অনেকদিন আগের কথা। মোহিতপুরে পাহাড়ি টিলা নামক একটা উঁচুস্থান ছিল। সেখানকার চারদিক গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ ছিল। সুবিশাল এলাকা হওয়া সত্ত্বেও মানুষ তো দূরের কথা কোন পশুও সেই পাহাড়ের দিকে যেতে সাহস পেতো না।
পাহাড়টির পাকা ফলের সুঘ্রাণ, ফুলের সৌরভ আশপাশের সমীরণ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে যেতো। দুঃসাহসী কেউ কেউ সেখানে লোভে পড়ে গেছে বটে। কিন্তু এলাকার সবার মুখে মুখে তাদের আর না ফিরে আসার গল্প আছে। এখানকার সবাই জন্মের পর একটু বুঝ হওয়া শিশুর কানে এই বার্তাটি ঢুকিয়ে দেয়।
সবার মনে একটাই আশঙ্কা-পাহাড়ি টিলায় একটি ভয়ঙ্কর ও বিশাল দৈত্য থাকে। সেই দৈত্যটি এতোটাই হিংস্র যে, খিদে পেলে সে সম্মুখে যাকে পায় তাকেই খেয়ে ফেলে। এ ভয়ে পাশের বনের পশুপাখি রীতিমতো আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সেই বনের রাজা সিংহ মামাও এ নিয়ে মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন। দৈত্যটিকে থামানোর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। দিনে দিনে দৈত্যটি আরো হিংস্র হয়ে ওঠে। ক’দিন যেতে না যেতেই খবর আসে সিংহ রাজার রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানী-গুণীরা দৈত্যের আহারে পরিণত হয়েছেন। এই তো গত কয়েকদিন আগে হঠাৎ তার কাছে খবর আসে দৈত্যের হিংস্রতার শিকার হয়েছেন তারই মন্ত্রীসভার পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী জিরাফ। পশুরাজের নিষেধ সত্ত্বেও জিরাফ ছুটে যায় সেই দৈত্যের কাছে। সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু দৈত্য তার কোন কথা না শুনেই তাকে হজম করে ফেলে।
এই খবর শোনার পর থেকে পশুরাজের মন ভালো নেই। সারাক্ষণ ছটফট করছেন। দু’চোখে ঘুম আসছে না। কী করবেন তা ভেবে কূল পাচ্ছেন না।
গভীর রাত। বনের ভেতর তখন সুনসান নীরবতা। সবাই ঘুমের ঘোরে ডুবে আছে। পশুরাজ তার শয়নকক্ষে এদিক-ওদিক পায়চারি করছেন। হঠাৎ চিৎকার করে বলে ওঠেন- পেয়েছি। পেয়েছি।
পশুরাজের হুংকার শুনে দরবারের পশুরা ছুটে আসে। পরপর আশপাশের পশুরাও আসতে থাকে।
পশুদের কাছে রাত-দিন বলে কোন কথা নেই। কোন বিপদ আঁচ করতে পারলেই তারা জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ছুটে। ছুটে আসা পশুরা নতশিরে পশুরাজের দিকে তাকিয়ে আছে। রাজাকে বিচলিত থাকতে দেখে সদ্য মন্ত্রীত্ব পাওয়া হরিণ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল- কী হয়েছে, জাঁহাপনা? আপনার কোন সমস্যা?
পশুরাজ ঘাঁড় নাড়তে নাড়তে বললেন- না, আমার প্রিয় মন্ত্রী মহাশয়। আমি দীর্ঘদিন ধরে একটা বিষয় নিয়ে খুব চিন্তা করছিলাম। হঠাৎ মাথায় একটা আইডিয়া আসলো। তাই এমনটি করেছি।
– কী আইডিয়া, জাঁহাপনা?
– আমাদের জীবনের জন্য যে হুমকি তা মোকাবিলা করবার জন্য আমরা সেই ভয়ানক দৈত্যের কাছে যাব। এবার একা নয়; সদলবলে। সে যদি আমাদের কোন ক্ষতি করতে চায় তাহলে যেন আমরা তার সাথে লড়াই করতে পারি। এতে অন্তত তার মনে কিছুটা হলেও ভয়ের সঞ্চার, আপনারা কী বলেন?
জল বিষয়ক মন্ত্রী কুমিরের দিকে তাকিয়ে বললেন।
কুমির লেজটা নেড়ে নেড়ে রাজার কাছে এসে বললেন- জাঁহাপনা, আপনার আইডিয়া কিন্তু মন্দ না। আমিও যাব আপনাদের সাথে। এবার যদি নিজ জন্মস্থানের জন্য কিছু একটা করতে পারি!
সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো- আমরাও যাব, জাঁহাপনা।
পশুরাজ আনন্দে কেঁদে উঠে বললেন- নিজ জন্মস্থানের নিরাপত্তার জন্য আপনাদের আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ঠিক আছে, তাহলে কালই আমরা সেই দৈত্যের কাছে যাচ্ছি।
পাশ থেকে বাঘমামা নড়াচড়া শুরু করলেন। পশুরাজ তার এমন ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পারলেন, নিশ্চয় তিনি কিছু একটা বলতে চাইছেন। বয়সের ভারে বাঘমামা খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আগে যেখানে তিনি গর্জন করলে অনেকেই পালিয়ে বাঁচত এখন সেখানে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কোন আওয়াজ তোলেন না। এতো বয়স হয়েছে তবু পশুরাজ তাকেই উজির পদে বহাল রেখেছেন।
এবার পশুরাজ বাঘ মামার দিকে তাকিয়ে বললেন- উজির সাহেব, আপনি কী কিছু বলতে চাইছেন?
– জ্বি, জাঁহাপনা। আমি বলতে চাই- কালই রওনা না দিয়ে আমরা বিষয়টা নিয়ে আরেকটু ভাবতে পারি। বনে আরও জ্ঞানীগুণী আছে। তাদের কাছ থেকেও কিছু পরামর্শ নিতে পারি। আরো ভালো কোন আইডিয়া আসে কিনা দেখতে পারি।
পশুরাজ একটু ভেবে নিয়ে বললেন- কেন আমার আইডিয়া আপনার পছন্দ হয়নি?
– মোটামুটি হয়েছে, জাঁহাপনা। কিন্তু এটা তো সাময়িক সমাধান। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে আবার মাথাচাড়া দিতে পারে।
– সাময়িক সমাধান মানে?
– এই যেমন ধরুন, আমরা গিয়ে দৈত্যকে ভয় দেখিয়ে চলে আসলাম। তাতে সে ভয় পেতেও পারে আবার নাও পেতে পারে। তারচেয়ে ভালো হবে দৈত্যটিকে একেবারে কিছু একটা করা যায় কীনা সে উপায় খুঁজে বের করা।
পশুরাজ চোখ বন্ধ করে একটু দম নিয়ে বললেন- আপনার কথা আমার মনে ধরেছে। ঠিক আছে। এখন রাত অনেক হয়েছে। আপনারা যে যার গন্তব্যে ফিরে যান। আগামিকাল দুপুরে আমরা আবার দরবারে বসব। আর হ্যাঁ, রাজ্যের সকল জ্ঞানী গুণীদের বলে দেবেন সবাই যেন কালকের মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করে।
এই বলে পশুরাজ সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজ কক্ষে ফিরে আসলেন।
পরদিন সকাল থেকে বনের জ্ঞানী-গুণীরা পশুরাজের দরবারের দিকে আসতে থাকে। দুপুরবেলা। সূর্য ঠিক মাথার ওপরে। পশুরাজ দরবারে উপস্থিত হলেন। সকল প্রাণী দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানালো। পশুরাজ আসনে গিয়ে বসলেন। এরপর সবাইকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেন- সবাইকে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু শিয়াল পণ্ডিতকে যে দেখতে পাচ্ছি না।
ভীড়ের ভেতর থেকে খকখক কেশে শিয়াল পণ্ডিত বলল- মহারাজ, এই তো আমি এখানে।
– আপনার আবার কী হয়েছে? এভাবে কাশছেন কেন?
– না, মহারাজ। তেমন কিছু হয়নি। গত কয়েকদিনের ঠাণ্ডায় একটু কাশির মাত্রাটা বেড়ে গেছে। সেকারণে গত কয়েকদিন ধরে খাবারের জন্যও বের হতে পারিনি।
– এ কী কথা বলছেন! এখন কী আপনার কাছে খাবার নেই?
– সামান্য আছে। আজকের দিন কোনমতে চলবে, মহারাজ।
পশুরাজ রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী হাতিকে বললেন- মন্ত্রী সাহেব, আজই শিয়াল পণ্ডিতের জন্য একসপ্তাহের খাবার পাঠিয়ে দেবেন।
হাতি কুর্নিশ করে বলল- জু হুকুম, জাঁহাপনা।
শুরু হয়ে গেল দরবারের আলোচ্য বিষয় নিয়ে কথা বলা। পশুরাজ সবার উদ্দেশ্যে বিস্তারিত তুলে ধরলেন।
সেনাপতি গণ্ডার কুর্নিশ করে বললেন- জাঁহাপনা, আমি বলি কী, প্রথমে আমি আমার সেন্যবাহিনী নিয়ে দৈত্যের মোকাবিলা করি। তারপরের সিদ্ধান্ত পরে হোক।
বাঘ মামা নড়াচড়া শুরু করলেন। পশুরাজ তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন- উজির সাহেব, সেনাপতির প্রস্তাবের বিষয়ে আপনি কিছু বলবেন?
– জ্বি, জাঁহাপনা, এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে আমাদেরকে দূরে থাকতে হবে। ভেবে দেখা উচিত এতোগুলো সৈন্যকে একটা ভয়ানক দৈত্যের কাছে পাঠালে কী হতে পারে? এ যাবৎ যারাই সেখানে গিয়েছে তাদের কেউই ফিরে আসেনি। আমি বলি কী, তাই যা করবার তা অনেক ভেবেচিন্তে করাই উচিত।
পশুরাজ তাতে সায় দিয়ে বললেন- উজির সাহেব যথার্থই বলেছেন। এখনই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। দেখি আর কারো মাথায় কিছু আসে কীনা।
হঠাৎ পশুরাজের দৃষ্টি যায় রাজ্যের বার্তাবাহকের দিকে। এরপর তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন- আমার প্রিয় বার্তাবাহক পাখি তুমি কী কিছু বলবে?
টিয়াপাখি কাচুমাচু করে বলল- আমার একটা প্রস্তাব আছে। আর তা হলো সবার কথা তো শুনেছি। কিন্তু শিয়াল পণ্ডিত তো এখনও কিছু বললেন না। উনি এ রাজ্যের একজন অন্যতম জ্ঞানী। তিনি বোধহয় আরো ভালো উপায় বলতে পারবেন।
– সত্যি তো। আমি তো খেয়ালই করিনি।
এরপর শিয়াল পণ্ডিতের দিকে তাকিয়ে বললেন- পণ্ডিত মশাই, আরো সামনে আসেন। আর আপনার সুচিন্তিত মতামত দিন।
রাজার কথায় শিয়াল পণ্ডিত লেজ নাড়িয়ে সামনে এসে কুর্নিশ করে বলল- মহারাজ, এতক্ষণ ধরে আমি সবার কথা শুনলাম। সবাই যার যার মতো করে ভালো বলেছেন। তবে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। অভয় দিলে বলতে পারি।
– হ্যাঁ, নির্ভয়ে বলুন।
– আমাদের সবার মধ্য থেকে জ্ঞানী-গুণী বেছে নিয়ে একটা দল গঠন করব। সে দলের দলনায়ক থাকবেন আপনি। আমরা আপনার নেতৃত্বেই পাহাড়ি টিলার সেই দৈত্যের কাছে যাব। তবে সবাই একটা নিরাপদ দূরত্বে থাকব। এরপর যথারীতি দৈত্যটি আমাদেরকে খেতে আসতে চাইবে। তখন আপনি আপনার রাজকীয় হুংকার ছাড়বেন। আর আমি তখন সামনে গিয়ে সেই দৈত্যকে বোঝানোর চেষ্টা করব।
– ও যদি আপনাকে খেয়ে ফেলে!
– খাবে না। আপনার হুংকার শুনে ও কিছুটা হলেও বিব্রত থাকবে। আর খেয়ে ফেললেও আমি তাতে ভয় করি না। নিজের মাতৃভূমির মুক্তির জন্য যদি আমি শহীদও হই তাতে আমার মনে কোন আফসোস থাকবে না। আর যদি সে আমার সাথে সমঝোতায় আসে তাহলে আমার বিশ্বাস আমি তাকে আমার বুদ্ধির ফাঁদে ফেলতে পারব।
– কীসের ফাঁদ?
– সেখানে যাওয়ার আগে আমরা একটা বড়সড় দিঘি খনন করব। সেই দিঘিটি এতোটাই গভীর হবে যেন কেউ সেখানে পড়লে অন্য কারোর সাহায্য ছাড়া ওঠে আসতে পারবে না। আর দৈত্যটিকে জানাব সেখানে তারচেয়েও বিশাল ও ভয়ঙ্কর আরেকটি দৈত্য আছে। সে আরও হিংস্র। ছোট-বড় কোন কিছুই মানে না। সামনে যাই পায় তাই খেয়ে ফেলে। এবং কিছুদিন আগে আমি নিজে সেই দৈত্যটির কাছে ধরা পড়েছিলাম। সে আমাকে খাওয়ার আগে আমার সাথে কথা বলে। আমার শেষ ইচ্ছা জানতে চায়। তখন আমি তাকে আপনার কথা বলি। এ বনের পাহাড়ি টিলায় থাকে আমার মামা। তিনিও আপনার মতো বিশালাকৃতির। সবাই তাকে সম্মান করে। তিনি যদি জানতে পারেন আপনি আমাকে খেয়ে ফেলেছেন তবে আপনাদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাবে। আমার কথা শেষ হতে না হতেই তিনি তেলেবেগুনে জ¦লে ওঠেন। এরপর রেগে গিয়ে বললেন- যাও পুচকে, তোমার মতো পিচ্চিকে আমি খাব না। তোমার মামাকে গিয়ে বল আমার কাছে আসতে। আমি তাকেই খেয়ে ফেলব। এরপর আমি কোনমতে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসি। আমি বিষয়টি আমাদের রাজ্যের রাজাকে অবহিত করি। আমাদের পশুরাজ আপনার খুব ভক্ত। তিনি বললেন, এ বিষয়টি আপনাকে অতি সত্তর জানানো প্রয়োজন। তাই আমাদের আজকে আপনার কাছে আসা। এখন আপনিই বলুন, আমাদের আর কী করার আছে?
আমার কাছ থেকে এমন কথা শোনার পর নিশ্চিত দৈত্যটি অপর দৈত্যের প্রতি প্রচণ্ড রেগে যাবে। আমার পরামর্শ চাইবে। তখন তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে দিঘির কাছে নিয়ে আসব। এরপর সে দিঘিতেই শেষ হয়ে যাবে।
পশুরাজসহ দরবারে উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে পণ্ডিত মশাইকে সমর্থন জানালো।
এরপর পশুরাজ গলা উঁচিয়ে বলল- খুবই চমৎকার আইডিয়া। এজন্যই পণ্ডিত মশাই এ রাজ্যের সেরা পণ্ডিত। আমি সম্পূর্ণভাবে আপনার প্রস্তাবে একমত পোষণ করছি।
পাশ থেকে কুমির বলল- জাঁহাপনা, এ ক্ষেত্রে আমার একটা ভূমিকা থাকতে পারে। আর তা হলো- আমি আমার সাথে বেছে বেছে খুব শক্তিশালী কুমিরদের নিয়ে সেই দিঘির জলে আগে থেকে অবস্থান করব। আপনি তো জানেনই আমরা স্থলের চেয়ে জলেই বেশি স্বতঃস্ফূর্ত থাকি। দৈত্যটি যখনই নিচে নেমে পড়বে তখনই আমরা সবাই মিলে তাকে আক্রমণ করব। সেখানেই তার পরাজয় নিশ্চিত করব।
পশুরাজ আনন্দিত হয়ে বললেন- অশেষ ধন্যবাদ, মন্ত্রী মহাশয়। তাহলে এই কথা রইল। আগামিকাল থেকেই দিঘি খননের কাজ শুরু করা হোক।
সভা শেষে যে যার গন্তব্যে ফিরে গেল।
পরদিন শুরু হলো দিঘি খননের কাজ। এতে বনের সবাই হাত বাড়ালো। পুরোপুরি কাজ শেষ করতে প্রায় একসপ্তাহ লেগে গেল। অবশেষে পরিদর্শনের লক্ষ্যে পশুরাজ তার মন্ত্রী পরিষদকে সঙ্গে নিয়ে দিঘির কাছে এলেন। দিঘির কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় পশুরাজ সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এরপর দিঘির খুব কাছে গিয়ে নিচের দিকে লক্ষ্য করেন। খুব গভীরভাবে খনন করা দিঘির পরিষ্কার স্বচ্ছ জলে পশুরাজ নিজেকে আবিষ্কার করলেন। দেখেই ভয়ে তার বুক দুরুদুরু করে ওঠে।
তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরবারে ফিরে আসেন।
দু’দিন পর পশুরাজ তার দলবল নিয়ে সেই দৈত্যের কাছে যেতে লাগলেন। পাহাড়ি টিলার কাছাকাছি পৌঁছতেই বার্তা বাহক উড়ে এসে খবর জানালো, তারা সুবিধাজনক সময়ে এসেছেন। কিছুক্ষণ আগেই দৈত্যটি তার এ বেলার খাবার খেয়ে এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন।
বার্তা বাহকের কাছ থেকে এমন সুখবর পেয়ে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ধীরে ধীরে তারা পাহাড়ি টিলায় পৌঁছে যায়। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক সবাই নিজ নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। পশুরাজ সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হুংকার দেয়া শুরু করলেন। পাশাপাশি অন্যরাও সাধ্যমতো আওয়াজ করতে থাকে।
নিজের আস্তানায় প্রথমবারের মতো এমন বিকট আওয়াজ শুনে দৈত্য ওঠে দাঁড়ায়। ঘুমঘুম চোখে এদিক-ওদিক ভালো করে দেখে নেয় সে। খানিক দূর থেকে শিয়াল পণ্ডিত সালাম দিয়ে তার সাথে কথা বলতে চায়। ওদিকে মুহুর্মুহু হুংকারে দৈত্য যেন দিশেহারা। এই সুযোগে শিয়াল পণ্ডিত দৈত্যের একেবারে কাছে এসে বলতে লাগল- মামু, কেমন আছেন?
– তুমি কে? আর এতো আওয়াজই বা কীসের?
– আমি জন্মসূত্রে আপনার ভাগ্নে।
– আমার ভাগ্নে! আমার ভাগ্নে হলে তুমি আকারে এতো ছোট কেন?
– সেটা তো আমারও প্রশ্ন! বুঝ হওয়ার পর জানতে পারি আমার প্রজাতি নাকি আপনারই। আমি আপনার ছোটবোনের বাচ্চা। আমার জন্মের পর মা আমাকে রেখে পাহাড়ি টিলার দিকে চলে আসেন। আর একজোড়া শিয়াল দম্পতি আমাকে লালন পালন করেন। সেই থেকে আমিও তাদের মতো হয়ে গেছি। আমার মা কোথায়, মামু?
দৈত্য মনে মনে ভাবে- আমার বোনের একটি বাচ্চা ঐ বনে হারিয়ে গেছে। একথা সত্য। কিন্তু ও যদি আমার ভাগ্নে না হয় তাহলে এতো সব জানলো কেমন করে! আর ওর সাহসইবা এতো বেশি কেমনে হয়!
এসব ভাবতে ভাবতে আনমনে জিজ্ঞেস করলেন- তো ভাগ্নে, আমার কাছে কী জন্য এসেছ?
শিয়াল পণ্ডিত দৈত্যের মনের অবস্থা আঁচ করতে পেরে উত্তরে কাঁদো গলায় বলল- কী বলব আর দুঃখের কথা, মামু। আমাদের বনে হঠাৎ করে কোথা থেকে একটা দৈত্য এসে হাজির হয়েছে। এখন সে যারে পায় তারে খায়। দেখতে দেখতে বনের পশুপাখি প্রায় খেয়ে ফেলেছে।
এখানে যাদের দেখছেন শুধু এরা বেঁচে আছে। এই তো গত কয়েকদিন আগে আমি নিজেও তার শিকারে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার কথা বলে কোনমতে ছাড়া পেয়েছি।
– আমার কথা বলে মানে!
– আমি ওকে বলেছি, পাহাড়ি টিলায় আমার মামা থাকেন। তিনিও আপনার মতো। উনি যদি শুনেন আপনি তার ভাগ্নেকে খেয়ে ফেলেছেন তবে আপনাকে তিনি ছাড়বেন না। এই কথা বলার পর সে রেগেমেগে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলে- যা পিচ্চি, তোকে খাব না, আমি তোর মামাকেই খাব। তারপর আমি কোনমতে সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসি। এরপর আমাদের বনের রাজাকে সব খুলে বলি। আমাদের বনের রাজা সিংহ আবার আপনার খুব ভক্ত। তিনি আমাকে বললেন, বিষয়টি আপনাকে জানানো খুবই জরুরি। এরপরই আমরা আপনার কাছে ছুটে এসেছি। এখন আপনিই বলেন এই অপমান কী সহ্য করা যায়?
