উড়ন্ত বলাকা

উড়ন্ত বলাকা

চারিদিকে পাখির কিচির মিচির শব্দ। পাখিগুলো কী সুন্দর উড়ছে! এ ডাল থেকে ও ডালে। লাফালাফি করছে। দারুণ মুগ্ধতায় ভরে আছে পরিবেশ। সাফি উপভোগ করছে এই সুন্দর মুহূর্তটা। পাখির সাথে সময় কাটাতে গিয়ে সাফির বাড়ি ফিরতে দেরি হল।

ইশ! আজও নিশ্চয় আম্মু বকবে।

সাফি পড়তে বসেছে। কিন্তু পড়ায় মন নেই। বার বার শুধু পাখিদের কথাই মনে পড়ছে। কী চমৎকার দৃশ্য। চোখ থেকে সরছেই না। এ নিয়ে দুপুরেও বকা খেয়েছে, তাও শিক্ষা হয়নি।

: সাফি, কি হচ্ছে শুনি?

: কইই!  আপু কিছু না তো। দেখো আমি বই পড়ছি।

: দেখি, তোর খাতা দেখি।

: সাফি দেখাবে না। দুই ভাইবোন কাড়াকাড়ি শুরু করল। শেষমেশ সাফা জোর করেই দেখল। সাফি খাতায় কিছু পাখির ছবি এঁকেছে। ভাইরে, তোর মাথা থেকে পাখির ভূত কবে নামবে বল তো?

: আপু ওদের দেখার কেউ নেই। তাই, ওদের জন্য আমার বড্ড মায়া হয়।

: আগে পড়ালেখা শিখে মানুষ হ ভাই, তারপর পাখির প্রতি সব মায়া ঢেলে দিস।

সাফির ক্লাসমেট সবাই সাফির পাখিপ্রেম সম্পর্কে জানে। তাই সবাই ওকে পক্ষী ডাকে। বাংলা ক্লাসে একজন আস্তে করেই পক্ষী বলে উঠল। কিন্তু তা স্যারের চোখ এড়াল না।

: সাফি দাঁড়াও।

: ‘জি… ই… ই…’ স্যার সাফি ভয়ে ভয়ে বলল।

: ইমন তোমাকে পক্ষী ডাকলো কেন?

: স্যার আমি পাখিদের ভালোবাসি তাই ‘সাফি মুচকি হেসে বলল’।

: তাই পক্ষী ডাকতে হবে?

: ইমন তুমি দাঁড়াও।

: জ্বি, স্যার।

: সাফি যা বলছে তা কি সত্য?

: জ্বি, স্যার।

: ও যে পাখিপ্রেমী তার প্রমাণ আছে কি?

: জ্বি, স্যার। এই দেখেন ও কী সুন্দর পাখির ছবি এঁকেছে। তাছাড়া ও বাড়িতেও অনেক অসুস্থ পাখির সেবা করে।

: বল কী! তাই নাকি? ‘স্যার অবাক হয়ে’।

: তাহলে আজ থেকে আমিও ওকে পক্ষী ডাকবো।

স্যারের কথায় ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে উঠল। সেই সাথে সাফিও।

ধুর! সকাল সকাল এই পুঁচকেটা কাঁদছে কেন? না জানি আবার পাখির শোক পাইছে।

: কিরে সাতসকালে কাঁদছিস কেন?

: আপু গতকাল ডানা ভাঙা যে পাখিটি এনেছিলাম, ওটা মারা গেছে।

: ‘চোখের পানি মুছতে মুছতে’ বোকা ছেলে, এভাবে কেউ কাঁদে? তুমিতো আমার সোনাভাই। তুমিতো তোমার সেবায় কমতি রাখোনি। তারপরেও মরে গেলে আর কী করার? আর কাঁদে না ভাই। ওই যে তোমার অন্য পাখিগুলো হাসছে, খেলছে। তুমি ওদের দেখো।

: ‘সাফাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল’ আপুরে আমি কতো স্বপ্ন দেখতাম। পাখিটা আবার আকাশে উড়বে কিন্তু এ কী হল!

: সোনাভাই আমার, এভাবে কাঁদতে নেই। ওঠ, হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করে স্কুলে যেতে হবে।

আজ সাফির মনটা খুব খারাপ। স্কুলেও সবার সাথে তেমন কথা বলেনি। টিফিনে খেলতে যায়নি। এমনকি বনের পাখিদেরকেও আজ সময় দেয়নি। সাফিদের বাড়ির পাশেই একটি বন আছে। ওই বনের পাখিদের সাথেই ওর বন্ধুত্ব। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রতিদিন ওদের সাথে কথা বলে, হাসে, খেলে। কোনো পাখি অসুস্থ হলে সেটি বাড়ি আনে। তারপর সেবা-যত্ন দিয়ে সুস্থ করে আকাশে উড়িয়ে দেয়। এতেই ওর তৃপ্তি, এতেই যেন পৃথিবীর সকল আনন্দ খুঁজে পায় ছেলেটি।

