সামের চোখ খুলে তাকায়। প্রথমেই তার যেটা মনে হয় তা হচ্ছে তার প্রচণ্ড হিসু পেয়েছে এবং এজন্য এক্ষুনি তাকে বাথরুমে যেতে হবে। হাঁচড়ে-পাচড়ে সে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমের দিকে দৌড় দেয়। মৃদু আলোজ্বলা আরব স্টাইলের বাথরুমের দরজায় পৌঁছে সে থামে। টয়লেটে ঢোকার আগে পায়ে দরজার পাশে রাখা প্লাস্টিকের চপ্পল পরে নিতে হবে। তার সব সময় ভয় হয় যে একটু অসাবধান হলেই বুঝি সে পা পিছলে টয়লেটের গর্তের মধ্যে পড়ে যাবে। নির্দিষ্ট জায়গায় সাবধানে হিসুর কাজ সারে সে যাতে কমলা রঙের টাইলের মেঝেতে তার এক আধ ফোঁটাও ছিটকে না পড়ে। শুধু তাই নয়, হিসু শেষ হওয়ার পর সে ট্যাপ থেকে পানির পাইপ খুলে নিয়ে আশপাশটা পানিতে ভালো করে ধুয়ে দেয়। এটা সে শিখেছে তার বাবার কাছ থেকে। এতে বাথরুমে কোন গন্ধ হয় না। সামের এখন খুবই গর্ব বোধ করে যে তার পঞ্চম জন্মদিন পেরনোর পর থেকে টয়লেটে যেতে কারো সাহায্য তার লাগে না। সামেরের চাচির বাড়িতে একটা খুব বড় আর সুন্দর বাথরুম আছে। তার খুব ইচ্ছে তাদেরও ও রকম একটা বাথরুম হোক। গত বছর মা মারা যাওয়ার পর থেকে সামের আর চাচার বাড়ি যায় না। চাচি তাকে অত্যন্ত আদর করতেন। সে গেলেই তাকে মিষ্টি খেতে দিতেন এবং টিভি খুলে দিতেন যাতে সে কার্টুন দেখতে পারে। চাচিদের টিভিতে কার্টুনের কয়েকটা চ্যানেল আছে এবং চব্বিশ ঘণ্টাই কার্টুন দেখানো হয়। আর তাদের যে পুরনো টিভি আছে তাতে কার্টুন দেখানো হয় শুধু বিকেলেই। বাকি সময় জুড়ে বড়দের বিরক্তিকর অনুষ্ঠান।
সামের বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে। পা থেকে চপ্পল খুলে হেলান দিয়ে রাখে দেয়ালের সাথে। তারপর খালি পায়ে হেঁটে বাবার শোবার ঘরের দিকে যায়। সেদিন ছিল শনিবার।
বিছানাটা গোছানো, তবে তার বাবা ঘরে ছিল না। সামেরের ভ্রু কুচকে যায়। গত রাতের কথা তার মনে পড়ে। অনেক রাত পর্যন্ত সে জেগেছিল। পরে বাবার কথায় সে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ঘুমাতে গিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, সে যদি নিজে থেকেই ঘুমাতে যায় তাতে প্রমাণ হবে যে সে অনেক বড় হয়ে গেছে। সত্যি বলতে কি, রাত নেমে আসার পর তার আর কিছু করার থাকে না। বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যায়, সামের তখন বাইরে যেতে ভয় পায়। তখন মনে হয় সে এখনো তেমন বড় হয়ে উঠতে পারে নি। দেয়াল ঘড়ির কাঁটাগুলো টিকটিক করে ঘুরছিল আর সামের তার বাবার ঘরের দরজায় চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। যদিও তার বাবা বাড়িতে নেই, তারপরও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভালো লাগছিল। দেয়ালে ঝোলানো শার্টগুলো, টেবিলের উপর রাখা চিরুনি, খাটের নিচে গুটিয়ে রাখা জায়নামাযসহ ঘরের সব কিছুই তাকে বাবার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। বিছানার উপর দেয়ালে তার বাবা-মা’র একটি যুগল ছবি ঝোলানো। তারা যেন তার দিকে চেয়েই হাসছেন। বাবার একটি হাত মায়ের কাঁধের উপর রাখা। এখন তার বাবার চুলের যে অবস্থা, তার চেয়ে ছবিতে তার চুল অনেক বেশি ঘন, কালো ও সুন্দর। অন্যদিকে সামের এখন তার বাবার গোঁফ পুরোটাই প্রায় ধূসর দেখতে পেলেও ছবিতে তা সম্পূর্ণই কালো।
