সাদা সাদা কুয়াশার স্তূপ ঢেকে রেখেছে চারপাশ। চোখ তুলে তাকালেও একটু দূরে দেখার কোনো উপায় নেই। দুধের সরের মতো জমাট বাঁধা কুয়াশাই শুধু চোখে ভাসে। কনকনে শীতের সকাল। দোকানদার জলিল সাদা রঙের পুরনো চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দোকানের সামনে এসেই চেঁচিয়ে উঠলো, বিচ্ছুর ছাউ চাইরটারে কইছি দোহানের বারিন্দায় ঘুমাইবি না। তাও হুনলো না! খাড়া- বুঝাইতাছি মজা।
পাশের দোকান থেকে একটা লাঠি নিয়ে এসেই শুরু করলো দ্রিম দ্রিম বাড়ি। লাঠির বাড়ি খেয়ে ওদের ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে জলিলকে দেখেই দৌড়ে পালালো ওরা। কিন্তু সবাই পালাতে পারলেও ধরা পড়ে গেল মতি।
ধরা পড়েই বলতে শুরু করলো, আর এহানে আমু না চাচা, ছাইড়া দেন!
কিন্তু জলিল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ না। অনেকদিন ওদের ধরার চেষ্টা করেছে, আজ অন্তত একটাকে ধরে হলেও কিছুটা সফল হয়েছে।
-আর এহানে আয়বিনি ক? আর এহানে আয়বিনি?’
মতি বাড়ি খেয়ে লাফাচ্ছে আর কেঁদে কেঁদে বলছে, মাইরেন না চাচা মাইরেন না। আর কোনোদিন এহানে আমুনা।
-আর এহানে ঘুমাইবিনি ক?… দ্রিম দ্রিম বাড়ি।
– ছাইড়া দেন, আইজকা ছাইড়া দেন, আর এহানে আমু না।
– না তোরে আইজকা ছাড়ছি না।
– দেন জলিল ভাই দেন, আচ্ছা মতো দেন। এইগুলারে মাইর ছাড়া কথা কইলে হুনবো না- দোকানের পাশে দাঁড়ানো আরেকজন চেঁচিয়ে বলল। তবে জলিল আর মারলো না। বলল, যা আইজকা ছাইড়া দিলাম।
মতি কাঁদতে কাঁদতে ওর বন্ধুদের খুঁজে বের করে। ওদের বয়স প্রায় কাছাকাছিই, বড়জোর সাত-আট বছর। মতি আসতেই মিন্টু বলে উঠলো, বুইড়ার কোনো দয়া-মায়া নাই।
জহিরও মিন্টুর সাথে গলা মিলালো-আমরা হেয়ানে না ঘুমাইলে কুত্তা হেয়ানে ঘুমায়। আমরা হেয়ানে একটু ঘুমাইলেই সমস্যা, কুত্তা ঘুমাইলে হের ভালা।
রনিও মুখ খুলল- আইজকা আর হেয়ানে যামু না।
মতি কিছুই বলছে না, কেঁদে কেঁদে শুধু চোখের পানি ফেলছে। ভাবছে-ওর বাবা-মা থাকলে হয়তো এভাবে বাইরে থাকতে হতো না। অন্যদের মতো ওদেরও বাড়ি থাকতো, যেখানে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতো, কিন্তু জন্মের পর দেখেনি বাবার মুখ, বুঝতে শেখার পর মাও চলে গেছে যেন কোথায়।
২
ওরা চারজন আজ রাত্রি যাপনের একটা জায়গা খুঁজে পেলো মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ছাদওয়ালা বেঞ্চিতে। এ জায়গাটা পেয়ে ওরা একটু খুশি হয়েছে। কারণ এখানে ঘুমালে জলিলকে পিটুনি খেতে হবে না, বাড়িওয়ালা দুলালের বুটজুতার লাথিও খেতে হবে না। দুলাল নামটি শুনলেই ওদের চোখে নির্দয় দুলালের ভয়ংকর ছবি ভেসে ওঠে।
এক রাতে ওরা চারজন দুলালের বাড়ির সামনে বড় গেইটের নিচে ঘুমিয়ে ছিল। একটু বেশি রাত করেই সেদিন বাড়ি ফিরলো দুলাল। গাড়ি থেকে নেমে গেইটের সামনে ওদের ঘুমিয়ে থাকতে দেখেই তার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। দারোয়ানকে অনেক গালিগালাজ করলো-কেন টোকাই পোলাপান তার বাড়ির সামনে ঘুমাবে?
দুলাল চেঁচিয়ে বললো,এগুলারে রুমে ডেকে আন!
দারোয়ান ওদের নিয়ে দারোয়ানের রুমে ঢুকলেই দরজা বন্ধ করতে বললো। দরজা বন্ধ হয়ে গেল, দুলাল চোখ বড় বড় করে ওদের বললো, দুদিন আগে বাসার জানালার পাশের টেবিল থেকে আমার মোবাইলটা তোদের কে নিছে?
কথাটা বলেই শুরু করলো বুটজুতার লাথি। ওরা চিল্লিয়ে বলতে লাগলো- আমরা নেইনি, আমরা নেইনি।
-না, তোরাই নিছস, তোরা মানুষের বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করস আর সুযোগ পেলেই এটা-ওটা নিয়ে যাস। বল্, কে নিছে?
