খরগোশের ফাঁদ- হুসাইন মুহাম্মাদ

খরগোশের ফাঁদ- হুসাইন মুহাম্মাদ

হঠাৎ স্বাভাবিক হয়ে গেছে সবকিছু। পুরো বনে নেমে এসেছে শান্তির আবেশ। হরিণ ছানাগুলো সব সময় আতঙ্কিত হয়ে থাকতো। তবে এখন ওরা নিশ্চিন্তে চলাফেরা করছে। এর কারণ হলো গত কয়েকদিন ধরে বনের রাজা সিংহ শিকারে বের হচ্ছে না।
বনটা ছিল বিশাল বড়। সেই তুলনায় পশুপাখি একেবারে কম। চারদিকে পানি আর পানি। এখানকার পশুরা অন্য বনে যেতে পারে না।
এবং অন্য বন থেকেও এখানে কোনো প্রাণী আসতে পারে না। তাই পুরো বনে চলে সিংহের একক আধিপত্য।
যখন তখন সে হামলে পড়ে পশুদের উপর।
সিংহের এমন নীরবতায় ছোটরা স্বস্তি পেলেও বড়দের উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। রাজার বিশ্বস্ত সহযোগী মন্ত্রী শিয়ালও এ ব্যাপারে কিছু জানে না।
একদিন বিকেলে নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলো মন্ত্রী শিয়াল। একটা গোঙানির শব্দে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো সে! কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো গোঙানিটা কোত্থেকে আসছে। ওই তো পাশের ঝোপ থেকে! খুব সাবধানে ঝোপের কাছে গেল। এরপর বলে উঠল, আরে রাজামশাই আপনি এখানে কী করছেন? অথচ আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি।
রাজা সিংহ বলল, জানতাম তুমি আমাকে খুঁজবে, আর আমিও তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।
একটু থেমে আবার বললো, দেখো বন্ধু শিয়াল! আজ আমি কয়েকদিন ধরে অসুস্থ। শিকারে বের হতে পারি না। ক্ষুধা ও অসুস্থতা আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে। আমি সবসময় আমার শিকারের ভাগ তোমাকে দিয়েছি। আজ তুমি আমার জন্য কিছু একটা করো!
সিংহের এমন কাকুতি-মিনতি শুনে তার প্রতি শিয়ালের কিছুটা দয়া হলো। কিন্তু পরক্ষণেই তার চোখে ভেসে উঠল, তার উপর সিংহের করা সকল অত্যাচারের ছবি। প্রতিশোধের একটা মোক্ষম সুযোগ খুঁজে পেল সে। অনেকটা টিপ্পনী কাটার সুরে বলল, সারা জীবন আমার সাথে চাকরের মতো আচরণ করলে, আর এখন বিপদে পড়ে বন্ধু ডাকছো? দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি মজা!
এ কথা বলেই শিয়াল দুর্বল ও ক্ষুধার্ত সিংহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। অনেক চেষ্টা করেও সবল শিয়ালের হাত থেকে বনের রাজা সিংহ বাঁচতে পারলো না। এরপর শিয়াল সিংহের মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দিলো। ব্যাপারটা কাউকে বুঝতে দিলো না।
পরের দিন সকালে দলে দলে পশুরা শিয়ালের কাছে আসতে লাগল। বাহিরে শোরগোল শুনে গুহা থেকে বেরিয়ে এলো সে। সবার প্রশ্ন একটাই, আমাদের রাজা মশাই কোথায়?
শিয়াল নিজেও জানে যদি সিংহের মৃত্যু সংবাদ সবাই জানতে পারে তাহলে তার রাজত্ব এখানেই শেষ। কেননা রাজার ক্ষমতা বলেই সে এতদিন সকলের উপর জোর খাটিয়েছে। তাই মন্ত্রী শিয়াল চতুরতার আশ্রয় নিয়ে বললো, প্রিয় ভাইয়েরা আমার! আমাদের রাজা মশাই খুবই অসুস্থ। তাই তিনি শিকারে বের হতে পারেন না। তিনি একটি গোপন গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন যেটা শুধু আমিই জানি। এখন রাজা মশাইকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব। যদি তিনি মারা যান, আর সেটা যদি আশপাশের রাজারা জানতে পারে, তাহলে তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সবাইকে শেষ করে দেবে। একমাত্র আমাদের রাজার ভয়েই তারা এই বনে আক্রমণ করতে পারে না।
