এক ফকিরের গল্প – আবুল হোসেন আজাদ

এক ফকিরের গল্প – আবুল হোসেন আজাদ

হযরত মুসা আলাইহিস সালাম-এর জমানায় মিশরে এক লোক বাস করতো। লোকটি ছিল বেশ ধনী। অর্থকড়ি ধনসম্পদের তার কোনো অভাব ছিল না। তবু লোকটি সব সময় মনমড়া হয়ে থাকতো। মুখের হাসিটুকু দেখা যেত না। তার কারণ একটাই- যার কারণে সে এত ধনসম্পত্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এমনিভাবে দিন কাটাতো। আসলে লোকটি ছিল নিঃসন্তান। একটা সন্তানের আশায় সে আল্লাহর নামে দানখয়রাত করতো। দানখয়রাত করতে করতে তার সম্পদের সবটুকু প্রায় শেষ করে ফেলেছিল। তবু তার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। তার একটি মাত্র চাওয়া একটি সন্তান।
হযরত মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর নবী। তিনি তুর পাহাড়ে উঠে আল্লাহর সাথে কথা বলতেন। একদিন মুসা আলাইহিস সালাম তুর পাহাড়ে যাচ্ছেন। পথের মধ্যে লোকটির সাথে দেখা। লোকটি মুসা আলাইহিস সালামকে বলল: হে মুসা! আপনি তো আল্লাহর নবী। আপনি আল্লাহকে জিজ্ঞেস করে আসবেন আমার ভাগ্যে কোনো সন্তান আছে কিনা? মুসা আলাইহিস সালাম পাহাড়ে চলে গেলেন। তিনি আল্লাহর কাছে লোকটির কথার জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে ওই লোকটির ভাগ্যে কোনো সন্তান নেই। তিনি পাহাড় থেকে ফিরে এসে দুঃখ ভরাক্রান্ত মনে লোকটিকে খবরটি জানিয়ে দিলেন। লোকটি আরো দুঃখ পেয়ে মুষড়ে পড়লো। সন্তান লাভের আশায় অনেক দানখয়রাত করেও তার ভাগ্যে সন্তানাদি নেই। এবার থেকে আর দানখয়রাত করে নিজেকে নিঃস্ব করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিলো।
অনেকটা দিন কেটে গেছে। একদিন লোকটির বাড়িতে এক ফকির এসে উপস্থিত হলো। লোকটিকে সামনে পেয়ে ফকির জানাল, আমি ক্ষুধার্ত, আমাকে কিছু খেতে দাও।
ফকিরের কথা না শুনে লোকটি তাকে অন্য কোথাও যেতে বলল। ফকিরটি আবারও তাকে কিছু খেতে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলো এবং লোকটিকে বলল তোমার একটি সন্তান হবে।
ফকিরের কথা শুনে লোকটি মুচকি হাসলো। মনে মনে ভাবল, আল্লাহ যেখানে মুসা নবীকে জানিয়ে দিয়েছেন আমার কোনো সন্তানাদী হবে না, সেখানে ফকিরের কথা হাস্যেকর ছাড়া আর কি।
ফকিরও ছিল নাছোড়বান্দা। সে আবারও বলল, আমাকে কিছু খেতে দাও, তোমার দু’টি সন্তান হবে।
লোকটি আবারও ফকিরকে চলে যেতে বলল। ফকিরও নাছোড়। আবারও কিছু খেতে চেয়ে বলল, তোমার তিনটি সন্তান হবে। এমনি করে চারটি সন্তানের কথা বলল। তারপর লোকটিকে সাতটি সন্তানের সুখবর দিলো।
ফকিরের কাকুতি মিনতিতে লোকটি এবার ফকিরকে পেটভর্তি করে খেতে দিলো। ফকির ক্ষুধা মিটিয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দুই হাত তুলে মোনাজাত করলো। আপনার এই বান্দা আমার ক্ষুদার সময় খেতে দিয়েছে। আপনি এই বান্দাকে সাতটি সন্তান দান করুন। দোয়া শেষে ফকির আপন মনে ইয়ারব, ইয়াইলাহি, ইয়াআল্লাহ বলতে বলতে যে পথে সে এসেছিল সেই পথে চলে গেল।