এ কথা বলেই আবার মেরে চললো আর ওরা চিৎকার করে চললো- ও মাগো, বাবাগো, আমরা নেই নাই, ও বাবা গো।
প্রায় আধঘণ্টা পর দুলাল দারোয়ানকে দরজা খুলে দিতে বললো। আর ওদের বললো, তোদের যেন আর কোনোদিন এদিকে না দেখি।
ওরা কাঁদতে কাঁদতে সেদিন বেরিয়ে যায় রাস্তায়।
৩
মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ওরা খুব আনন্দের সাথেই ঘুমানোর আয়োজন করছে। শীতের রাত। সবাই মিলে কিছু পত্রিকার ছেঁড়া কাগজ জমা করেছে, গাছের ঝরে যাওয়া শুকনো পাতার উপর পত্রিকার ছেঁড়া কাগজগুলো বিছিয়েছে শোবার জন্য। ওরা চারজন গায়ে গায়ে মিলে শুয়েছে, ডাস্টবিনের পাশ থেকে কুড়িয়ে আনা মিন্টুর ছেঁড়া ময়লা কম্বলটা নিয়ে টানাটানি করছে। এই এক ছেঁড়া কম্বল দিয়ে কারো শরীরই ঢাকতে পারছে না। একজন এদিকে টানছে তো আরেকজন অন্যদিকে টানছে। এভাবে কম্বল টানাটানি করতে করতে একসময় ওরা ঘুমিয়ে যায়। তীব্র শীতের কারণে একটু পরপর ঘুম ভাঙ্গে, এভাবেই এক সময় রাত শেষ হয়। দিনটা ওদের যেভাবেই কাটুক, রাতটা ওদের ছেঁড়া কম্বল টানাটানিতে আনন্দেই কাটছে। সপ্তাহ দু’সপ্তাহ যাবত বাকি রাতগুলো এভাবে কাটলেই ওরা নিজেদের সুখী ভাবতো, কিন্তু হলো না। এই জায়গাটাও ওদের জন্য আর রাতের আশ্রয়স্থল রইলো না।
আজ রাতেও ওরা শহীদ মিনারের দিকে রওনা দিয়েছে। সন্ধ্যাবেলা শহীদ মিনারের গেইট বন্ধ হয়ে গেলেও শহীদ মিনারের যে ভাঙ্গা দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ওরা ভিতরে যেতো সেটা আজ নতুন বাজেটের কারণে মেরামত হয়ে গেছে। সেখানে ওদের ঘুমানোর আর সুযোগ নেই। তবুও ওরা অনেক চেষ্টার পর দেয়াল টপকিয়ে ভেতরে গেল। দেখলো ঘুমানোর আর সুযোগ নেই, ওদের ঘুমানোর ভাঙ্গা ফ্লোরটার উপর ভেজা সিমেন্টের প্রলেপ। রেখে যাওয়া ছেঁড়া কম্বলটা নেই আর ওখানে, নেই ঝরে পড়া গাছের শুকনো কোনো পাতাও। সবকিছু কি পরিষ্কার হয়ে আছে! কোনো রকম শুয়ে পড়ে একপাশে ওরা।
সকালে গেইট খুলে দারোয়ান ভেতরে ঢোকে। কিছু দূর এগোতেই ওদের শুয়ে থাকার দৃশ্য চোখে পড়ে । অমনি কাছে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করে ওদের ঘুম থেকে উঠিয়ে সেখান থেকে বের করে দেয়।
সারাটা দিন ওরা আজ মিরপুর-১ নম্বরেই ছিল। মানুষের কাছে হাত পেতেছে। কারো কাছে চেয়েছে দশটা টাকা, কারো কাছে একটা কেক অথবা রুটি। কেউ দিয়েছে, কেউ দেয়নি, এভাবে কেটে গেছে ওদের দিন। যেই রাত হতে শুরু করেছে, ওদের প্রতিদিনের মতো চিন্তাটাও শুরু হয়ে গেছে, রাতে ঘুমানোর একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে, বেশি সময় খুঁজতে হলো না। মিরপুর-১ নম্বরের ফুটওভার ব্রিজটাকেই নির্ধারণ করলো ওরা। আরো অনেকের সাথে ওরাও ফুটওভার ব্রিজে ঘুমাতে শুরু করেছে।
৪
আজ মিরপুর ১-নম্বরের ফুটওভার ব্রিজে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। সবাই দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশটা কেমন থ মেরে আছে। ফুটওভার ব্রিজের আশেপাশেও কেউ আসতে চাচ্ছে না, কারণ গতরাতে এই ফুটওভার ব্রিজে একজন যুবকের লাশ পাওয়া গেছে। এর পরেও আজ ওরা ফুটওভার ব্রিজেই ঘুমিয়েছে। কিন্তু আজ রাতটা ওদের অন্যান্য রাতের মতো না, মধ্যরাতে পুলিশের লাঠিচার্জে ওদের ঘুম ভাঙলো। আরেকজন পুলিশ নিচে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিচ্ছে-তাড়াতাড়ি এখান থেকে নিচে নেমে যেতে। একজন একজন করে ফুটওভার ব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে নামছে আর পুলিশ পাছায় দুটো করে বাড়ি দিচ্ছে। বাড়ি খেয়ে ওরা দৌড়ে নেমে গেল। শীতের রাত। সাদা সাদা কুয়াশা মাড়িয়ে রাস্তার কিনার দিয়ে হেঁটে চলছে ওরা। খুঁজে ফিরছে শুধু একটু ঘুমানোর জায়গা।