দৈত্যটি রেগেমেগে মাটিতে জোরে জোরে আঘাত করতে থাকে। এরপর নিজের বুকে নিজে জোরে জোরে আঘাত করে বলে ওঠে,
– তার এতো বড় সাহস, আমাকে খেয়ে ফেলবে বলে! চল, দেখি তার বুকের পাটা কতো! সে এখন কোথায় আছে?
– সে আমাদের বনের দক্ষিণ প্রান্তে আছে। তাহলে চলেন।
– হ্যাঁ, চল, ভাগ্নে।
এরপর দৈত্যটি শিয়াল পণ্ডিতের কথামতো সেই বনের দিকে এগুতে লাগলো। শিয়াল পণ্ডিত, পশুরাজ ও অন্যরাও নিরাপদ দূরত্বে থেকে বনের দিকে এগুতে লাগলো।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত দৈত্য শিয়াল পণ্ডিতকে বলল- ভাগ্নে, আর কতো দূর? আমি যে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
– কী বলেন, মামু? আমার তো হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে।
– আরে, বাবা! তোমার শরীরটা আর আমার শরীরটা দেখো। তবেই বুঝতে পারবে। আর তুমি তো মুরগি চুরি করে ভোঁ-দৌড় দাও। আমার তো শিকারের জন্য দৌড়াতে হয় না।
শিয়াল পণ্ডিত লজ্জাজড়িত কণ্ঠে বলল- মামু, আপনি আমাকে এভাবে বলতে পারলেন!
দৈত্য তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললেন- মন খারাপ করো না, ভাগ্নে। তোমার সাথে একটু মজা করলাম।
শিয়াল পণ্ডিত মনে মনে বিড়বিড় করে- আগে জায়গা মতো চলেন মামু, তারপর আসল মজা আমিই আপনাকে দেখাব।
দৈত্য শিয়ালকে উদ্দেশ্য করে বলল- আবার বিড়বিড় করে কী বলছ?
শিয়াল পণ্ডিত থতমত খেয়ে বলল- না, মামু হঠাৎ আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। তাই মাকে একটু স্মরণ করছি।
– ওহ্! আচ্ছা। ভাগ্নে, সেই দৈত্যকে যে দেখতে পাচ্ছি না। বনের দক্ষিণ প্রান্তে তো এসেই গেলাম।
হঠাৎ শিয়াল পণ্ডিত দাঁড়িয়ে যায়। সেই সাথে পশুরাজও তার দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। দৈত্য বিষয়টি লক্ষ্য করে শিয়ালকে উদ্দেশ্য করে বলল- কী হলো ভাগ্নে, তোমরা যে ওখানে দাঁড়িয়ে গেলে!
শিয়াল পণ্ডিত ভয়ে ভয়ে বলল- মামু, আপনার ঠিক পিছনেই সেই দৈত্যটা আছে। সে আমাদের দেখলে এবার নিশ্চিত খেয়ে ফেলবে। আমার খুব ভয় করছে, মামু।
– তাহলে এই কথা! তোমরা সেখানেই থেকো। আমি নিজেই দেখছি।
এই কথা বলে দৈত্যটি একেবারে দিঘির খুব কাছাকাছি চলে আসে। দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে লক্ষ্য করে সে। দিঘির পরিষ্কার স্বচ্ছ জলে সে আরেকটি দৈত্য দেখতে পায়। দেখতে অনেকটা তারই মতন। চেহারা খুবই বিদঘুটে টাইপের। দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত। যেন একটু একটু নড়াচড়া করছে। এবার পাড়ের দৈত্যটি বড় বড় চোখে তাকিয়ে নিজের বুকে নিজে আঘাত করতে করতে সজোরে চিৎকার শুরু করল। অদ্ভুত ব্যাপার! নিচের দৈত্যটিও তাকে অনুসরণ করে একই ভঙ্গিমায় চিৎকার করছে। উপরের দৈত্যটি রাগে ক্ষোভে তাকে আক্রমণ করতে নিচের দিকে লাফিয়ে পড়ে। অমনি জলে ওঁত পেতে থাকা কুমিরের দল তাকে ঘিরে ধরে। আর পশুরাজসহ অন্যরা সবাই দিঘির পাড়ে এসে আনন্দে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।