শুয়ে পড়েন চাচীর কবরে
চাচা আবু তালিব নবীজিকে ভালোবাসতেন তার সন্তানের চে’ও বেশি! তার মায়ের শূন্যতা পূর্ণ করার চেষ্টা করেন চাচী ফাতেমা। আবু তালিবের ইন্তেকালের পর চাচী ফাতেমা মুসলমান হন। মুসলমানদের সঙ্গে হিজরত করেন পবিত্র মদীনায়।
শাবীব!
আমাদের নবীজি কত ভালোবাসতেন তার এই চাচীকে শুনবে?
একটি গল্প শোন! গল্প বলেছেন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু। বলেছেন; যখন আমার মা ফাতেমা মারা যান নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিজের জামা পরিয়ে দেন কাফন হিসেবে। তার জানাজা পড়ান। লাশ নামাবার আগে নিজে কবরে নামেন। কবরের চারদিকে হাত দিয়ে এমন ভাবে ইশারা করেনÑ যেন কবরটি ধরে প্রসারিত করছেন, বড় করছেন। তারপর লাশ নামিয়েছেন কবরে। লাশের পাশে সামান্য সময় নিজে শুয়ে থেকেছেন। তারপর যখন কবর থেকে উঠে আসেনÑ তাঁর দু’চোখ ভরা পানি!
ওমর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন; হে রাসূল! এর আগে কারো সঙ্গে তো আপনাকে এমন আচরণ করতে দেখিনি!
নবীজি বললেন ওমর! এই মহিলা ছিলেন আমার মমতাময়ী মায়ের মতো। আবু তালিব কাজকর্ম করতেন। ঘরে খাবার রান্না হতো। আমরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসতাম। সামান্যই খাবার। এই ফাতেমা কি করতেন জান? তার ভাগের খাবারটুকু তুলে রাখতেন। সবাই উঠে গেলে ওই খাবারটুকু আমাকে খাইয়ে দিতেন!
আমি আমার জামাটা তাকে পরিয়ে দিলামÑ তাকে যেন বেহেশতের পোশাক দান করা হয়। তার কবরে খানিক শুয়ে থাকলাম যেন তার কবরে আজাব না হয়।
[মাহমুদ তা’মা হালবী, নিসাউন হাওলার রাসূল, পৃষ্ঠা. ২১]
দেখলে বাবা, এই হলেন আমাদের নবীজি। জীবনে কোনদিন কারও উপকারের কথা ভুলেন নি! আমাদেরকেও হতে হবে তাঁর মতো!
বৃষ্টি হলো তাঁর উসিলায়
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখন চাচার ঘরে থাকেন।
চাচী আদর করেন।
গভীর মমতায় চোখে চোখে রাখেন উম্মে আইমান।
আবু তালিবও চোখের আড়াল হতে দেন না। ভীষণ আদর করেন। একটু ভয় ভয়ও করেন। বড় হয়ে বুঝবেÑ সন্তান যদি অনেক সুন্দর হয়, অনেক ভালো হয়Ñ তাকে নিয়ে মনের মধ্যে সব সময় ভয় ভয় লাগে।
একবার হলো কি জান, মককার বাইরে থেকে একগণক এলো। লাহাব তার নাম। শিশুর মুখ দেখে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানা কথা বলে। মককায় তার আসার খবর শুনে চারদিকে কলরব পড়ে যায়Ñ লাহাব এসেছে, লাহাব! মককার লোকেরা তাদের শিশুদের নিয়ে ছুটে আসে তার কাছে। শিশুদের ভবিষ্যৎ জানতে চায় তাদের বাবারা-মায়েরা। খবর পেয়ে আবু তালিবও আসেন।
তার হাতে মুহাম্মদ! প্রিয় মুহাম্মদ!!
লাহাব নবীজিকে একনজর দেখে। তারপর কী কাজে যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কাজ শেষ হতেই ‘ওই ছেলেটি, ওই ছেলেটি কোথায়’ বলে অস্থির হয়ে ওঠে। আবু তালিব লোকটির অতি আগ্রহ দেখে নবীজিকে লুকিয়ে ফেলেন। গণক লোকটি তখন বলেছিল; নাম হোক তোমাদের! এইমাত্র যে ছেলেটিকে দেখলামÑ ওকে আমার কাছে আন! খোদার কসম, ভবিষ্যতে ও অনেক বড় হবে।
[সীরাতে ইবনে হিশাম। ১:১৮]
এবার শোন বৃষ্টির কাহিনি!