এ সময় সামেরের পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারে তার প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। বাবার অনুপস্থিতি তার মনে অস্বস্তি ও চিন্তার সৃষ্টি করে। তবে আগে খিছু খেয়ে নিয়ে পেটটাকে শান্ত করি, তারপর বাবার কথা চিন্তা করা যাবেÑ ভাবে সে। লিভিং রুমে গিয়ে ফ্রিজ খুলে ভিতরে কি কি আছে দেখে। মাঝের শেলফে গোলাকার একটি প্লাস্টিকের পাত্র রাখা। সে পাত্রটি বের করে আনে। ফ্রিজে একটি বড় আরবি রুটিও ছিল। তা থেকে সে কিছুটা অংশ ছিঁড়ে নেয়। প্লাস্টিকের পাত্রে দই। দইয়ের সাথে রুটি খেতে শুরু করে সামের। তার বাবা সব সময় একটি থালায় দই নিতেন, তার উপরে পুদিনা পাতার সবুজ রঙের চাটনি ও জলপাইতেল সুন্দর করে সাজিয়ে দিতেন। সেই বাবা একদিন আগে মসজিদে যাবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে এখনো ফিরে আসেননি। আশ্চর্য! এমন তো কখনো হয় না, ভাবে সামের। সে মুহূর্তে একটা অশুভ চিন্তা তাকে কাঁপিয়ে দেয়। গতরাতে তার বাবা বাড়িতে ফেরেননি। সে রান্না ঘরে আলমারির উপর থেকে মিষ্টি নিয়ে খেয়েছিল। বাবা সবসময় তাকে একটির বেশি মিষ্টি খেতে নিষেধ করেন। কিন্তু সে খেয়েছিল দু’টি। বাবা বলেন, বেশি মিষ্টি খেলে দাঁত কালো হয়ে যাবে ও পড়ে যাবে। সামেরের মনে হয়- পাখিরা বোধ হয় তার দু’টি মিষ্টি খাওয়ার কথা বাবাকে বলে দিয়েছে, আর সে জন্যই তিনি সামেরের উপর রাগ করে বাড়ি আসছেন না। সামের জোর করে এ খারাপ চিন্তাটা মন থেকে দূর করে দিল। তার কান্না পাচ্ছিল, কিন্তু সে এখন কাঁদতে চাইছিল না। কারণ সে নিজেকে একজন বড় হয়ে ওঠা বালক হিসেবে দেখতে চায়। তারপরও তার মনে ভয়টা জুড়ে থাকে। তার হৃদস্পন্দনের গতি দ্রুত হয়। মনে হতে থাকে- যে কোন সময় বাবা এসে পড়বে আর সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
খেতে বসার সময় টিভির কথা মনে পড়ায় সামের বাটন টিপে তা চালু করার চেষ্টা করেছিল। তবে টিভি কিভাবে চালাতে হয় সেটা তার জানা ছিল না। বাটনগুলো তাকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। তারপরও সে চেষ্টা করতে থাকে। হঠাৎ একটি বিচ্ছিরি শব্দ করে টিভির স্ক্রিন সাদা হয়ে যায়। এতদিন এ রকম কিছু হলে তার বাবাই তা ঠিক করত। তার মনে পড়ে, এ রকম অবস্থায় বাবা সামনের দিকের বাটন টিপলে টিভি চালু হয়ে যেত। সেও তাই করে। ধীরে ধীরে টিভি প্রাণ ফিরে পায়।
সামের খাচ্ছিল আর টিভি দেখছিল। অবশ্য এ সময় কোন কার্টুন প্রচারিত হয় না। কয়েকজন টেকো ও গোঁফধারী লোক কি নিয়ে যেন আলোচনা করছিল। একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। মাঝে মাঝে একটি গান প্রচার ও দেশের পতাকা দেখানো হচ্ছিল। এটা যে সিরিয়ার পতাকা তা সে বাবার কাছে জেনেছিল। কিন্তু এ পতাকার অর্থ কি এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ, তা সে জানত না। তার বাবা একবার তাকে বলেছিল যে এ পতাকা দেশের সকল মানুষের, এ পতাকা বলে যে আমরা সবাই