তাই আমাদের উচিত রাজার খাদ্যের ব্যবস্থা করা। এবং তাকে দ্রুত সুস্থ করে তোলা।
শিয়ালের মিথ্যে কথাগুলো সবাই বিশ্বাস করলো। তারা সমস্বরে জিজ্ঞেস করলো, এখন আমরা কি করতে পারি?
শিয়াল মনে মনে ভাবলো বোকা পশুগুলো ফাঁদে পা দিয়েছে। এরপর চেঁচিয়ে বললো, যদি তোমরা প্রতিদিন একজন করে পশু রাজার খাদ্য হিসেবে পাঠাও, তবে সে তোমাদের উপর হামলা চালাবে না। তোমরাও নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারবে। তারপর উপস্থিত সকলেই বলে উঠল দারুণ প্রস্তাব! দারুণ প্রস্তাব!
এদিকে পশুদের সেই সভায় খরগোশদের প্রধান উপস্থিত ছিল না। সে এমন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে পেরে খুব রাগ হলো কিন্তু সে একা কী আর করতে পারবে? তাই সে অন্য পশুদের কিছুক্ষণ খুব বকাঝকা করে বলল, তোমাদের বলেছিলাম শিয়ালের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু সেই হিংস্র রাজার জন্য তোমাদের দরদ বেড়ে গেল। এতদিন শান্তিতে ছিলে ভালো লাগেনি! এখন বুঝবে মজা!
কে শোনে কার কথা? প্রতিদিন একজন করে পশু পাঠাতে লাগলো তারা। কে হবে রাজার খাদ্য? তা লটারির মাধ্যমে নির্বাচন করা হতো। যথাসময়ে শিয়াল এসে শিকার নিয়ে যেত। একটি গোপন গুহায় নিয়ে একাই পুরোটা সাবাড় করতো।
একদিন বিকেলে খরগোশদের প্রধান মন খারাপ করে নদীর পাড়ে বসে ছিল। হঠাৎ একটা কাঠবিড়ালী হাঁপাতে হাঁপাতে তার সামনে উপস্থিত হলো। খরগোশকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সে বললো, খরগোশ ভাই! খরগোশ ভাই! বনের পুব পাশে নদীর পাড়ে একটা সিংহের লাশ দেখেছি, আমার মনে হচ্ছে সেটা আমাদের রাজা মশাইয়ের লাশ। শিয়াল আমাদের এতদিন মিথ্যা বলে বোকা বানিয়েছে। আমার মনে হয় সে রাজাকে হত্যা করে আমাদের উপর তার শাসন চালাচ্ছে।
খরগোশ ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলো সত্যিই একটা লাশ পড়ে আছে। এরপর দুজনে লাশটাকে অনেক কষ্টে মাটিচাপা দিলো। খরগোশ, কাঠবিড়ালীকে বলল, ব্যপারটা যেন কেউ না জানে।
এরপর রাতেই সকল পশু প্রধানদের সাথে একটা গোপন বৈঠকে মিলিত হলো খরগোশ। তাদেরকে সবকিছু খুলে বলল। তারপর সকলে এই সিদ্ধান্তে নিলো যে শিয়ালকে কঠিন শাস্তি দিতে হবে।
পরেরদিন একদল ইঁদুর শিয়ালের গোপন আস্তানা খুঁজে বের করলো। বাবুই, চড়ুই ও কাটঠোকড়া মিলে গুহার চারদিকে খড়কুটো এনে ভরে দিল। তৈরি করল প্রবেশপথ আটকানোর জন্য শক্ত একটি দরজা। শিয়াল এসবের কিছুই বুঝতে পারলো না। সেদিন শিয়ালের খাদ্য হিসেবে খরগোশ নিজেই তৈরি হলো। পশু প্রধানরা গোপন গুহার আশপাশের ঝোপে লুকিয়ে ছিল। শিয়াল গুহায় প্রবেশ করতেই সবাই বেরিয়ে এলো। এদিকে খরগোশ হেঁচকা টানে শিয়ালের হাত থেকে ছুটে একদৌড়ে বাইরে চলে এলো। শিয়াল কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই বানর মিলে দরজা দিয়ে প্রবেশপথ শক্ত ভাবে আটকে দিলো।
এর আগে একটি দাঁড়কাক পাশের গ্রাম থেকে ম্যাচ ও কেরোসিন চুরি করে এনেছিল। খরগোশ সেই কেরোসিন, খড়কুটোর উপর ঢেলে তাতে আগুন লাগিয়ে দিল। কেরোসিন ও আগুন পেয়ে শুকনো খড়কুটো জ্বলে উঠল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় শিয়াল চেঁচাতে লাগল। প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে একসময় চুপসে গেল।
এরই মাঝে দেখা গেল পশুদের একটা বিশাল মিছিল। সবার একটাই দাবি- খরগোশ প্রধানকে বনের নতুন রাজা হিসেবে দেখতে চাই!

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য