এই ঘটনার পর বহু বছর পার হয়ে গেছে। দেশ সফরে বেরিয়েছেন হযরত মুসা আলাইহিস সালাম। বহু দেশ সফর করে তিনি নিজ দেশে ফিরে এসেছেন। এসে সেই নিঃসন্তান লোকটির সাথে দেখা। মুসা আলাইহিস সালাম জানতে পারলেন এক এক করে সেই লোকটির আল্লাহপাক সাতটি সন্তান দান করেছেন। মুসা আলাইহিস সালামকে লোকটি তার বাড়িতে দাওয়াত দিলেন। লোকটি প্রতিটি সন্তানের জন্মের পরপরই মুসা আলাইহিস সালামকে স্মরন করতো। ভাবতো, তিনি নবী। নবীরা তো মিথ্যা কথা বলে না। মুসা আলাইহিস সালাম তবে কিভাবে তার সন্তানহীন ভাগ্যের কথা শোনালেন। হয়ত মুসা আলাইহিস সালাম হয়তো আল্লাহর কাছ থেকে ভুল শুনেছেন অথবা সে নিজে ভুল শুনতে পেয়েছে।
মুসা আলাইহিস সালাম লোকটির দাওয়াত গ্রহণ করে লোকটির বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। লোকটি তার সাত সন্তানের সাথে মুসা আলাইহিস সালামকে পরিচয় করিয়ে দিলো। মুসা আলাইহিস সালাম অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন কিভাবে এটা সম্ভব হলো? মুসা আলাইহিস সালামকে লোকটি বলল, আপনি হয়তো বিশ্বাস করতে পারছেন না। এরা সত্যিই আমার সন্তান। মুসা আলাইহিস সালাম আপনি তো বললেন আমার ভাগ্যে কোনো সন্তান নেই। আপনি কি আমাকে মিথ্যা বলে ভাওতা দেননি? আপনি আল্লাহকে আমার সন্তানদের কথা জিজ্ঞেস করুন।
লোকটির কথায় মুসা আলাইহিস সালাম লজ্জিত হয়ে চলে গেলেন। এরপর মুসা আলাইহিস সালাম একদিন আল্লাহর সাথে কথা বলার সময় লোকটির সাত সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমার কোন্ অপরাধে ওই লোকটির কাছে আমাকে অপমানিত করলেন? আপনি তো বলেছিলেন ঐ লোকটির ভাগ্যে কোনো সন্তান নেই। আপনি তো ভাগ্যের পরিবর্তন করে সাত সন্তান দান করছেন। আমি তার কাছে মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেছি। আমি বুঝতে পারলাম না এর রহস্যটি কি!
আল্লাহ পাক মুসা আলাইহিস সালামকে তাঁর প্রশ্নের জবাব দিলেন না। আল্লাহ মুসা আলাইহিস সালামকে বললেন, হে মুসা। আমার এক টুকরা মানুষের গোশতের প্রয়োজন। নিজের খুশিতে ইচ্ছে করে যতটুকু গোশত দিতে চায় আমার জন্য ততটুকু গোশত নিয়ে এসো। জোরজবরদস্তি কিংবা কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়।
মুসা আলাইহিস সালাম পাহাড় থেকে নেমে এসে মানুষের গোশতের সন্ধানে বের হলেন। তিনি দেশ-বিদেশে মানুষের কাছে কাছে গিয়ে বললেন, আমার আল্লাহ এক টুকরো মানুষের গোশত চেয়েছেন। তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছো আমাকে এক টুকরো গোশত তোমার গা থেকে কেটে দেবে? আমি আল্লাহর কাছে এই গোশত পৌঁছে দেবো।
মুসা আলাইহিস সালামের এই অনুরোধে কেউ সাড়া দিলো না। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে গেল।
মুসা আলাইহিস সালাম খুব হতাশ হয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি কি আল্লাহর কাছে তার এই অপারগতার জন্য লজ্জিত হবেন?
