দেওবন্দ একটি গতানুগতিক প্রতিষ্ঠানের নাম নয়। খলিফা উমর রা.-এর যুগে ইসলাম এসেছিল ভারত উপমহাদেশে। তখন থেকেই ‘মাআনা আলাইহি ওয়াআসহাবিহি’-এর কেতন উড়িয়ে একদল জানবাজ মুজাহিদ ভারতে ইসলাম নামক বৃক্ষটিকে সুশোভিত করেছেন। শিল্প-বিপ্লবের পর ইউরোপিয়ানরা কাঁচামাল আহরণের জন্য নতুন বাজারের সন্ধানে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী ইতিহাস সকলেরই জানা। ভারত উপমহাদেশকে গিলে নেয় ইংরেজরা। শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রাহি.-এর ফতোয়ার পর শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। বালাকোঁ যুদ্ধের পর ১৮৬৬ সালের ৩০ মে প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ।
কী উদ্দেশ্য নিয়ে দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল? পড়ে দেখি হাকিমুল উম্মাহ কারী তাইয়িব রহ.-এর বক্তব্য। তিনি বলেন, দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হলো :
১. মাজহাবিয়্যত অর্থাৎ, মাজহাব ও আদর্শের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা।
২. দায়েম আজাদি বা সামগ্রিক ও চিরস্থায়ী স্বাধীনতা অর্জন।
৩. আখলাক ও বুলন্দ কিরদার বা আত্মিক ও নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন ও এক্ষেত্রে অনুপমনমুনা তৈরি।
৫. ইনহেমাকে ইলমি বা শিক্ষা-দীক্ষায় আত্মমগ্নতার পরিবেশ গড়ে তোলা। (তারিখে দারুলউলুম : ২৫৪; তাহরিকে দেওবন্দ : ১৬৪)
কারী তাইয়িব রাহি. দারুল উলুমের প্রাতিষ্ঠানিক ও আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিকে দুটি মৌলিক শিরোনাম দিয়ে আলোচনা করেছেন। শিরোনাম দুটি হলো :
১. মারকাজিয়্যত বা সামগ্রিকতা ও সর্বজনীনতা সৃষ্টি এবং এক কেন্দ্রে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস।
২. মাসলাকে এতেদাল বা নিরপেক্ষ ভারসাম্যপূর্ণ সঠিক ইসলামি মতাদর্শের প্রতিষ্ঠা।
দেওবন্দের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি কারী তাইয়িব রাহি. ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে :
‘দারুল উলুম ধর্ম হিসেবে ইসলামের অনুসারী, ফিরকাগত দিক থেকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী, মাজহাবগত দিক থেকে হানাফি মাজহাবের অনুসারী, আধ্যাত্ম ধারায় সুুফিবাদের অনুসারী, আকিদার দিক থেকে আবুল হাসান আশআরি ও ইমাম মাতুরিদির অনুসারী, আধ্যাত্মিক মতপথের প্রশ্নে চিশতিয়া ধারার; বরং বলতে গেলে সকল ধারার সমন্বিত রূপের অনুসারী, চিন্তাধারায় শাহ ওয়ালি উল্লাহ রাহি.-এর চিন্তাধারার অনুসারী, চিন্তা চেতনা ও আদর্শিক মূলনীতির দিক থেকে কাসিম নানুতবি রাহি.-এর এবং আনুষাঙ্গিক বিষয়াদী ও মাসআলা- মাসাইলের ক্ষেত্রে রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রাহি.-এর অনুসারী, নিসবত হিসেবে দেওবন্দি।’ (তাহরিকে দেওবন্দ: ১৬৭)
কারী তাইয়্যিব রহ.-এর এ বক্তব্য আমাদের সকলের ভালো করে পড়া দরকার। তিনি বলেন-
”دیوبندیت کوئی مذہب یافرقہ نہیں ،جسے معاندین اسے ایک مذہب یافرقہ کانام دے کرعوام کواشتعال دلانے کی کوشش کرتے ہیں؛بلکہ مسلک اہل السنة والجماعة کاایک جامع مرقع اورمکمل ایڈیشن ہے ،جس میں اہلِ سنت کی ساری شاخیں اپنی اصل سے جڑی ہوئی دکھائی دیتی ہیں،
অর্থাৎ দেওবন্দ কোনো মাজহাব বা ফিরকা তথা দলের নাম নয়। যেমনটা অনেক বিদ্বেষ পোষণকারীরা দেওবন্দের উপর আপত্তি উত্থাপন করেন। তারা দেওবন্দকে মাজহাব বা ফিরকা বলে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে চান। বরং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের একটি পরিপূর্ণ দুর্গের নাম হলো দেওবন্দ। (তারীখে দারুল উলূম: ৭৫)
এজন্য আকাবিরে দেওবন্দকে দেখি দেওবন্দিয়ত নিয়ে কখনো টানা-হেচড়া করেননি। বরং তারা ছিলেন উদার। আহলু সুসুন্নাহ ওয়াল জামাত-এর অনুসারী সকলকে দেওবন্দি বলে সমর্থন দিয়েছেন। কয়েকজন আকাবিরের বক্তব্য আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
দারুল উলূম দেওবন্দের মাওলানা মানযুর নুমানী রহ. রাসূলগণ কবরে জীবিত থাকা সংক্রান্ত একটি কিতাব লিখেছেন “মাসআলাতু হায়াতিন নাবী”নামে। সে কিতাবের শেষে তিনি দেওবন্দের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলাচনা করতে গিয়ে লিখেন-
“দারুল উলূম এবং আকাবিরে দেওবন্দ হলো একটি শিরো নাম। বসুধার সকল উত্তমপন্থা, উত্তম ফিকির এবং প্রত্যেক উত্তম বস্তু হল দেওবন্দিয়ত”। (মাসাআলাতু হায়াতিন নাবী, পৃষ্ঠানং, ১৩০)
মাওলানা মানযুর নুমানী রহ.-এর বক্তব্য থেকে আমাদের অনেক বড় শিক্ষা অর্জন করা দরকার। পৃথিবীর সকল উত্তমপন্থাকে তিনি দেওবন্দিয়ত বলেছেন।
১৪০০ হিজরীতে দারুল উলূম দেওবন্দের শতবার্ষিকী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. একটি যুগান্তকারী বক্তব্য পেশ করেছিলেন। সে ভাষণে তিনি দেওবন্দের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, দেওবন্দের বৈশিষ্ট্য হল চারটি।
“এক: এ দরসগাহের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এ দরসগাহ মতনৈক্যকে পিছনে ফেলে তাওহীদ এবং সুন্নতের উপর নিজের দৃষ্টি রাখবে। আর এটা এমন ওয়রাছাত এবং আমানত, যা শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ ইসমাইল শহীদ এবং সায়্যিদ আহমদ শহীদ-এর ওসীলায় এ প্রতিষ্ঠান পেয়েছে এবং এখন পর্যন্ত শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে আছে।
দুই: সুন্নাতের অনুসরণের জযবা এবং ফিকির থাকতে হবে।
তিন: আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি করার ফিকির, যিকির এবং গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার জযবা থাকতে হবে।
চার: আল্লাহর কালেমা বুলন্দীর জযবা থাকতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে। এ চারটি শিরোনাম যার মধ্যে থাকবে, সে দেওবন্দী। যদি এর মধ্যে কোন একটি কমে যায়, তাহলে সে পূর্ণ দেওবন্দি নয়”। (কারওয়ানে জিন্দেগী, ৩/৩১০-৩১১)
আরও অনেক আকাবিরের বক্তব্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিতাবের পাতায় পাতায়। দেওবন্দ তার ব্যাপক লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও ভারসাম্যপূর্ণ সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে যাওয়ার ফলে, অতিঅল্প দিনেই প্রতিষ্ঠানটি সর্বজন সমাদৃত হয়েছে। হকপন্থি প্রত্যেক ফিরকা এ আদর্শের পতাকাতলে একত্রিত হতে পারে। আল্লামা ইকবালকে আল্লাহ জাজায়ে খায়র দান করুন। এক ব্যক্তি তাকে প্রশ্ন করেছিলো, দেওবন্দ কি কোনো দলের নাম? তিনি উত্তরে বলেন-
نہ مذہب ہے نہ فرقہ؛ بلکہ ہرمعقول پسند دین دارکانام دیوبندی ہے۔
অর্থাৎ দেওবন্দ কোনো মাজহাব বা দলের নাম নয়। প্রত্যেক বুদ্ধিমান দীনদারের নাম হলো দেওবন্দ।
দেওবন্দকে দেওবন্দের জায়গায় রাখি। আকীদা, তাসাওউফ, মাজহাব, আদর্শ সবদিক থেকে আমরা ভাই ভাই। মত-পথের পার্থক্য হতেই পারে। মত-পথের পার্থক্যে দেওবন্দকে না জড়ানোই উত্তম। হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তানের উলামায়ে কেরাম দেওবন্দ এবং দেওবন্দিয়ত নিয়ে টানাটানি করেন না! আমাদের টানাটানি করার দরকার নেই। বাতিল যখন চতুর্দিক থেকে আমাদের ঘিরে ধরেছে, তখন আমাদের বড়দের আরেকটু সতর্কতা কাম্য। তাদের অনভিপ্রেত বক্তব্য যেন আমাদের মাঝে নতুন কোনো বিতর্ক উস্কে না দেয়। আল্লাহ সকলকে সুমতি দান করুন।