মন খারাপ থাকলেও অন্য পাখিদের সেবায় ত্রুটি নেই তার। একটি পাখি প্রায় একমাস ধরে অসুস্থ। ওর এক ডানা আর এক পা ভাঙা। কেবলমাত্র পাখিটি মাথা তুলল। এই পাখিটিও যেন সাফিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। এ পাখিটির একটু সুস্থতা যেন সাফির মনে শান্তির ছোঁয়া দিল। নিমিষে ভুলিয়ে দিল গতদিনের শোক।

সাফির মনটা আজকাল বেশ ফুরফুরে। সেই পাখিটি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। সাফি ওর সবটুকু দিয়ে পাখিটিকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। বনের পাখিদের একটু কম সময়ই দিচ্ছে। কেননা, সামনে তার ফাইনাল পরীক্ষা। পড়াশোনায় বেশি সময় দিতে হচ্ছে। সাফি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তাই পড়ার চাপ বেশি। এ পরীক্ষায় ভালো করতে হবে, নতুন স্কুলে যেতে হবে। তাছাড়া, বড় কথা হলো। এ পরীক্ষায় দশের মধ্যে রোল থাকতে হবে। তাহলে আব্বু তার পাখির ঘরটা আরেকটু বড় করে দেবে। সে কারণেই পড়াশোনার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে।

এক ডানা, এক পা ভাঙা পাখির সাথে সাফির খুব ভাব হয়েছে। পড়তে বসলেও পাশে রাখে। বিশেষ যত্নের সাথে সেবা করছে। সবার মাঝে থাকলে সুস্থ হতে সময় লাগবে, কষ্ট বেশি পাবে তাই। নাম না জানা এ পাখিটির আবার নামও দিয়েছে। তার আরেক নাম পক্ষির সাথে মিলিয়ে রেখেছে চক্ষি। চক্ষির নামের কারণও আছে। চোখে চোখে রাখে পাখিটিকে। ওর প্রতি ভালোবাসাটাও যেন বেশি। স্কুল থেকে এসে ব্যাগ না রেখেই আগে চক্ষিকে খোঁজে। প্রতি মুহূর্তে যেন চোখে হারায়।

কয়েকদিনে চক্ষির বেশ পরিবর্তন হল। চক্ষি এখন দাঁড়াতে পারে। ঘরের এক কোণা থেকে লাফিয়ে আরেক কোণায় যায়। সাফির পড়ার টেবিল থেকে লাফিয়ে বইয়ের তাকে যায়, কখনোবা বিছানায়, কখনোবা সাফির ঘাড়ে। আবার কখনো বা তার মাথায় উঠে বসে। পড়তে পড়তে সাফিও চক্ষির সাথে বেশ মজা করে। তবে চক্ষি ওড়ার জন্য খুব ছটফট করে। সাফিও তা বুঝতে পারে। চক্ষির মাথায় হাত বুলিয়ে সাফি বলে, ‘মন খারাপ করিস নারে। আর মাত্র ক’টা দিন। তারপরে তুই ডানা মেলে উড়তে পারবি।’

দেখতে দেখতে সাফির পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। এখন তার পড়াশোনার ঝামেলা নেই। চক্ষির সেবায় আরও বেশি সময় দিতে পারছে। বনের পাখিদের সাথেও এখন সাফির মধুর সময় কাটে। একটু একটু করে  চক্ষির সুস্থতা যেন তার সময়কে আরও মধুর করে তুলছে।

সাফির পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। সাফি অষ্টম স্থান অধিকার করে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। তার এ রেজাল্টে আব্বু, আম্মু, আপু সবাই খুশি। সাফিও খুশি। তার পাখির জন্য বড় ঘর পাবে। যেমন কথা তেমন কাজ। সাফি ও তার আব্বু মিলে কাজ শুরু করল। ঘরটা বড় করতে বেশ কয়েকদিন লাগল। এ কয়দিনে চক্ষিকে সময় কম দিয়েছে সাফি। তবুও চক্ষি এখন পুরোপুরি সুস্থ। অন্য পাখির মতোই স্বাভাবিক উড়তে পারে। এ যেন ঈদের মতো খুশি। সাফি সবাইকে ডেকে ডেকে বলছে, ‘জানো আমার চক্ষি এখন আগের মতো উড়তে পারে।’

কী মজা! কী মজা! চক্ষি এখন ডানা মেলে খোলা আকাশে উড়বে। সাফি চক্ষিকে খাঁচা থেকে বের করল। তারপরে তার হাতের উপর দাঁড় করাল।

দু’চোখ যেন ছলছল করছে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে তার। এভাবে বহু পাখিকে সুস্থ করে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে সাফি। তবে আজ কেন তার খারাপ লাগছে? আগেতো এমন হয়নি!

চক্ষিরে আজ তোর ছটফটানির অবসান হল। যা চক্ষি, যেদিকে দু’চোখ যায় তুই উড়ে যা। চক্ষি উড়ছে আর সাফি দেখছে। ঝরঝর করে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। হাত নেড়ে চক্ষিকে বিদায় জানাল সাফি। ভালো থাকিস আমার প্রিয়বন্ধু চক্ষি, ভালো থাকিস।

 

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য