মককায় প্রচণ্ড খরা পড়েছে। বৃষ্টি নেই। প্রচণ্ড রোদ। সূর্য যেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আগুন ঢালে। পাথরগুলো জ্বলন্ত কয়লার মতো আগুন ছড়ায় চারদিকে। গাছগাছালি গুল্মলতা পুড়ে ছাই। দুধের উট, ছাগল এবং দুম্বাগুলো ঘাসের অভাবে উপোসে পড়েছে। চারদিকে মরি মরি অবস্থা। মককায় এখন সকলের মুরুব্বি আবু তালিব। মককার লোকেরা তার কাছে এলেন। বললেন তাদের বিপদের কথা। সবার কণ্ঠে অস্থিরতাÑ আবু তালিব! বৃষ্টির অভাবে আমাদের পশুগুলো মরে যাচ্ছে। খরার আগুনে সব পুড়ে যাচ্ছে। আপনি একটা কিছু করুন। আবু তালিব প্রিয় মুহাম্মদকে করে হাজির হলেন হেরেমে! পবিত্র কাবার প্রাঙ্গনে। তারপর নবীজিকে আদর করে ধরে তার পিঠখানা কাবা শরীফের দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তারপর তাকে বাহুতে ধরে প্রার্থনা করলেন।
পুরো আকাশ শূন্য।
কোথাও কোনো মেঘের চিহ্ন নেই।
নবীজিকে উসিলা করে মুনাজাত করার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে ছুটে আসতে লাগলো ছোট ছোট মেঘ। দল বাঁধতে লাগল। ছেয়ে গেল মককার আকাশ। শুরু হল বৃষ্টি। প্রবল বর্ষণ। তেতে ওঠা মরুভূমির বুকের উপর দিয়ে বইতে লাগল নদী। শহর পল্লী সবখানে। তাপিত মককা মুহূর্তে শীতল।
[আররাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা. ৬৪; সীরাতুল মুস্তফা- ১: ৮৮]
দেখলে বাবা, এই হলো আমাদের নবীজির বরকত।
নুয়ে পড়ল গাছ
শাবীব!
তুমি শুনেছো, সেকালে মককার লোকেরা ছিল ব্যবসায়ী।
বড় হয়ে তাদের ব্যবসার কথা পাক কুরআনেই পড়বে।
আমাদের নবীজির চাচা আবু তালিবও ছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যবসার জন্যে দেশ-বিদেশে সফর করতেন। দল বেঁধে বাণিজ্যে যেতেন। আমাদের নবীজির বয়স তখন বারবছর। এই সময়ের ঘটনা। মককার কুরাইশের ব্যবসায়ীগণ সিরিয়া যাচ্ছেন। চাচা আবু তালিবও যাচ্ছেন। দূরের পথ। এখনকার মতো বাস-ট্রেন কিংবা বিমানের সফর তো নয়। উটের পিঠে করে পাড়ি দিতে হবে বিশাল মরুভূমি। সূর্যপোড়া পথঘাট। বাতাসে আগুনের নিঃশ্বাস। সঙ্গে শুকনো খাবার। মশকে রাখা সামান্য পানি। কষ্ট আর কষ্ট। আবু তালিব চাচ্ছিলেন নাÑ এই কষ্টের পথে প্রিয় মুহাম্মদকে সঙ্গে নিতে।
কাফেলা প্রস্তুত!
প্রস্তুত আবু তালিব।
যখন বের হবেন দেখলেন প্রিয় মুহাম্মদের মুখখানা ভীষণ মলিন। চাচাজান চলে যাচ্ছেন তাঁকে একা ফেলে! অসীম মমতামাখা ওই মলিন মুখ উপেক্ষা করতে পারলেন না। বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
না মুহাম্মদ! তোমাকে একা ফেলে যাব না।
চলো, তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে।
সিরিয়ার সীমান্ত অঞ্চল।
ওইখানে একটি শহর আছেÑ নাম বুসরা।
ওই শহরে একটি গির্জা ছিল। খ্রিস্টানদের এবাদতখানা। ওই গির্জায় একজন পাদ্রী থাকত। তার নাম বাহীরা। ওই গির্জার পাশ দিয়ে চলে গেছে সড়ক। ওই সড়ক পথেই বরাবর আসা-যাওয়া করেন মককার ব্যবসায়ীগণ। পাদ্রী থাকেন তার গির্জায়। কে গেলেন এই পথে আর কে এলেনÑ এসব নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই।
এ যাত্রায় ঘটল ভিন্ন ঘটনা।
তার গির্জার কাছে এবং সড়কের পাশে তাঁবু পেতেছেন মককার ব্যবসায়ীগণ। পাদ্রী এসে সবাইকে খাওয়ার-দাওয়াত দেয়। সবাই তো অবাক!
পাদ্রী খাবার রান্না করে নিয়ে আসে সেখানে। পাশেই একটি বাদাম গাছ। পেস্তা বাদাম। বিরাট। ছায়াপ্রসারিত। ওই গাছের নিচে সবাইকে খেতে ডাকেন। সবাই এসে আসন গ্রহণ করে।
: আর কেউ কি বাকি আছে? পাদ্রী জানতে চায়।
: হ্যাঁ, একজন ছেলে আছে আমাদের সঙ্গে। একজন বলল!
: তাকেও ডাকুন!
একজন উঠে গিয়ে ডেকে আনে নবীজিকে!
তাঁকে দেখামাত্র অনেকটা চেঁচিয়ে উঠে পাদ্রীÑ ইনি হচ্ছেন সমগ্র জাহানের সরদার! জগতসমূহের প্রতিপালকের রাসূল! আল্লাহ তায়ালা তাকে সারাজাহানের রহমত করে পাঠাবেন।
: তুমি কিভাবে জানলে এসব? জিজ্ঞেস করলেন মককার ব্যবসায়ীগণ!
দেখ, তোমরা যখন এখানে আসছিলে তখন দেখেছিÑ পথের প্রতিটি গাছ ও পাথর তাঁকে সেজদা করছে। গাছ ও পাথর নবী ছাড়া কাউকে সেজদা করে না। আরও দেখেছিÑ তোমরা যখন আসছিলেÑ তখন মেঘ তাকে ছায়া দিয়ে ফিরছিল। তারপর যখন তোমারা এখানে এসে বসেছ গাছের সবটা ছায়া তোমরা দখল করে নিয়েছ। বসার জন্যে আর কোথাও ছায়া নেই। তিনি যখন এসে বসলেনÑ গাছ তাঁর দিকে ঝুকে ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে। এই যে দেখ তোমরা! সবাই লক্ষ্য করলÑ সত্যিই তো গাছটি কাত হয়ে মুহাম্মদকে ছায়া দিচ্ছে। তাছাড়া আমি তাকে নবুওয়তের মোহর দেখেও চিনেছি! আপেলের মতো চিহ্ন। তার কাঁধের হাড়ের নিচে।
সবাই আশ্চর্য! সবাই অবাক!
: আচ্ছা, এই কিশোরের অভিভাবককে? পাদ্রী বলল!
: আমি! আবু তালেব বললেন।
: কি হয় আপনার?
: পুত্র!
: না, হতে পারে না। তার পিতা বেঁচে থাকার কথা না।
: আমার ভাতিজা। সে যখন মায়ের গর্ভে তখনই তার বাবা মারা যায়।
: তাই বলুন।
শুনুন, আপনি এখনই আপনার ভাতিজাকে নিয়ে মককায় চলে যান! আর ইহুদিদের থেকে সাবধান থাকবেন। তারা যদি চিনতে পারে অনেক ক্ষতি করবে। আপনার এই ভাতিজা অনেক বড় হবে।
ও, ভাবছো পাদ্রী এত কথা জানল কি করে?
বড় হয়ে পড়বেÑ আমাদের নবীজির আগে দুনিয়াতে আরও অনেক নবী- রাসূল এসেছিলেন। আমাদের নবীজিকে আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন পবিত্র কুরআন। আগের নবীগণকেও ওই রকম বিভিন্ন কিতাব দিয়েছিলেন। ওসব কিতাবে আমাদের নবীজি সম্পর্কে অনেক কথা লেখা ছিল। বাহীরা ছিলেন শিক্ষিত খ্রিস্টান। তাদের ধর্মের বইপত্র পড়ে ওসব কথা জেনেছেন!
[তিরমিযী, হাদীস- ৩৬২০; ইবনে হিশাম; ১: ১০৮- ১১০]
সেই গাছ এখনো সবুজ
কী মজার কথা শুনছো বাবা! ওই গাছটি এখনো জীবিত। একেবারে সবুজ তার পাতাপল্লব। চারদিক ছড়ানো তার শীতল ছায়া। শোনা কথা নয়Ñ দেখা ঘটনা! মাওলানা তকী উসমানীর নাম তো তুমি জানোই। আমার টেবিলে তার লেখা কত বই দেখ। বড় হয়ে পড়বে। আজকের পৃথিবীর একজন সেরা আলেম তিনি। গল্পটি তার। ২০১০ সালে তিনি জর্দান সফরে যান। তখন জর্দানের শাহজাদা গাজী তাকে সংবাদ দেনÑ আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চাচার সঙ্গে সিরিয়া যাওয়ার পথে বাহীরা পাদ্রীর সঙ্গে যে সাক্ষাৎ হয়েছিল একটি গাছের ছায়ায়Ñ ওই গাছটি আমরা আবিষ্কার করেছি। আপনি চাইলে দেখতে যেতে পারেন! তুমি হলে তো লাফিয়ে ওঠতে তাই না! কী আনন্দ!
