বণিক বেশে প্রিয় নবী
আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার ছেলে। বেড়ে উঠছেন বনেদি এই শহরে। এখানকার আলো বাতাস ধুলোবালি হৈচৈ দেনদরবার গায়ে মেখেই দিনে দিনে যুবক হয়ে উঠছেন তিনি। এখানকার ছাগলের পাল সারি সারি উট আর দলবাঁধা দুম্বা। যেমন তার জীবনজুড়ে জীবন্তÑ এখানকার স্বচ্ছল লোকদের দেশ-বিদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যও তার রক্তে-মাংসে নিহিত। দাদা আবদুল মুত্তালিব ছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী চাচা আবু তালিবও। আর মনে আছে নিশ্চয়Ñ বাণিজ্য করে ফিরে আসার পথে ইন্তেকাল করেছিলেন তার বাবা আবদুল্লাহ। সুতরাং বলতে পার- আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। পরে চাচা আবু তালিব বুড়ো হয়ে গেলে নিজেও ব্যবসা করেছেন মন দিয়ে।
শাবীব!
কথা কি জান!
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অলস ছিলেন না। অলসদের তিনি পছন্দও করতেন না। যখন একদম শিশু ছিলেন- দুধ মায়ের কাছে- তখনও দুধ ভাই-বোনদের সঙ্গে ছাগল রাখতে যেতেন। যখন কিশোর নবীজি মক্কায় থাকেন- তখন পয়সার বিনিময়ে রাখালী করেছেন। যখন যুবক হয়েছেন হাত দিয়েছেন ব্যবসায়। যখন তিনি যুবক হন চারদিকে তাঁর কী সুনাম! মক্কায় তাঁর বংশ সবচে সম্মানীত। আর তিনি অই গোত্রে সবচে ভালো ছেলে। বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজখবর রাখেন। তাঁর চরিত্রের কথা মানুষের মুখে মুখে। বিশ্বস্ত, সত্যবাদী, ধৈর্যশীল এবং ব্যক্তিত্ববান বলে সবাই তাঁর প্রশংসা করে। কোন ঝগড়া বিবাদে নেই। সবাই তাকে আল-আমীন বলে ডাকে। আল-আমীন মানে বিশ্বস্ত। সবাই যাকে মন থেকে বিশ্বাস করেন। তিনিই আল-আমীন!
হ্যাঁ, বাবা! ব্যবসা-বাণিজ্যে সফল হতে হলে মানুষ তাকে বিশ্বাস করতে হয়। সবার চোখে বিশ্বাসভাজন বলেই অতিদ্রুত ব্যবসাতেও সুনাম করেছিলেন তিনি।
তাঁর নিজের তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। তিনি ছিলেন কর্মঠ এবং বিশ্বস্ত। তাই তাঁর সঙ্গে ব্যবসায় অংশিদার হতে চাইতো অনেকেই। সায়েব ইবনে আবু সায়েব মাখজুমি ছিলেন মক্কার ব্যবসায়ী। নবীজি তাঁর সঙ্গে অংশিদার হয়ে ব্যবসা করেছেন। মক্কা বিজয়ের দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হলে এই বলে অভিনন্দন জানান : আমার ভাইও অংশিদার, স্বাগতম! ইবনে মাজা, হাদীস : ২২৮৭ : আর রাহিকুল মাখতুম, পৃ. ৬৬ : সীরাতুল মুস্তফা : ১ :৯৫-৯৬
হ্যাঁ- এভাবে যার সঙ্গেই ব্যবসা করেছেন- সে-ই ছিলো মুগ্ধ! তাঁর আরেক ব্যবসায়ী বন্ধু কায়েস ইবনে শায়েব। বলেছেন: ইসলাম পূর্বযুগে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর আমি একসঙ্গে ব্যবসা করেছি। চমৎকার পার্টনার ছিলেন তিনি। কোন বিষয়ে ঝগড়া করতেন না। তর্ক করতেন না। কায়েসের মতো আববদুল্লাহ ইবনে সায়েবও ব্যবসা করেছেন নবীজির সঙ্গে। আবদুল্লাহ মুসলমান হন হিজরতের পর। মদীনায় আগমনের পর নবীজি জানতে চানÑ আপনি কি আমাকে চিনেছেন?
আবদুল্লাহ তখন আবেগে উথলে উঠেনÑ কেন চিনবো না? আপনি-আমি এক সঙ্গে ব্যবসা করেছি। আপনি ছিলেন আমার উত্তম শরীক। কোন কথায় গড়িমশি করতেন না, কোন বিষয়ে বিবাদ করতেন না!
(ইসাবার সূত্রে- সীরাতুল মুস্তফা ১:৯৬)
দেখলে বাবা, যার সঙ্গে ব্যবসা করেছেন সেই মুগ্ধ। তাঁর সততা, সরলতা, ভদ্রতা, কোমলতা সবাইকে স্পর্শ করতো। সবাই ওই কথা বলতো, বন্ধুর কাছে বলতো, বন্ধুদের বৈঠকে বলতো। শুননিÑ চাঁদকে কেউ লুকিয়ে রাখতে পারে না। সত্য চাঁদের চে’ও সুন্দর। সত্য চাঁদের চেয়ে উজ্জ্বল এবং উঁচু। দেখনিÑ চাঁদ হৈচৈ করে না। জ্বালায় না, পোড়ায় না! মিষ্টি মিষ্টি আলোতে চারদিক ভরে দেয়। সবাই তাঁর আলো নেয়ার জন্য অধির হয়ে থাকে। আমাদের নবীজির সততার আলোও পূর্ণিমার জোসনার মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো মক্কার ঘরে ঘরে! এই মক্কায় ছিলেন এক মহিয়সি নারী- নাম তাঁর খাদীজা রাদিআল্লাহু আনহা। মক্কায় সম্মান ও সম্পদে অনন্যা তিনি। শীর্ষ ধনী। শ্রেষ্ট অভিজাত। ব্যবসা বুঝেন টাকা নেই- এমন পুরুষদের দিয়ে ব্যবসা চালাতেন তিনি। বিনিময়ে তাদেরকে লাভের একটা অংশ দিতেন। হযরত খাদীজা নবীজির কথা জানতে পারেন। তাঁর সততা, সত্যতা, সরলতা ও দক্ষতার কথা শুনে তিনিও মুগ্ধ। তাঁর আখলাক চরিত্রের কথাও বাদ যায় না। ভাবেন, আমার বিশাল ব্যবসার জন্য তো এমন মানুষই চাই। নবীজিকে আমন্ত্রণ জানান। কথা বলেন মুখোমুখি বসে। প্রস্তাব করেন: আপনি কি আমার পূঁজি নিয়ে সিরিয়া যাবেন ; বাণিজ্য করতে?
: আমি অন্য পার্টনারদের যতখানি লাভ দিতাম আপনাকে তারচে‘ বেশি দেব।
: কেন যাব না? যাব!
: আপনার সেবার জন্য আমার এই ক্রীতদাস সঙ্গে থাকবে। নাম মাইসারা!
: ভালো প্রস্তাব।
যথাসময়ে বাণিজ্যের আয়োজন সম্পন্ন। খাদীজার বিশাল বাণিজ্যের ভার বুঝে নেন মক্কার শ্রেষ্ঠ সন্তান মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বেরিয়ে পড়েন পথে। সঙ্গে গোলাম মাইসারা। তারা যাবেন সিরিয়া। আমাদের নবীজির বয়স তখন পঁচিশ বছর।
( ইবনে হিশাম ১. ১১২ )
চলছে কাফেলা সিরিয়ার পথে
সারি সারি উট। কাফেলা এসে নোঙর করে এক গির্জার পাশে। কাছেই একটি গাছ। নবীজি বসেন গাছের ছায়ায়। গির্জা থেকে বেরিয়ে আসেন যাজক। মায়সারাকে জিজ্ঞেস করেনÑ কে এই পূরুষ?
: সমভ্রান্ত কুরাইশ বংশের ছেলে!
: এই বৃক্ষের ছায়ায় নবী ছাড়া কেউ কখনো আসন গ্রহণ করেননি!
যাজাক জোর দিয়ে বলেনÑ নিশ্চয় ইনি সর্বশেষ নবী!
: হায় আল্লাহ! মনে মনে অবাক মায়সারা।
মক্কা থেকে অনেকগুলো উট বোঝাই পণ্য নিয়ে এসেছেন। নবীজি বেচাকেনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দেখতে দেখতে সূর্য মাথার উপর উঠে যায়। মাইসারা দেখে কি- যখনই দুপুর হয়, রোদচটে যায়- দুজন ফেরেশতা নবীজির মাথার উপর ছায়া দিয়ে ফিরে। ফলে কখনোই তাকে রোদে পায় না। কি মজার দৃশ্য না! নবীজি চলেছেন উটের পিঠে। আকাশে রাগি সূর্য। তাপ ঝরছে। সকলের দেহ, বাহন, পোশাক পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু নবীজির মাথার উপর শীতল ছায়া। ছায়া দিয়ে রেখেছেন ফেরেশতা। মায়সারা অবাক তাকিয়ে থাকে।
মজার কথা কি জানো! নবীজি যখন সিরিয়া থেকে বাণিজ্য করে ফিরছেন হযরত খাদীজা তখন তাঁর বাড়ির দো‘তলায় বসেছিলেন সখিদের নিয়ে। হঠাৎ দেখেন মক্কার বণিকদল ফিরছেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখেন- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম উটের উপর বসা। আর দুজন ফেরেশতা তাঁকে ছায়া দিয়ে রেখেছে। খাদীজা সঙ্গে সঙ্গে সখিদের দেখানÑ দেখ দেখ, মুহাম্মদের মাথার উপর কি অদ্ভুত ছায়া! মায়সারা ফিরে এসে সব বলে হযরত খাদীজাকে। গীর্জার পাদ্রীর ঘটনাটিও বলে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্ত! স্থির। ধীর পায়ে নেমে আসেন। হিসেব বুঝিয়ে দেন খাদীজাকে। যা পূঁজি দিয়েছিলেন লাভ হয়েছে তাঁর সমান! বিশাল মুনাফা। এত মুনাফা এত বরকত এর আগে আর হয়নি। হযরত খাদীজাও তাকে দ্বিগুণ অর্থ দিয়ে পুরস্কৃত করেন।
প্রিয় নবীজীর প্রথম বিয়ে
মায়সারা ছিল হযরত খাদীজার আস্থাভাজন।
ফিরে আসার পর খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে আরো অনেক কথাই জিজ্ঞেস করেন খাদীজা তাকে। সেও ছিল খাদীজার ভক্ত। আর অল্প ক‘দিনের সফরে ভক্তিতে গলে গিয়েছিল নবীজীর প্রতি। সে মন খুলে বলে নবীজির মধুর চরিত্রের কথা। নিরহংকার সাদামাটা আচরণের কথা বলে। ভদ্রতা উদারতা ও ঔদার্যের কথা বলে। তাঁর আত্মপ্রত্যয়, নিজের মতের প্রতি আস্থা এবং কথার সত্যতা ও লেনদেনের সততার কথা তো বলেই। খাদীজা তার কথা শোনেন আর ভাবেন। ভাবতে ভাবতে যেন তিনি তাঁর হারানো আশ্রয় খুজে পান!
শোন বাবা!
হযরত খাদীজা ছিলেন আমাদের নবীজির মতোই এক অনুপম নারী। কী রূপ আর কি গুণÑসব বিচারেই তুলনাহীনা। আখলাক-চরিত্র ছিল ফুলের মত কোমল ও ঝর্ণার পানির মতো নির্মল টলটলে। মানুষ তাকে তাহেরা- পবিত্র বলে ডাকত। ধনী যে ছিলেন তা তো জানোই। মক্কার ব্যবসায়ীগণ যখন বাণিজ্যে যেতেন তখন সবার পূঁজি হত যতটাকা- একা খাদীজার পূঁজি হত তত। ভেবেছ, কতবড় ধনবতী ! হযরত খাদীজা বিয়ে করেছিলেন এই মক্কাতেই। দুইজন স্বামীর সংসার করেছেন তিনি। প্রথমজন আতিক ইবনে আয়েয। আর দ্বিতীয়জন আবু হালা মালিক। তাদের মৃত্যুর পর মক্কার অনেক ধনবান সমভ্রান্ত নেতা তাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। তিনি রাজি হননি। তিনি তাঁর মনের মত কাউকে পাচ্ছিলেন না। এবার মায়সারার কাছে নবীজি সম্পর্কে এত কিছু শোনার পর তাঁর মন বদলে যায়। অনেক ভাবেন!
