এক ফোঁটা বৃষ্টি -শরিফ আহমাদ

এক ফোঁটা বৃষ্টি -শরিফ আহমাদ

গল্পটা সত্যিই অদ্ভুত। আশ্চর্যজনক। ছুটির এক বিকালে নাশিদ ওর মামার কাছ থেকে গল্পটা শুনেছিল। মামা কয়েক দিন হলো গ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছেন। গল্প বলতে এবং লিখতে বেশ পটু তিনি। ছন্দ-সুরে কথাও বলতে পারেন। তিনি যখন গল্পের আসরে বসলেন নাশিদের সাথে আরও কজন যোগ দিলো। কবি মামা বলছেন-

অচিনপুরে একটি ছিল
ভারী দুষ্টু ছেলে,
লেখাপড়ার ধার ধারে না
বেড়ায় শুধু খেলে।

এখানেই কি শেষ? আরে না। ছেলেটা কারণে-অকারণে রাগ করতো। কেউ শাসনের সুরে কিছু বললে কান্না শুরু করতো। সে কি হাউমাউ কান্নার শব্দ! এমন ভঙি করতো যেন কেউ তাকে মেরেছে। বেপরোয়া ছেলেকে ঘিরে বাড়ির লোকজন পেরেশান। ভীষণ চিন্তিত তার সোনালি ভবিষৎ নিয়ে। হঠাৎ একদিন সে কি কারণে যেন কান্না থামিয়ে দিলো। আর কান্না করে না। কারো সাথে রাগ করে না। পড়তে যায় মক্তব শেষে স্কুলে। নামাজও পড়ে প্রতিদিন। সবাই তার এমন পরিবর্তনে অবাক। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একদিন দাদু তাকে ডেকে বললেন-

ভাইয়া তোমার পরিবর্তন
দেখে ভালো লাগে,
কিন্তু এটা কেমনে হলো
জানতে ইচ্ছা জাগে।

ছেলেটি বলল, অনেকে জানতে চেয়েছেন। কাউকে বলিনি। আচ্ছা দাদু তোমাকে বিশ্বাস করে বলছি। তুমি কাউকে বলবে না কিন্তু। দাদুর হ্যাঁ সূচক প্রতিশ্রুতি পেয়ে সে বলতে শুরু করলো, সেদিন আমরা দূর বাগানে গিয়েছি। কজন দলবেঁধে। জাম, লটকন, পেয়ারা ছিঁড়ে খাচ্ছিলাম গপগপ করে। এসময় একটি পাখির ছানা সামনে এসে পড়লো। এক্কেবারে মুখ থুবড়ে। ছানাটির একটি ডানা ভাঙা। ডান পায়ে আঘাত পাওয়া। রক্ত ঝরছে সেখান থেকে।
আমার বন্ধুরা ছানাটিকে ধরে ফেললো। ছানাটি সম্ভবত বাঁচবে না। তাই কেউ কেউ মেরে ফেলার কথা বলল। কেউ বলল সঙ্গে করে বাড়ি নিতে। কিন্তু আমি বাধা দিই। প্রায় জোর করে ছানাটিকে ছিনিয়ে নিই। রুমাল দিয়ে আহত ডানা বেঁধে দিই। পায়ে রক্ত বন্ধ করা পাতা লাগিয়ে দিই। তারপর পাশের একটা বটগাছের ডালে রেখে আসি। তারপর দুষ্টুমি করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। চারপাশে ঘন অন্ধকারের চাদর। কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। হালকা শিশির ঝরছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। হঠাৎ কোথা থেকে অদ্ভুত কি একটা আওয়াজ ভেসে আসছে। আবার গাছের ডাল ভাঙার মটমট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আতংকে আমার পশম দাঁড়িয়ে যায়। ভয়ে সবার কলজে শুকিয়ে যাবার জোগাড়। এমন আগে কখনো হয়নি। আগে তো আরও কতো রাত জঙ্গলে পার করেছি। এবারই অন্যরকম ঘটনা ঘটেছে। যাই হোক, কোনো রকমে ছানাটিকে গাছের মগডালে রেখে আয়াতুল কুরসী পড়তে পড়তে বাড়ি ফিরে আসি। শরীরের কাঁপুনি তখনও থামেনি। রাতে তড়িঘড়ি খেয়ে শুয়ে যাই। প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছড়ার কলি বলতে বলতে-

থাকবো না আর বদ্ধঘরে
দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে…।

হঠাৎ রাতে মিষ্টি একটা ডাক শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। প্রথমে ভয়ে চোখ খুলিনি। পরে আবার মধুর ডাক শুনে সাহস হলো। দু’ চোখ কচলাতে কচলাতে দেখলাম ঘরে আলোর বন্যা। এক মহিলার সাথে চাঁদের মতো ফুটফুটে একটি মেয়ে। ঠিক যেন পরী। যেন নয় আস্ত পরী।
হ্যাঁ আমরা পরীই। তোমাকে কৃতজ্ঞা জানাতে এসেছি।
মানে? ভয়ার্ত অস্ফুট কণ্ঠে বললাম। আপনারা আমার মনের কথা জানলেন কেমন করে? মহিলাটি সে প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সংক্ষেপে বলল, তুমি যে পাখির ছানার সেবা করেছো সে আসলে আমার এই কন্যা ছিল। দূর সীমানায় ঘুরতে গিয়ে সে ভয়ংকর পাজী এক জীনের পাল্লায় পড়েছিল। তোমরা তাকে আগলে রেখেছো। বিশেষ করে তুমি বাঁচিয়েছো। এতোক্ষণে আমার ভয় আরও কমে গেলো। তারা বলল তুমি যদি ভালো ছেলে হও, দুষ্টদের সঙ্গ ছাড়ো, তাহলে আমরা তোমার বন্ধু হবো। উপকারী বিশ্বস্ত বন্ধু। তাদের কথা দিতেই আমার এই পরিবর্তন।
নাতির কথা শুনে দাদু ভাবের দরিয়ায় ডুব দিলেন।

