুম্পার সৌন্দর্য যেন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে আজকে তার মন খারাপ। ভীষণ ভীষণ মন খারাপ।
মন খারাপ হলেই টুম্পা পশ্চিম জানালার পাশে এসে বসে পড়ে। ইচ্ছে হলে বইটইও পড়ে। আবার তাতেও ভালো না লাগলে চুপটি করে বসে থাকে, একদম। যেন পিনপতন নীরবতা। অথচ তখন যে টুম্পার মনে কত বড় ঝড় বয়ে যায় তার খবর কে রাখে?
আসলে আজকে হয়েছে কিÑ যে আজ তার বিকেলে বের হওয়া বারণ। এইটুকু মেয়ে সে, কোনোরকম দুপুর গড়াতেই বের হয়ে পড়ে। কারো কোনো ডাক-দোহাই শোনে না। তাই আজ টুম্পার মা তাকে আচ্ছামত শাসিয়েছেন। আর ঠিক তাই চাঁদের মতো উজ্জ্বল মায়াবী টুম্পার খুব রাগ হয়েছে। অভিমানে চোখ দুটো লাল হয়ে ছলছল করছে যেন আর একটু হলেই সমুদ্র স্রোত গড়াতে শুরু করবে।
কিন্তু টুম্পা খুব সহনশীল মেয়ে, বয়স কম হলে কি হবে। এ বয়সেই অনেককিছু অন্যকে জানতে না দিয়েই নিরবে নিভৃতে সয়ে নিতে শিখেছে সে। আসলে মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়। এমনকি তারা নিজেরাও কখনো কখনো টের পায় না।
সে যাই হোক টুম্পা এখন জানালার পাশে বসে আছে। কিছুক্ষণ বই পড়ছে তো কিছুক্ষণ ছলছল চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে। টুম্পাদের বাসার সাথেই তাদের খেলার মাঠ যেখানে সে তার বান্ধবীদের নিয়ে আসর জমায়। বিভিন্ন খেলার আসর।
আজও সবাই খেলবে অথচ সে থাকবে না। ওদিকে মায়ের কড়া আদেশ আজকে কিছুতেই বের হওয়া যাবে না। বাইরে ছুটে ছুটে নাকি অতি বাঁদর হয়ে গেছে সে। এসব কিছু ভেবেই মুহূর্তের মধ্যে টুম্পার ভেতরটা দুমরে-মুচড়ে যায়। মনে হচ্ছে যেন ব্যথার পাহাড় কেউ তার বুকের ওপর রেখে দিয়েছে। ভেতর থেকে আজ তার খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু টুম্পা নিজেই নিজেকে আশ্চর্য করে দিয়ে স্রেফ একফোঁটা চোখের পানি ফেলে নিমিষেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। অবাক লাগে এইটুকু বয়সে এতকিছু!
এভাবেই দুপুর গড়াল, বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। টুম্পা যথারীতি পড়তে বসলো। পড়া শেষে অন্যদিনের মতো খাওয়া দাওয়া করে ঘুমুতে চলে গেল।…
রাত খুব গভীর! এদিকে সবাই ঘুমিয়ে গেছে। আর ওদিকে টুম্পার গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো। সে কী জ্বর! জ্বরের ঘোরে ঘুমের মধ্যেই টুম্পা আবোলতাবোল বকতে লাগলোÑ এই বিথী তোরা যা আমি আসছি।… রীনা সব ঠিক কর।… আর যাবো না মা!
টুম্পার এসব চিৎকার চেঁচামেচিতে তার মা-বাবা উভয়েরই ঘুম ভেঙে গেল। এসে দেখে একি মেয়ের তো মারাত্মক জ্বর! ব্যাস, টুম্পার মা-বাবা দুজনেরই আজ ঘুম হারাম। টুম্পার মা পানিপট্টি দিয়ে দেখছেন জ্বর কমানো যায় কিনা। আর ওদিকে এতোরাতে তার বাবা ডাক্তারকে ফোন দিয়ে কিছু মেডিসিন জেনে নিলেন। টুম্পাদের ঘরে সাধারণ মেডিসিন রাখাই থাকে। সেদিন তেমন কোনো অসুবিধা হলো না। টুম্পার বাবা তাকে একটু উঠিয়ে ওষুধগুলো খাইয়ে দিলেন। সাথে খুব কড়াকরে টুম্পার মাকে ঝেড়ে দিলেন।
বললেনÑ শুনো, মেয়ে যা করার করুক। খেলার সময় ঘরবন্দী করে রাখলেই আইনস্টাইন হয়ে যাবে নাকি! যতটুকু পড়ে ততটুকুই চলবে। বাচ্চামানুষ। এখন খেলবে নাতো আর কবে খেলবে। যা বলেছি মনে থাকে যেনো!