সিরীয় এবং সবার কাছেই এ পতাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামের তখন ব্যাপারটি বোঝেনি, গুরুত্বও দেয়নি। তার কাছে এ সব অর্থহীন মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন যেহেতু সে বড় হতে চলেছে সেহেতু সব বিষয়েই মনোযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাকে এখন বড়দের মতই কাজ করতে হবে। তাই, এ মুহূর্ত থেকেই বড়দের মত তার সব কিছু করার চেষ্টা শুরু হয়। প্রথম ধাপ হিসেবে তার বাবা যেভাবে টিভির দিকে তাকাত সেও ঠিক সেভাবেই তাকায়। এটা তার মধ্যে একটি বড় বালকের মত অনুভূতি সঞ্চার করে। কিন্তু উত্তেজনা, ব্যস্ততা ইত্যাদি বিষয়গুলো যে কি, তা এখনো সে বুঝে উঠতে পারেনি। এদিকে টিভিতে একব্যক্তি বলে চলেছিল যে- সব কিছু ভালো মত চলছে, তবে সন্ত্রাসীরা (এ কঠিন শব্দটি সে প্রথম শুনল। বাবা ফিরলে তার কাছ থেকে এর অর্থ জেনে নিতে হবে, সে ভাবে) দেশের বাইরে থেকে এসে ক্ষতি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। টিভিতে দেখানো হচ্ছিল, অনেক পুলিশ সিরিয়ার পতাকাসহ বিরাট বিরাট বাক্স বহন করছে এবং লোকজন সেগুলোর উপর চাল ছিটিয়ে দিচ্ছে। এক বেচারা পুলিশ কিছুতেই তার চোখ খুলে রাখতে পারছিল না। সামের ভয় পায় যে পুলিশটি হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় কি না, তাহলে অন্যদের কাঁধ থেকে বাক্সটা পড়ে যাবে। তবে তেমন কিছু ঘটে না। এদিকে টিভিতে এক টেকো এক গোঁফওয়ালাকে নিয়ে আলেচনায় ফিরে এসেছে। সে বলল, আমরা সবাই ভালো আছি, কারণ প্রেসিডেন্ট স্বয়ং আমাদের দিকে খেয়াল রেখেছেন। সামেরের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই খানিকটা দই তার শার্টে ছিটকে পড়ে। সামের উঠে দাঁড়ায়। বেসিনের কাছে গিয়ে শার্টের যেখানে দই পড়েছিল সে জায়গাটা ভালো করে ধুয়ে ফেলে। নিজের উপর খুব বিরক্ত হয় সে। যে কিনা খেতে বসে কাপড় নষ্ট করে ফেলে সে কিভাবে কি করবে! যাহোক, বড়দের ভাবনিয়ে সে টিভি দেখতে বসে। টিভিতে তখন দেখানো হচ্ছিল যে বয়সে একটু বড় কিছু ছেলেমেয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেছে এবং তারা তাকে ফুল উপহার দিচ্ছে। প্রেসিডেন্টকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। তার হাসিটাও ছিল আন্তরিক। মনে হচ্ছিল, এই ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে তিনি খুশি হয়েছেন। সামেরের হঠাৎ মনে হয়- প্রেসিডেন্টের সাথে তার সাক্ষাত হলে ভালোই হত। মজার এবং স্মরণীয় ব্যাপার হত সেটা। এ সময় টেলিভিশনে এক আলোচক বলছিলেন, প্রেসিডেন্ট সিরিয়াবাসীদের সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করবেন। এটা জেনে সামের বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করে। এমনও তো হতে পারে যে প্রেসিডেন্ট যদি জানতে পারেন সামের এখন বেশ বড় হয়ে গেছে তাহলে তিনি তাকে বড়দের উপযোগী কোন কাজের দায়িত্ব দিতে পারেন। তখন তার বাবা তাকে নিয়ে গর্ব বোধ করবে।
