জীবন কিছু সময়ের সমষ্টি মাত্র। কিন্তু এ স্বল্প সময়েরই সঠিক মূল্যায়ন ও যথাযথ ব্যবহারের সব অসাধ্যকেই সাধন করা সম্ভব- শুধু নবুওয়াত ও প্রভুত্ব ছাড়া। সাধনার মহাসাগর পাড়িদিয়ে সফলতার বন্দরে তরী ভিড়ানো সম্ভব। সংগ্রামী এ জীবনের সবচে’ মূল্যবান সময়- ছাত্রজীবন। সফলতার সোপান। অসম্ভবকে জয় করার মোক্ষম সুযোগ। কিন্তু এ সিঁড়িতেই হোঁচট খায় অনেকে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে খুব কমজনেই।
কিছু শিক্ষার্থী তো থাকে এমন, যারা সময়ের স্রোতধারায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। কালের ঘূর্ণিপাকে নিজেকে হারিয়ে খুঁজে। ভুলে যায় আপন পরিচয়, দায়িত্ব ও কর্তব্য। তারা সময়ের ভগ্নাংশগুলোর অবমূল্যায়ন করে। জীবনের বাগডোরকে ইচ্ছার হাতে ছেড়ে দেয়। ফলে জীবনে তাদের থাকে না কোন কৃতিত্ব। তারা থেকে যায় যশ-খ্যাতিহীন। একটা সময় তারা কালের অন্ধকারে হারিয়ে যায়। অনন্তকালের জন্য।
আবার কিছু শিক্ষার্থী এরকম, যারা নিজ সত্তাকে চিনতে পারে। নিজের মাঝে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভার কথা জানতে পারে। বুঝতে পারে। কিন্তু উচ্চ মানসিকতা, অদম্য সাহস, দৃঢ় পদক্ষেপ ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং রাহবারে হায়াতের নির্দেশনা না থাকায় তারা হেরে যায় জীবনযুদ্ধে। বিলীন হয়ে যায় মহাকালের গর্ভে। সমাজে তাদের কোন অবদান থাকে না। রেখে যেতে পারে না তারা কোন যোগ্যতার সাক্ষর।
আর কিছু শিক্ষার্থী থাকে স্বপ্নজয়ী। লক্ষ্যপানে অবিচল। তারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ভালবাসে। টার্গেট নিয়ে ছুটে চলে। তাদের জীবনে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে না। যেন নিয়ম আর তারা, এক গাছের দুই শাখা। তাদের কাজ-কর্মে, চলায়-বলায় আদর্শের ছাপ ফুটে ওঠে। চরিত্রে তার সত্যের দীপশিখা জ্বলে। তারা কিতাবের মাঝে মিশে যায়। ইলম অন্বেষণের ডুব-সাঁতারে নিজেকে হারায়। যেন কিতাব আর তারা, দেহ আর আত্মা।
তারা অসীম বল, বুদ্ধিদীপ্ত পদচারণা, সুচিন্তিত উদ্দেশ্য নিয়ে জীবনের বন্ধুর পথ পাড়ি দেয় এবং অভিজ্ঞ জীবন-নাবিকের পথ-নির্দেশনা মেনে চলে। তাই তারা জীবন-সংগ্রামে জয়ী হয়। সব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে সাধনার হিমালয়ের উচ্চশৃঙ্গে দাঁড়িয়ে বিজয়ের হাসি হাসে।
তারা ইলমের সন্ধানে ব্রতী হয়। সাধনার এ পৃথিবীতে তারাই আদর্শ; উৎকর্ষ আইডল। পূর্ণিমার রাতে জোসনা বিলানো চাঁদটা যেমন ঝিকিমিকি করে, মানুষের মাঝে ঐশীজ্ঞানের আলো ফেরি করে তারা ইলমের আকাশে ঝলমল করে! পৃথিবী তাদের দেখে জীবনের মূল্য বুঝে। মানুষ তাদের কর্ম দেখে উপলব্ধি করে- যোগ্যতার এ অবনীতে তারাই শ্রেষ্ঠ! তারাই আদর্শ ছাত্র!
তাদের এই নিরন্তর সাধনা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দেখে মনে আশা জাগে। স্বপ্নরা প্রজাপতি হয়ে উড়ে এসে কানে কানে বলে, তুমি কি তাদের মতো হতে পারো না? হ্যাঁ, তুমিও চাইলে হতে পারো তাদের মতো! তবে তোমাকে ইস্পাত-কঠিন জীবনখেয়া নিয়ে যাত্রা করতে হবে সাধনার সমুদ্রপথে! নিজেকে সমর্পণ করতে হবে অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেনের হাতে! লক্ষ্যের মানচিত্র দেখে দেখে পথ চলতে হবে অতি সাবধানে! তাহলে তুমিও হতে পারবে ইলমের জোছনাভরা আকাশের ঝলমলে নীলাভ নক্ষত্র!
এসো সেই শপথ বুকে নিয়ে সাধনার কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহান আমাদের সাধনায় সাফলতা দিবেন! ইনশাআল্লাহ!