পরীরা যাবার সময় বন্ধুর জন্য পুরস্কার হিসাবে একটি গাছ রেখে যায়। বলে যায় রোপন করতে। যত্ন নিতে। গাছটির বৈশিষ্ট্য যখন যা খেতে চাইবে তাই পাবে। এই বলেই তারা গায়েব হয়ে গেলো। ছেলেটি সকালে বাড়ির পিছে জানালার কাছে গাছটি লাগালো।
প্রতিদিন সে গাছে পানি ঢেলে দেয়। খুব যত্ন নেয়। একদিন দুদিন করে সপ্তাহ ঘনিয়ে এলো। সাতদিন পরে ছেলেটা দেখলো গাছটা বড় হয়ে বেশ কটা ফুল ফুটেছে। কী যে মৌ মৌ মুগ্ধ করা সুবাস। এমন ফুল আর দেখেনি সে। আস্তে আস্তে গাছটি আরও বড় হয়। ছেলেটি গাছের ডাল ধরে নাড়া দিলে ইচ্ছা মতো ফল ঝরে। সে নিজে খুব খায়। আর পাড়ার বন্ধুদের বিলিয়ে দেয়। ছেলেটির আনন্দ আর ধরে না। নানা রকম খেয়ে খেয়ে সময় ভালই চলছিল। হঠাৎ একদিন ঐ দুষ্টু জীনটি প্রতিশোধ নিতে এলো। ছেলেটির অনেক উন্নতি দেখে সে রাগে মন্ত্র পড়ে ছেলেটির ক্ষতি করতে চাইলো। কিন্তু ছেলেটি ততদিনে মক্তবে গিয়ে সূরা-কেরাত অনেক শিখেছে। আয়ত্ত করেছে জরুরি মাসয়ালা-মাসায়েল। নামাজ ধরেছে ভালোভাবেই। নিয়মিত সকাল-সন্ধ্যা জিকির করে। তালিম শোনে। গুরুত্ব নিয়ে পড়ে সূরা ইয়াসিন। কেননা এরই মধ্যে সূরা ইয়াসিনের ফজিলতগুলো তার জানা হয়েছে।
-প্রত্যেক জিনিসের হৃদয় আছে। আর কুরআনুল কারীমের হৃদয় হলো সূরা ইয়াসীন। যে ব্যক্তি একবার সূরা ইয়াসীন পড়বে তার জন্য দশবার কুরআন খতমের সওয়াব লেখা হবে। (জামে তিরমিযী: হাদীস নং ২৮৮৭)
-যে ব্যক্তি দিনের শুরুতে সকালে সূরা ইয়াসীন পড়বে তার সমস্ত প্রয়োজন পূর্ণ হয়ে যাবে। সুনানে দারেমী: হাদীস নং ৩৪১৮)
-যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তার পূর্ববর্তী (সগীরা) গুনাহ মাফ করা হবে। সুতরাং তোমরা তোমাদের মুমূর্ষ (মৃত্যুশয্যায় শায়িত) ব্যক্তিদের নিকট এ সূরা পড়ো। (সুনানে বায়হাকী: হাদীস নং ২৪৫৮)
সে দৈনিক বেশি আমল করাতে তার উপর অনবরত আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি ঝরে। তাই দুষ্টু জীন তার কোনো ক্ষতি করতে পারলো না। আর সে মহাসুখে দিনকাল পার করতে থাকে।

গল্পটা শুনতে বেশ মজাই পেলো নাশিদ আর তার বন্ধুরা। কারো কাছে গল্পটা আজগুবি মনে হলো। কিন্তু নাশিদের ছোট বোন নওশীনের গল্পটা মনে ধরেছে। মামা চলে যেতেই সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলোÑ
পরের কাজে হেল্প করবে
গাছ লাগাবে খুব,
ফুলপরী কেউ বন্ধু হয়ে
দেখায় যদি রূপ।
বাসার ছাদে একটা ছোট্ট টবে সে ফুলগাছ লাগিয়ে দিলো। রোজ সকাল বিকেল নওশীন গাছের টবে কিছু পানি দেয়। দুদিন পর গাছটি তাজা হলো। বড়ো হলো। গাছের গতি দেখে সে কী খুশি! নাশিদ নিজে দেখে তো অবাক। তার চোখের সামনেই হনহন করে একটা গাছ বড় হচ্ছে। কী মারাত্মক! সে ভেবেই পাচ্ছিল না, এটা কিভাবে সম্ভব। টবে এতো ভালো গাছ হয় আগে দেখেনি সে। ভাইয়াকে অবাক হতে দেখে নওশীন দাঁত উল্টিয়ে বলল, দেখো গল্পের সেই পরী আসবে একদিন। বিভিন্ন মজার লজেন্স, চুইনগাম দিবে। আরও কতো কী?
বোনের কথায় নাশিদ খিল খিল করে হেসে ওঠে। বলে আরে পাগলি ! গল্প তো গল্পই। গল্প কি কোনোদিন সত্যি হয়?

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য