মাওলানা তকী ওসমানী বুড়ো মানুষ। লাভ দেন নি খুশিতে। তবে এক কথায় রাজিÑ হ্যাঁ অবশ্যই যাবো। তারপর শোন তার মুখেইÑ সময় ঠিক করা ছিল আগেই। শাহজাদা গাজী আমাদেরকে সামরিক এয়ারপোর্টে নিয়ে যান। সেখানে আগে থেকেই একটি বড় হেলিকপ্টার রেডি ছিল। দশজন যাত্রী বসা যায় এমন। আমরা হেলিকপ্টারে উঠে বসি। রাজধানী আম্মান থেকে আমাদেরকে নিয়ে উড়াল দেয় হেলিকপ্টার। ছুটে চলে উত্তর-পূর্ব দিকে। পঞ্চাশ মিনিট ওড়ার পর মাটিতে নেমে আসি আমরা। পুরো এলাকা বিজন সাহারা। ধু ধু মরু। কোথাও কোথাও ছোট ছোট শুকনো টিলা। কোথাও কোথাও মাটি জড়িয়ে পড়ে আছে সামান্য ঝোপঝাড়। মরুভূমির তাপে ঝলসে গেছে সব। দিগন্ত বিস্তৃত পোড়া বালুর মাঝে দূর থেকে দেখা যায়Ñ ওই যে সবুজ গাছটি। প্রাণছড়ানো টগবগে সবুজ।
এই সেই গাছ যার শীতল ছায়ায় একদা তাশরীফ রেখেছিলেন আমাদের প্রিয়তম নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। শত শত বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত বিজন সাহারার মাঝে একাকী দাঁড়িয়ে আছে একটি জীবন্ত বৃক্ষ। আর সেই বৃক্ষটির সামান্য দূরেই একটি দালানের ধ্বংসাবশেষ নজরে পড়েÑ হয়তো এটাই সেই পাদ্রী বাহীরার গির্জা। এর আশেপাশে সেই প্রাচীনকাল থেকেই যাযাবরদের বসবাস। ওই যাযাবরদের কথাÑ আমরা আমাদের বাপ দাদাদের কাছে থেকে বরাবর শুনে এসেছিÑ এই গাছের নিচেই আমাদের নবীজি বসেছিলেন। আমাদের মনে হয়েছে, এটা কোনো সাধারণ গাছ নয়। কারণ শত শত বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত কোথাও কোন গাছ নেই। পানি পৌঁছার কোন পথও নেই। এ গাছের নিচেই পাদ্রী বাহীরা আমাদের নবীজিকে ‘শেষ নবী’ হিসেবে চিনতে পেরেছিলÑ তাই আল্লাহ তায়ালা অলৌকিকভাবে গাছটি বাঁচিয়ে রেখেছেন।
এটি একটি পেস্তা গাছ। শাহজাদা গাজী জানালেনÑ এখনও এই গাছে পেস্তা ধরে এবং তিনি খেয়েছেন। গাছের ছায়া এমনিতেই প্রাণ ছুঁয়ে যায়। যখন কল্পনা করিÑ এইখানে এই ছায়ায় একদা উপবেশন করেছিলেন আমাদের হৃদয়ের বাদশা পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামÑ তখন তার মধুময়তা কি বলে বোঝানো যায়?