ঠিক সেই সময় এক ফকির মুসা আলাইহিস সালামের সামনে এসে দাঁড়ালো। সে মুসা আলাইহিস সালামকে বলল : কি হয়েছে আপনার? এত চিন্তামগ্ন ও হতাশাগ্রস্থ বলে মনে হচ্ছে কেন আপনাকে? আমাকে বলুন।
মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর ইচ্ছের কথা জানালেন। বললেন, আল্লাহ আমার কাছে মানুষের এক টুকরো গোশত চেয়েছেন। এত দেশ-বিদেশ ঘুরলাম কিন্তু এক টুকরো গোশত কেউ দিতে রাজি হলো না। আমি গোশত না নিয়ে কি করে আল্লাহর সামনে যাবো?
ফকির সাথে সাথে বলল, এটা একটা সমস্যা নাকি? আমিও মানুষ। যদিও পাগল বেশে দেশে দেশে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই। তোমার যেখান থেকে খুশি সেখান থেকে গোশত কেটে নিয়ে যাও। হাত পা পিঠ- যেখান থেকে তোমার ইচ্ছে হয় এবং যত বড় ইচ্ছে হয় তত বড় টুকরো নাও।
হযরত মুসা আলাইহিস সালাম যেন অকুলে কূল খুঁজে পেলেন। তিনি অন্ধকারে আশার আলো দেখতে পেলেন। তিনি ছুরি হাতে ফকিরের গোশত কাটতে অগ্রসর হয়ে থেমে গেলেন। কোন জায়গার গোশত তিনি কাটবেন? মুসা আলাইহিস সালাম ভাবলেন বরং আল্লাহকে জিজ্ঞেস করেই তিনি ফকিরের গোশত কাটবেন। খুশিতে তিনি তুর পাহাড়ে পৌঁছে আল্লাহকে গোশত পাওয়ার সুখবরটি দিলেন। আল্লাহকে তিনি জানালেন তাঁর শরীরের কোন অংশের গোশত পছন্দ। আল্লাহ মুসা আলাইহিস সালামকে বললেন, এত দেরি হলো কেন এক টুকরো গোশত আনতে?
মুসা আলাইহিস সালাম জানালেন এক টুকরো গোশতের সন্ধানে তিনি দেশ-বিদেশে, শহরে-বন্দরে জনপদে কত মানুষের কাছে গেছেন কিন্তু কেউ গোশত দিতে রাজি হয়নি। তাই এত দেরি। তবে একজন ফকির আপনার গোশত চাওয়ার কথা শোনামাত্রই রাজি হয়েছে।
আল্লাহ মুসা আলাইহিস সালামকে বললেন, তুমি কি মানুষ নও? তোমার শরীর থেকে গোশত আমাকে দিতে পারতে। কেন তা করোনি? তাহলে তো তোমার এত ঘোরাঘুরি খোঁজাখুঁজি করতে হতো না।
আল্লাহর প্রশ্ন শুনে মুসা আলাইহিস সালাম লজ্জিত হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন। আল্লাহ সেজদা থেকে মাথা তুলতে বললেন। মুসা আলাইহিস সালাম মাথা তুললে এই নিঃসন্তান লোকটির সাত সন্তান দানের কারণ জানালেন। তিনি বললেন, ওই ফকির যখন ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে ঐ নিঃসন্তান লোকটির কাছে খাবার প্রার্থনা করেছিল তখন খাবার পাওয়ার আশায় সে তাকে সাত সন্তান প্রাপ্তির কথা বলেছিল এবং আমার কাছে দোয়া করেছিল। যদি আমি তার দোয়া কবুল না করে নিঃসন্তান লোকটির ভাগ্য পরিবর্তন না করে দিতাম তবে ফকির তার কাছে মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হতো। আমি মানুষের গোশত চেয়েছি শোনামাত্র সে তার শরীরের গোশত দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু তুমি দাওনি। এখন তুমি বলো ওই ফকিরের দোয়া আমি কবুল করবো কিনা। আমি তার দোয়া কবুল করে তার ইজ্জত রক্ষা করেছি।
মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কথায় আবারও লজ্জিত হয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment