ড্রইং খাতায় গ্রামের ছবি দেখে দেখে বড় হওয়া। ছবি আঁকাও হয়েছে বহুবার। আদর্শ গ্রাম বলতে তখন বুঝতাম, একটা কুঁড়েঘর, এক নিঃশব্দ নদী বয়ে যাবে তার সামনে দিয়ে। একটা গাছ ঠিক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে সেই বাড়ির পিছন দিকে। গ্রামের মেয়ে-বউরা কাঁখে করে কলসি নিয়ে যাতায়াত করবে। মাঠে মাঠে কৃষকের সবুজ ফসল। উদাস দুপুরে রাখালের বাঁশির সুর। আরো কত কী, কিন্তু এর বাইরেও যে গ্রাম থাকতে পারে, তার খবর আমরা ক-জন রেখেছি?
গ্রাম শান্ত, গ্রাম সুন্দর, কিন্তু গ্রাম আবার আজব হয় কি করে? এমন প্রশ্ন তোমার মনে আসতেই পারে তাই না বন্ধু! তাহলে আস কিছু আজব গাঁয়ের আজব খবর পড়ি:
জাম্বুর গ্রাম
গুজরাতের জাম্বুর গ্রাম। এই গ্রামটি ভারতে অবস্থিত। এই গ্রামকে বলা হয় ভারতের আফ্রিকা। কেন জানো? আফ্রিকার বান্টু উপজাতির মানুষ এখানে ভর্তি। এদের বলা হয় সিদ্দি আদিবাসী। আফ্রিকার বংশোদ্ভূত হলেও এই সিদ্দিদের ভাষা কিন্তু গুজরাতি! কিন্তু চালচলন সব আফ্রিকানদের মতো। এরা সমাজ সংস্কৃতি একেবারেই বুঝে না। এই গ্রামে বাইরে থেকে মানুষজন খুব একটা আসে না। এদের সাথে মিশেও খুব কম।
মেঘালয়ে কংথং
মেঘালয়ে কংথং বলে একটা গ্রাম আছে। সে অর্থে একেও আজব গাঁ বলতে পারো। শুনলে অবাক হবে, এই গ্রামের মানুষদের কারও কোনও নাম নেই। না লিখিত। না কথিত। তাহলে? কীভাবে একে অন্যকে ডাকেন? বিস্ময়জনকভাবে, এখানে প্রতিজনের জন্য আলাদা করে শিসের সুর রয়েছে৷ আর সেই শিস দিয়েই একে অন্যকে ডাকে। মানে, সুর দিয়েই একে অন্যকে চিনে নেয়। কী সুন্দর না!
এই মেঘালয়তেই রয়েছে মাওলিননং নামে একটি ছোট্ট গ্রাম। চেনা-চেনা লাগছে, কি এই গ্রামের নাম হতে পারে। কারণ, কিছুদিন আগে, ভারত তো বটেই, এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এই মাওলিননং। আর তা হবে না-ইবা কেন? এখানে প্রতিদিন ভোর ছ-টার সময়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে উঠেই গোটা গ্রামকে পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়!
ঘুমন্ত মানুষদের গ্রাম:
কাজাখস্তানের এক আজব গ্রাম কালাচি। এই গ্রামের বাসিন্দারা হঠাৎ করেই ঘুমিয়ে পড়েন। সেই ঘুম একদিন, দুইদিন এমনকি কারো কারো একসপ্তাহ পরে গিয়েও ভাঙে। শিশু থেকে বুড়ো সকলের মধ্যেই একই প্রবণতা দেখা যায়। কেউ কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছেন, কেউবা কথা বলতে বলতে! আর ঘুম থেকে ওঠার পর কারোই কিছু মনেও থাকে না। তারা সব ভুলে যান। শুধু মানুষ নয়, ওই গ্রামের পশু-পাখিরাও নাকি দীর্ঘ ঘুমে তলিয়ে যায়। গবেষকদের প্রাথমিক ধারণা, নিকটস্থ ইউরেনিয়াম খনির প্রভাব পড়েছে গ্রামবাসীদের উপর। প্রচুর পরিমাণে কার্বন মনোক্সাইড সৃষ্টি হওয়ার ফলে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এ কারণেই যখন-তখন ঘুমিয়ে পড়েন কালাচি গ্রামের বাসিন্দারা।
মাটি নয়, দড়ি দিয়ে হাঁটে যারা:
গ্রেটার ককাস পর্বতের কোলে গড়ে উঠেছে রাশিয়ার ছোট্ট গ্রাম সোভক্রা-১। এ গ্রামের সক্ষম ব্যক্তিরা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে পারেন। তাই একে ‘টাইটরোপ ভিলেজ’ও বলা হয়। এটি একটি শতাব্দীর প্রাচীন প্রথা। কীভাবে এই প্রথা শুরু হল তা নিয়ে প্রচলিত একটি কাহিনিও রয়েছে। পাশের পাহাড়ি গ্রামে বিয়ে করতে সোভক্রা গ্রামের পুরুষদের ট্রেকিং করে যেতে হত। এর থেকে মুক্তি পেতে পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দড়ি টাঙাতেন। পরে সেই দড়ি বেয়েই তারা যাতায়াত করা শুরু করেন। তারপর থেকে দড়ি বেয়েই তারা হাঁটতে শুরু করে। এখন ওই গ্রামের স্কুলের শিশুদের ‘টাইটরোপ ওয়াকিং’ শেখানো হয়।
কোডিনহি গ্রাম
ভারতের কেরালাতে রয়েছে কোডিনহি গ্রাম। এই গ্রামের ব্যাপার-স্যাপারই আবার অন্যরকম। কী জানি কি কারণে, এখানে কথায়-কথায় যমজ সন্তানের জন্ম হয়। বললে বিশ্বাস করবে না, এই মুহূর্তে কোডিনাহিতে ৫০০ জোড়া যমজ সন্তান রয়েছে! কিন্তু এর পিছনে রহস্যই-বা কী, তা কেউ জানে না। সবই মহান আল্লাহর কুদরত। যারা জমজ সন্তান নিতে চায় তারা অনেকে এই গ্রামে আসে- কিছু দিন বসবাস করে। বিজ্ঞানিরা অনেক চেষ্টা করছে এর অন্য কোন রহস্য আছে কি না তা বের করতে। এখনও পর্যন্ত তার হদিশ পাওয়া যায়নি। তবে দেশ-বিদেশ থেকে কম বিজ্ঞানী ঘুরে যাননি এই গ্রাম থেকে। কিন্তু আল্লাহর কুদরত বিজ্ঞানীরা ধরবে কেমনে- এতো চিন্তারও বাইরে।
মাত্তুর গ্রাম
আজকের দিনে সংস্কৃতকে যারা লুপ্তপ্রায় ভাষা বলেন, তারা একবার এসে ঘুরে যেতে পারেন, কর্নাটকের মাত্তুর গ্রাম থেকে। কেন জানেন? এই গ্রামের মানুষজন নিজেদের মধ্যে সংস্কৃত ভাষায় কথা বলেন।
এই কর্নাটকেরই ভদ্রপুর গ্রাম আদিবাসীদের নামের জন্য বিখ্যাত। এখানে কেউ জন্মালে কমন নাউনে তার নামকরণ করা হয়৷ অনেক সময়ে সেলিব্রিটিদের নামেও করা হয় নামকরণ। এখানে কারোর নাম র্জজ বুস, জন ক্যানেডি। আবার কারোর নাম ফেসবুক, টুইটার। বুঝুন কাণ্ড!
শ্বেতপাল গ্রাম
মহারাষ্ট্রে শ্বেতপাল গ্রাম আবার অন্য কারণে অনন্য। এই গ্রামে মানুষ সাপকে ভয় পায় না। বরং সাপের সঙ্গে তাদের দারুণ বন্ধুত্ব। এমনকি কিং কোবরার মতো ভয়ানক সাপও এখানকার ঘর-গেরস্থালিতে এসে আত্মীয়-কুটুম্বের মতো ঘুরে বেড়ায়। এদেশের গ্রামেগঞ্জে যেখানে সাপের কামড়ে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়, সেখানে এই গ্রামে একজন মানুষও সাপের কামড়ে মারা গিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। অবিশ্বাস্য!
ঝিনঝুং গ্রাম
আফ্রিকার ঝিনঝুং গ্রামের মানুষরা খুবই অদ্ভুত। এরা ঘরে থাকে না। আর অবাক করা কথা হলো এদের কোন ঘরবাড়িই নেই। এরা বনে জঙ্গলে বাস করে। গাছের লতা-পাতাই এদের পোশাক। ফলমুল এদের খাবার- এদের চরিত্র বুনো প্রাণীদের মতো। গাছে ঘুমায়- জঙ্গলে ঘুরে। শিক্ষা-সংস্কৃতি বলে কিছু নেই এদের। যদিও রাষ্ট্রিয়ভাবে চেষ্টা চলছে কিন্তু ওদেরকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া যাচ্ছে না। জঙ্গলই তাদের গ্রাম। দূর থেকে দেখা যায় তারা সব সময় হাসি-খুশি, প্রাণবন্ত। তবে কখনো কখনো তাদেরকে কাঁদতেও দেখা গেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা তাদের মাঝে সব অনুভূতিই আছে। তাদেরকে ধীরে ধীরে আমাদের সংস্কৃতিতে আনা সম্ভব।
কত জায়গা আমরা এখন ঘুরে বেড়াই, তাই না? থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকা। আর, তারপর ফেসবুকে পোস্ট করি৷ কিন্তু কী অদ্ভুত, এই গ্রামগুলোতে ঘুরে আসার কথা ভাবি না আমরা৷ কখনও। কোনওদিন।