আমরা কিছুক্ষণ বসে থাকি এই অলৌকিক বৃক্ষের ছায়ায়। আসর নামাজ পড়ি সেখানেই। দোয়া করি। ফিরে আসি আলো-ঝলমল আম্বানে। মন পড়ে থাকে ওই সবুজ বৃক্ষের শেকড়ে।
[সফর দর সফর: পৃ. ৩৬৫- ৩৭৩]
হিলফুল ফুযুল
শোনো, তখনকার মককা ছিল এক গরম শহর। মেলা হতো। কবিতা উৎসব হতো। দুঃসাহসী ও মূর্খ বলে কথায় কথায় লড়াই হতো। লড়াই করতে গিয়ে হজের পবিত্র মৌসুমকেও কলঙ্কিত করতো।
আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন বিশবছর তখন এক বড় লড়াই বাঁধে। একদিকে কুরাইশ অন্যদিকে কায়েস। ভীষণ লড়াই হয়েছিল। চাচাদের চাপাচাপিতে পরম শান্ত চরিত্রের ‘মুহাম্মদ’ কেও মাঝেমধ্যে যেতে হয়েছে যুদ্ধে। নবীজি তখন তাদেরকে তীর কুড়িয়ে এনে দিতেন। এই যুদ্ধে অনেক মানুষ মারা যায়। অবশেষে সন্ধি হয় এবং শান্ত হয় মককা।
ওই সময়ের কথা।
জুবায়েদ গোত্রের একলোক এসছে মককায়। এসেছে বাণিজ্য করতে। আস ইবনে ওয়াইল তার সব পণ্য কিনে নেয়। কিন্তু টাকা আর দেয় না। বেচারা বিদেশি মানুষ কী করবে? মককায় যাদের সঙ্গে তাদের সন্ধি আছে তাদের কাছে যায়। তারা এসে সুপারিশ করে। কিন্তু আস শক্ত। মন তার গলে না। বেচারা জুবায়দি তখন মককার বিখ্যাত পাহাড় আবু কুবায়মের পিঠে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর চিৎকার করে কবিতা আবৃতি করতে থাকে। কবিতায় তার অসহায়ত্বের কথা বলে। এটা ছিল সেকালে মককার রেওয়াজ। ওইভাবে কেউ পাহাড়ের পিঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলে সব মানুষ পাহাড়ের পায়ের কাছে এসে সমবেত হতো। মন দিয়ে তার কথা শোনত। ওই বিদেশির ডাক শুনে সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন নবীজির চাচা জুবায়ের ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। তার কথা শুনে তিনি খুব দুঃখ পান। একজন বিদেশির প্রতি এই অবিচার এটা হতে পারে না। তিনি তখন মককার বিশিষ্ট লোকদেরকে নিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে যাদয়ানের বাড়িতে যান। আব্দুল্লাহ বয়সে প্রবীণ এবং সকলের কাছে সম্মানিত। তিনি তখন সকলের জন্যে খাবার রান্না করেন। সবাই মিলে সদ্যসমাপ্ত যুদ্ধের কথা বলেন। অত্যাচারিত বিদেশির কথা বলেন। কথা হয়। শলা-পরামর্শ হয়। সবশেষ সবাই মিলে চুক্তি করেনÑ দেশি-বিদেশি যে কেউ মককায় অত্যাচারিত হবে আমরা সবাই তার সঙ্গে থাকব। তাকে তার অধিকার আদায় করে দেব। হ্যাঁ, আস থেকে সঙ্গে সঙ্গে ওই জুবায়দির পাওনা টাকা আদায় করেন তারা।
ইতিহাসে এই চুক্তিকে ‘হিলফুল ফুজুল’ বলে। আমাদের নবীজিও এই সন্ধি চুক্তিতে অংশ নেন। তাছাড়া তিনি নবী হওয়ার পর বলেছেনÑ সেদিন আব্দুল্লাহ ইবনে জাদয়ানের বাড়িতে আমিও ছিলাম সন্ধিতে। সেদিনকার সেই অংশগ্রহণের মূল্য আমার কাছে আরবের লাল উট এর চে’ও বেশি। এই ইসলামের কালে আজও যদি কেউ আমাকে ডাকে ওই ধরনের সন্ধি করার জন্যেÑ আমিও তার ডাকে সাড়া দেব।
[ইবনে হিশাম, ১: ১১০-১১১; আররাহীকুল মাখতুম, ৬৫-৬৬পৃ; সিরাতুল মুস্তফা, ১:৯৪-৯৫]
হ্যাঁ, বাবা! আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম ছিলেন মানুষের বন্ধু। তিনি ভালোবাসতেন মানুষকে। পাশে থাকতেন মানুষের। বিপদে বন্ধু ছিলেন চেনা-অচেনা সকলের। হিলফুল ফুজুলে অংশগ্রহণ তাঁর জীবনের একটি বড় ঘটনা। কেউ কারও প্রতি জুলুম করলে তিনি সবসময় মজলুমের পক্ষে থাকতেন। এই যারা জালেম তারা তাঁকে ভয় করত আর যারা মজলুম তারা সকলে ভালোবাসতো তাঁকে।