এত সুন্দর…
এত গুণ…
এমন লাজুক…
এমন বিনয়ী…
এমন কর্মদক্ষ…
আবার এইটুকু অহংকার নেই। ক্রীতদাসের সঙ্গেও না। তাঁর ওপর ফেরেশতারা ছায়া দিয়ে ফিরে…
তাঁর মনটা ভরে যায় শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় এবং আস্থায়। কাছের বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনাব্বিহকে বলেন মনের কথা। বলেন, তুমি তাঁর সঙ্গে কথা বলে দেখো তিনি কি বলেন! নিজের বিয়ের কথা তো নিজে বলা যায় না। নাসিফা গিয়ে নবীজির সঙ্গে কথা বলেন। নবীজি ভেবে দেখেন- খাদীজা তাঁর যোগ্য পাত্রী। এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। বললেনÑ নাফিসা, আমি আমার চাচাদের সঙ্গে কথা বলি। দেখি, তাঁরা কি বলেন। কথা বললেন চাচাদের সঙ্গে। এ প্রস্তাব শুনে সকলেই আনন্দিত। সবার এক কথা- খাদীজার মত মেয়ে এই তল্লাটে নেই।
হযরত খাদীজার বাবা নেই।
চাচা আমর ইবনে আসাদের কাছে তাঁরা প্রস্তাব নিয়ে যান। এই প্রস্তাবে চাচা ও আনন্দে আটখানা। মুহাম্মদের মত ছেলে এই মক্কা আগে কখনো দেখেনি। এমন ছেলে হাতছাড়া করা যায় না। সিরিয়া থেকে ফেরার দুইমাস পঁচিশদিন পর অনুষ্ঠিত হয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রথম বিয়ে। বিয়েতে উভয় গোত্রের প্রধান প্রধান ব্যক্তি এবং আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিলেন। নবীজির সঙ্গে ছিলেন- প্রিয় চাচা হামযা এবং অভিভাবক চাচা আবু তালিব। বিয়ের মজলিসের চাচা আবু তালিব সংক্ষেপে খুতবা দিয়েছিলেন। ওই খুতবায় তিনি কি বলেছিলেন জানো?
বলেছিলেনÑ আম্মাবাদ! মুহাম্মদ এমন ছেলে- কুরাইশের যে কোন যুবককে সম্মান শ্রেষ্টত্ব মর্যাদা ও বুদ্ধিমত্বায় তাঁর সঙ্গে তুলনা করা হবে- কেউ তাঁর সমতুল্য হবে না। হ্যাঁ, তাঁর টাকা-পয়সা কম। টাকা-পয়সা তো ক্ষণস্থায়ী ছায়া, কর্জধনের মত- শীঘ্রই মালিকের হাতে ফিরে যাবে। মুহাম্মাদ- খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদের প্রতি আগ্রহী, খাদীজাও আগ্রহী মুহাম্মদের প্রতি। নবীজি সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম-এর বয়স তখন পঁচিশ। আর খাদীজার বয়স চল্লিশ। অবশ্য ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ বলেছেনÑ হযরত খাদীজার বয়স ছিলো তখন আঠাশ বছর। নবীজি বিয়ের সময় তাকে মোহর দিয়েছিলেন বিশটি উট। বিশটি উট! সেকালের বিচারে বিরাট সম্পদ।
(ইবনে হিসাম ১. ১১২-১১৩ সীরাতুল মুস্তফা ১. ১০১/১১২, ৫. হামিদুল্লাহ, মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ: পৃ. ১৬-১৮, নিসাউল হাওলার রাসূল পৃ. ২৬)
হযরত খাদীজার গর্ভেই জন্ম লাভ করেন নবীজির তিনপুত্র কাশেম, তাহের, তায়্যিব এবং চার কন্যা- যায়নাব, রোকাইয়্যা, উম্মে কুলসুম এবং ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহু। নবীজির বড়ছেলে কাসেম। তাই কাজের লোকেরা তাকে আবুল কাসেম- কাসেমের বাবা বলে ডাকতেন। নবীজির এই তিনপুত্র শিশুবয়সে মারা যান- তখনও আমাদের নবীজি নবী হননি।
ও- পুত্র ইব্রাহিমের কথা ভাবছো? ইব্রাহিমের মা মারিয়া কিবতিয়া। ইব্রাহিম জন্মগ্রহণ করেন পবিত্র মদীনায়। তিনিও শিশুবয়েসে ইন্তেকাল করেন।
(ইবনে হিসাম ১ : ১১৩)
বলতে পারো, নবীজির কোন পুত্রসন্তানই বড় হননি। পৃথিবীর এই সুন্দর বাগানে ফুল হয়ে ফুটেছিলেন তারা। টাটকা ফুলের সৌরভ বিলিয়ে আকুল করেছেন জগতের শ্রেষ্ঠ মা-বাবার মন বুক। সুভাস ছড়াতে ছড়াতে লুকিয়ে পড়েছেন মমতাময় কুদরতের কোলে। ওই ফুল এখনো গন্ধ ছড়ায় আমাদের ইতিহাসে। ওই ফুল এখনও খুশবো বিলায় বেহেশতের বাগিচায়।
কাবার গল্প
কাবা! এই পৃথিবীর প্রথম ঘর এবং শ্রেষ্ঠঘর।
এই ঘরের অনেক গল্প। এই ঘরের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের নবীজির জীবন, মিশে আছে আমাদের প্রিয় ধর্মের কথা। আমরা যারা মুসলমান সবাই ভালোবাসি এই ঘরকে। তৌফিক হলেই ছুটে যাই হজ করতে, ওমরা করতে।
শাবীব !
তুমি কি জান- প্রথম এই ঘর কে বানিয়েছিলেন?
বেশ মজার গল্প এবং গর্বের কথা।
জান তো হযরত আদম আলাইহিস সালাম হলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ। তাই তাকে আমরা আদি পিতা বলি। তিনি সকল মানুষের পিতা। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সৃষ্টি করে প্রথম থাকতে দিয়েছিলেন বেহেশতে।
তিনি থাকতেন বেহেশতে। তখনও আর কোন মানুষ সৃষ্টি করেননি আল্লাহ। সেখানে তাঁর সঙ্গেী নূরের তৈরি ফেরেস্তা। অনেক ফেরেস্তা। তাদের সঙ্গে থাকেন। তাদের মতো থাকেন। ওইখানে একটি ঘর আছে। আল্লাহর ঘর। বাইতুল মামুর। ফেরেশতাগণ দলবেঁধে ওই ঘর তাওয়াফ করেন। আল্লাহর প্রশংসা করেন। মানুষ আদম দেখেন ওই সুন্দর দৃশ্য। ফেরেশতাদের দলবাঁধা ঘূর্ণন তাঁর ভালোলাগে। ফেরেশতাদের পবিত্র কণ্ঠে আল্লাহর পবিত্রতার বর্ণনা ভালো লাগে। ওই ভালোলাগার ভেতর দিয়ে কেটে যায় কত্তো বছর।
তারপর তিনি চলে এলেন দুনিয়ায়। আমাদের এই পৃথিবীতে। প্রথম মানুষ তিনি। এখানে এসে দেখেন নীল আকাশ। সারি সারি পাহাড়। বিশাল উত্তাল সমুদ্র। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণা দেখেন। ঝর্ণার ছন্দ দেখেন। দেখেন নির্মল মিষ্টি পানির নদী। নদীর স্রোত। নৃত্যময় ঢেউ। দেখেন চোখ জুড়ানো সবুজ। নদীর মাছ আর বনের পাখি দেখেন। এত কিছু দেখেও কোথায় যেন তাঁর অতৃপ্তি! তিনি কি যেন হারিয়ে ফেলেছেন।
একদিন প্রার্থনা করলেনÑ হে আল্লাহ! আমি তো এখানে ফেরেশতাদের কথা শুনতে পাই না। আকাশে যেমন শোনতাম। তখন আল্লাহ তায়ালা বললেন; আদম! তুমি আমার জন্য একটি ঘর তৈরি কর। আকাশের ফেরেশতাগণ আমার ঘরকে ঘিরে যেভাবে আমার প্রশংসা করে- তুমিও তেমনি করবে।
(ইবনে হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী -৬ : ৪০)
এই হলো কাবা- বাইতুল্লাহ!
পিতা আদম আলাইহিস সালাম আল্লাহ তায়ালার কাছে ওইরকমের একটা ঘর চেয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা পরে হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালামকে পাঠিয়েছেন। জায়গা দেখিয়ে দিয়ে ঘর বানাতে বলেছেন, বাবা আদম ঘর বানিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেনÑ তাওয়াফ করো। তাওয়াফ করেছেন। ফেরেশতা এসে বলেছেনÑ মানুষের কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে এটাই প্রথম ঘর। আর তুমি প্রথম মানুষ!
(ইবনে হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী -৬ : ৪৩৬)
এর অনেক পরে…
নূহ আলাইহিস সালাম এলেন নবী হয়ে। মানুষকে বললেন আল্লাহর কথা। আল্লাহ এক। তাঁর কোন শরীক নেই। সকলে মিলে তাঁর এবাদত কর। জীবন মরণের তিনিই মালিক। মানুষ তাঁর কথা শুনল না। শোনল শয়তানের কথা। আল্লাহ তখন খুব রাগ হলেন। বন্যার পানিতে সকল পাপীকে ডুবিয়ে মারলেন। সে এক ভয়াবহ বন্যা। সারা পৃথিবী ডুবে একাকার। ওই বন্যায় নষ্ট হয়ে যায় মানুষের সব বাড়ি- ঘর। নষ্ট হয়ে যায় আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ। কিন্তু আল্লাহর ঘর না থাকলে কি হয়? আল্লাহকে চেনার জন্যে, তাঁর এবাদত এর জন্যে ওই ঘর চাই! তখন আল্লাহ তায়ালা কি করলেন জানো? হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে আদেশ করলেনÑ ওই ঘরটা আবার বানাতে। ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ঠিক করলেন কাবা ঘর আবার বানাবেন। তিনি থাকতেন সিরিয়ায়। পুত্র ইসমাঈল থাকতেন মক্কায়। আল্লাহর আদেশ পেয়ে মক্কায় এসে পুত্রকে নিয়ে বসলেন। কথা বললেন। ঠিক করলেনÑ পিতা-পুত্র মিলে কাবাঘর নতুন করে বানাবেন। কিন্তু কিভাবে বানাবেন আল্লাহর ঘর। ওই জায়গাই যে তাঁরা চেনেন না।
এবার শোন সেই মজার গল্প !
হযরত ইব্রাহিম চিন্তিত। ভাবছেন। তিনি মক্কায়Ñ যেখানে কাবা ঘর ঠিক সেখানেই। কারণ সেখানেই জমজম কূপের পাশে থাকেন ইসমাইল ও তাঁর মা হাজেরা! ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দেখলেন কি! তাঁর ঠিক মাথার উপর একখণ্ড মেঘের মতো তাঁর মধ্যে একটি মাথার মতÑ কথা বলছে। আদেশের সুরে বলছেÑ ইবরাহীম! আমার ঠিক ছায়া বরাবর ঘর তৈরি করো। বেশিও না, কমও না। পিতা-পুত্র মিলে তখন পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে নির্মাণ করতে শুরু করেন কাবাঘর। নয় হাত উঁচু। ছাদ নেই। একটি দরজা। দরজার কাছেইÑ কাবার ভেতরে একটি কূপ। আল্লাহর নামে নজরানা পেশ করার জন্য ওই কূপ।
(ফতহুল বারী- ৬ :৪৩৬/৪৪১)
হযরত ইবরাহিম ও ইসমাইল আলাইহিস সালাম-এর হাতে নির্মিত এই কাবাঘর ওইভাবে দাঁড়ানো ছিলো নবীজির দাদার আমল পর্যন্ত! আমাদের নবীজি বেড়ে উঠেছেন ওই কাবার ছায়ায়।