স্মৃতিচারণ
বৃষ্টিভেজা রাতে নকীবের সাথে
আলী উসামা আইয়ুব
বর্ষাস্নাত রাত! টিপটিপ বৃষ্টিফোঁটা এখনো থেমে নেই। চারদিকের বড়-ছোট গাছের কচি কচি পাতাগুলো বেয়ে টুপটাপ বৃষ্টিজল ঝরছে আর ঝরছে। মাদরাসা হয়ে বাসার পথে হাঁটছি। রাত প্রায় ১১টা ছুঁইছুঁই। রাস্তার আশেপাশে থাকা লাল-নীল বাতিগুলোর আলো আজ আমার একদমই হৃদয় ছুঁইছে না।
আধভেজা হয়ে এসেছে কাপড়। হিম হিম বাতাসের সাথে হাত-পাও কেমন যেন ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে। রাস্তার ডানপাশ ধরে হাঁটছি। মাঝে মাঝে বড় বড় ট্রাকের হেডলাইট চোখে পড়ছে। সাথে কেউ নেই। আছে শুধু কাঁধে ঝুলানো একটি ব্যাগ, তার মধ্যে রয়েছে কয়েক কপি ‘মাসিক নকীব’ পত্রিকা।
একা একা রাতে পথচলাটা আজ খুব রহস্যময় লাগছে! কী এমন মায়া যে আজকে আমাকে এত রাতে বাসায় টানছে? কোনো বাস বা সিএনজিও চোখে পড়ছে না। তাই বাকি পথটুকু হেঁটেই যেতে হচ্ছে। এইতো প্রায় বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। প্রহরী চাচা আজ দেখি ছেলের চাকরির প্রথম মাসের বেতনের টাকা দিয়ে কিনে দেয়া বড় কাশ্মীরিশালটি গায়ে জড়িয়ে বসে আছে। আমাকে দেখা মাত্র বললো- আরে বাজান! তোমরা এত রাইত কইরা না আইসা কাল সকালে আইলেও তো পারতা?
-আরে চাচা আমরা মানে? আমি তো একা! মাদরাসা আজ ছুটি হয়েছে আর কুরিয়ার সার্ভিসে কিছু বই এসেছিলো আমার নামে, ওগুলো নিয়ে আসছিলাম, পথে দেখি একটি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। কী দারুণ দেখাচ্ছিল বইয়ের সারিগুলো। ছোট ছোট লাইটের আলোতে বইগুলোর রঙিন দেহ যেন ঝিলিক মারছিলো। মনে হলো আজ আমি সত্যি সত্যি জ্ঞানের আলো দেখতে পাচ্ছি। না উঠে আর পারলাম না। আর বই পড়তে পড়তে কখন যে রাত ১০টা বেজে গেল টেরও পেলাম না।
-আরে বাজান তোমার সাথে তোমার আম্মা আইচেনি?
-কিযে বলেন চাচা! এই না বললাম আপনাকে, আমি মাদরাসা থেকে আসছি।
-আরে বাজান তোমার আম্মা, আব্বা, বইন সবাই দেখলাম মাগরিবের পর তোমার নানার বাসায় গেল আর আমারে একটা চাবি দিইয়া গেছে যদি আপনি আহেন তাইলে আম্নেরে যেন দিই।
-ও তাই, আচ্ছা ঠিক আছে চাচা, চাবিটি আমায় দিন। ইস! আজ তাহলে বাসায় একা থাকতে হবে। আম্মু একটা কল দিলেই তো পারতো আমি নানুর বাসায় চলে যেতাম। কিন্তু কল দিলেও তেমন কোন লাভ হতো না। মোবাইলের চার্জ তো সেই লাইব্রেরিতেই শেষ। কী আর করা, আজ রাতটা বাসায় একা একাই কাটাতে হবে।
রাত প্রায় ১২টা। কোনোভাবেই চোখে ঘুম আসছে না। ভাবছি কী করা যায়? কী করা যায়? হঠাৎ কাঁধে করে নিয়ে আসা কালো ব্যাগটির দিকে নজর পড়তেই মনে পড়ে গেলো আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ‘বইয়ের কথা’। আরে এই ব্যাগে তো শুধু প্রিয় বন্ধু বই-ই নয়, বরং আমার প্রিয় মাসিক পত্রিকা নকীবও তো আছে।
থাক আর ঘুমাবো না। আজ রাতটা না হয় বই-পত্রিকা পড়েই কাটিয়ে দিবো।
নকীবের একটি কপি ব্যাগ থেকে বের করে হাতে নিলাম। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ। দেখতেই মনটা ভরে যাচ্ছে। কালো কালো অক্ষরের বড় বড় শিরোনাম। ফুল প্রকৃতি ও ইত্যাদির চিত্রে চিত্রায়ন করা হয়েছে ভেতরটা। প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গল্প, ছড়া-কবিতা, স্মৃতিগদ্য, আরো মজার মজার অনেক আয়োজন।
দেখেই মনে হচ্ছে মনের মাধুরি মিশিয়ে লিখেছেন প্রতিটি লেখা প্রিয় লিখিয়ে বন্ধুরা। পড়ছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। মুগ্ধতায় ভরে আসছে আমার হৃদয়। কখনো হাসছি আবার কখনোবা কাঁদছি! সবমিলিয়ে রাতটা দারুণ কেটেছে তাই ভাবলাম আজ রাতটা ইতি নয় বরং স্মৃতি হয়েই থাক।