আচ্ছা, বাবা কোথায়? দরজা ও শূন্য লিভিং রুমের দিকে তার চোখ পড়ে। গতরাতে একটি মিষ্টি বেশি খাওয়ার কথা তার আবার মনে হয়। সে ভীত হয়ে পড়ে। তার বাবা মনে হয় এতে আসলেই খুব রেগে গেছে। তা না হলে আগে তো কোনোদিন বাবা তাকে এভাবে একাফেলে বাইরে থাকেনি! এ সময় তার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। রুটির যে টুকরোটি সে মুখে দিতে যাচ্ছিল সেটা ফেলে দেয় হাত থেকে। তার চোখ থেকে পানি নেমে আসে, ফুঁপিয়ে ফুুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে। তার বাবা তাকে ত্যাগ করেছে, আর মা একবছর আগে এক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এই বাড়িতে এখন তাকে একা থাকতে হবে। সে সোফার ভিতরের দিকে ঘুরে শুয়ে কুশনের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে।
এ অবস্থার মধ্যেই সামের ঘুমিয়ে গিয়েছিল। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সে জেগে ওঠে। তবে কি বাবা ফিরে এসেছে? এক লাফে সোফা ছেড়ে সে দরজার কাছে পৌঁছে যায়। আর তখনি তার মনে হয়, যে কড়া নাড়ছে সে যদি তার বাবা না হয়! অচেনা লোক হলে দরজা না খোলার জন্য বাবা তাকে বারবার নিষেধ করে দিয়েছে। সে অপেক্ষা করতে থাকে যদি কোন ভাবে যে কড়া নাড়ছে তার পরিচয় জানা যায়। এ সময় আবার কড়া নাড়ার শব্দ হয়। তারপর এক মহিলার গলা শোনা যায়-
: সামের? দরজা খোল। আমি তোমার চাচি। দরজাটা খোল বাবা!
চাচি এসেছে জানার পরও একটু সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তারপর আস্তে করে দরজার নব ঘুরিয়ে লক খুলে দেয়। ধীরে ধীরে দরজার পাল্লা খুলে তার চাচি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন। সামেরকে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তাকে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুমু খেতে থাকেন। সামের চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এ অবস্থায় কি করা উচিত তা সে বুঝতে পারছিল না। চাচির চোখে থেকে ঝরা পানি তার চিবুকে পড়ছিল। সে সাথে তিনি পরম স্নেহে তার মুখে ও মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন- আমি তোমাকে নিতে এসেছি। এখন তুমি আমার সাথে যাবে, কেমন?
তার কথা শুনে ঘাবড়ে যায় সামের। বলে- কিন্তু বাবা এসে আমাকে না পেলে খুব চিন্তা করবে।
সামেরের কথা শুনে চাচি কি যেন বিড়বিড় করে বলেন। তার কান্না আগের চেয়ে আরো প্রবল হয়। কিছুক্ষণ পর কান্নার বেগ কমে এলে চাচি বলেন- তোমার বাবা এক দূরের সফরে গেছেন বাবা। ফিরতে অনেক দেরি হবে। তিনি বলে গেছেন যে তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা যেন তোমাকে আমাদের কাছে নিয়ে রাখি। তুমি তো আমাদের ইয়োসরা ও আবদের সাথে খেলতে পছন্দ কর, তাই না? চল বাবা, আমরা যাই। তোমার শফিক চাচা বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করছেন।
সামেরের হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন চাচি। লক করেন দরজা।
সে রাতে বাড়িটিতে কোন আলো জ্বলে না। শোবার ঘরে ঘড়িটির টিকটিক শব্দ ছাড়া কোথাও প্রাণের কোন সাড়া ছিল না। শূন্য বাড়িতে শুধু দেয়ালে ঝোলানো ছবির সুশ্রী তরুণ দম্পতি অন্ধকারে হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে।