দেশে দেশে ঈদ উৎসব

দেশে দেশে ঈদ উৎসব

দেশে দেশে ঈদ উৎসব
জাহিদ বিন হিকমত

ঈদ। দুটি অক্ষরের একটি শব্দ। অথচ কত কিছুই এই একটি মাত্র শব্দে লুকিয়ে আছে তা মুসলিম মাত্রই জানে। বিশ্বের প্রায় দুইশ কোটি মুসলমান নিজস্ব সংস্কৃতির রঙ্গে রাঙিয়ে তোলেন ঈদ আনন্দ। ঈদুল ফিতরকে যেমন আমরা বলি রোজার ঈদ। আজারবাইজানের লোকেরা বলে ‘রামাজান বায়রামি’। ইন্দোনেশিয়ায় হারি রায় ইদুল ফিত্রি নামে পরিচিত, ‘লেবারান’ নামে আরো বেশি জনপ্রিয়। সেনেগালে বলে ‘করিতি’। ফিলিপানরা বলে হারিরায়া, হারিরায়া বুকা, হরিরায়া বুকা পুয়াসা। নাইজেরিয়ায় পরিচিত ‘ছোট সাল্লা’ নামে। কিরগিজস্তানিরা বলে ‘ওরোজো আইত’। আলবেনিয়াতে এটি ফিতর বজরামি বা বজরামি ই মাধ নামে পরিচিত। তবে যে যেভাবেই বলুক, ঈদুল ফিতর সবার জন্য খুশি ও অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে উপস্থিত হয়। শুধু উদযাপনটা ভিন্ন ধরনের। বিশ্বের নানান জাতি-গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুসারে ঈদুল ফিতর উদযাপন করে থাকে।

আমরা ঈদ কেন্দ্রিক অনেক কিছু করে থাকি। ঈদের চাঁদ দেখতে গিয়ে হৈহুল্লোড়। নতুন পোশাক পরে ঈদের নামাজ পড়ি, নামাজ শেষে সবার সঙ্গে ‘ঈদ মোবারক’ বলে কোলাকুলি করি। মেয়েরা হাতে মেহেদি ব্যবহার করে। মজাদার রান্নার আয়োজন করা হয় বাড়িতে বাড়িতে। এলাকায় শিশু-কিশোরদের জন্য করা হয় মেলার আয়োজন। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা স্বাক্ষাত এবং স্বাক্ষাতে ‘ঈদ সালামি’ দেওয়া হয়। আরো কত কিছু করা হয় ঈদ উপলক্ষে। কিন্তু গোটা বিশ্বজুড়ে নিশ্চয়ই ঈদের চিত্র এমনটা নয়, দেশে দেশে রয়েছে ভিন্ন মাত্রার নিজস্ব ঈদ সংস্কৃতি। আসুন জেনে নেই কয়েকটি দেশের ঈদুল ফিতর উদযাপনের ভিন্ন কিছু নিয়ম কানুন।

ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ
বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ জনবহুল ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়া। আরবীয়, ভারতীয়, চীনা, মালয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিশেল রয়েছে জীবনাচরণে। দেশটিতে ঈদ উল ফিতরকে বলা হয় লেবারান । ঈদের আগের রাতে তাকবির ও প্রদীপ জ্বালানোর মাধ্যমে ঈদ উৎসব শুরু হয়। লোকেরা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে পরিবার এবং প্রতিবেশীদের সাথে জড়ো হয় এবং একটি বিশেষ লেবারান খাবার খায়। এ সমস্ত বিশেষ খাবারের মধ্যে রয়েছে কেতুপাট, রেনদাং, অপোর আয়ম এবং গুলাই। শিশুদের রঙিন খামে সালামি দেওয়া হয়।

মালয়েশিয়ায় ঈদ
মালয়েশিয়ানরা উৎসবের আগের দিনটিতে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। ঐদিন তারা নিজ নিজ শহরে ভ্রমণে বের হয়। তারা পেলিটা (তেলের প্রদীপ) দিয়ে ঘর সাজায় এবং ঐতিহ্যবাহী নানা খাবার প্রস্তুত করে। তারমধ্যে কেতুপাট (ভাত), কুইহ রায়া, লেমাং (বাঁশে রান্না করা এক ধরনের আঠাঁলো ভাত ), রেনদাং (রান্না করা মাংস) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । মালয়েশিয়ায় শিশুদের তাদের পিতামাতা বা বড়দের কাছ থেকে সালামি বাবদ টোকেন অর্থ দেওয়া হয়, যা ‘দুইত রায়’ নামেও পরিচিত।
সৌদি আরবে ঈদ
সৌদি আরবে ঈদে একটি অনন্য ঐতিহ্য হলো, স্থানীয়রা কম তুলনামূলক গরীব কিংবা সবার বাসার দরজায় প্রচুর পরিমাণে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও খাবার রেখে যান। সৌদির আর একটি ঐতিহ্য ঈদের নামাজের পর পিতৃপ্রধান বাড়িতে জড়ো হয়ে ঈদ উদযাপন করা। সৌদিতে ঈদের স্পেশাল খাবারের মধ্যে রয়েছে মুগলগাল, জেরিশ এবং ঘুরাইবাহ। মুগলগাল সৌদি আরবের অন্যতম বিখ্যাত খাবার। ঈদের সময় সাধারণত উপভোগ করা এই খাবারে মশলার সাথে ভাজা ভেড়ার মাংস, তাজা টমেটো, পেঁয়াজ এবং সবুজ মরিচ থাকে। দেশটিতে ঈদুল ফিতর ‘মিষ্টি ঈদ’ নামেও পরিচিত।

তুরস্কে ঈদ
তুরস্কের মোট জনগোষ্ঠীর ৯৮ শতাংশই মুসলিম! ঈদের দিনকে তুর্কিরা ‘রামাদান বেরামি’ বা রামাদান উৎসব ও ‘সেকার বেরামি’ বা মিষ্টির উৎসব বলে। এই দিনটিকে তারা উৎসর্গ করে বহুবিধ ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নের নামে। বাচ্চারা প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যায় আর ভালোবাসা ও আশীর্বাদের নিদর্শনস্বরূপ তাদের পাতে তুলে দেয়া হয় টার্কিশ ডিলাইট এবং বাকলাভার মতো মজাদার সব খাবার।

আফগানিস্তানে ঈদ
আফগানরা ঈদের দশ দিন আগে থেকে তাদের ঘর বাড়ি পরিষ্কারের মাধ্যমে ঈদুল ফিতর উৎসবের প্রস্তুতি শুরু করে । ঐতিহ্যবাহী বোলানি (নিরামিষাশী ফ্ল্যাটব্রেড) আফগানিস্তানে ঈদুল ফিতরের একটি জনপ্রিয় খাবার। আফগানিস্তানে অন্যান্য দেশগুলো থেকে একটু ভিন্নভাবে ঈদ উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। আফগানিস্তানে ঈদ উৎসব পালনের জন্য ডিম যুদ্ধের আয়োজন করা হয়। পুরুষদের জন্য খোলা কোনো ময়দানে ঈদের দিন ডিম যুদ্ধের আয়োজন করা হয়। সেখানে তারা পরস্পরের দিকে সেদ্ধ করা ডিম ছুড়ে মারে।

পাকিস্তানে ঈদ
পাকিস্তানে ঈদ-উল-ফিতরকে ‘ছোট ঈদ’ বা ‘মিষ্টি ঈদ’ নামে অভিহিত করা হয়। পরিবারের সদস্যরা খির এবং ঐতিহ্যবাহী ডেজার্ট শির খুরমা সহ বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি এবং মিষ্টান্নসহ একটি বিশেষ ঈদের নাস্তা উপভোগ করেন, যা ভার্মিসেলি, দুধ, মাখন, শুকনো ফল এবং খেজুর দিয়ে তৈরি। ঈদ বিশেষ করে বাচ্চারা উপভোগ করে, কারণ তারা তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং বড়দের কাছ থেকে উপহার হিসাবে ‘ঈদি’ নামে নগদ অর্থ পায়।

আরব আমিরাতে ঈদ
আমিরাতে ঈদ মানেই ‘ওউজি’ নামক একটি বিখ্যাত স্থানীয় খাবার। উৎসবের জন্য একচেটিয়াভাবে দেশজুড়ে এটি প্রস্তুত করা হয়। দীর্ঘ সময় নিয়ে রান্না করা খাবারটির মধ্যে রসালো ছাগলের মাংস ও ভাতের মিশ্রণ থাকে। এর সঙ্গে ভাজা পাইন বাদাম দেওয়া হয়। দিনটিতে আমিরাতিরা বাহারি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এতে ম্যাজিক ট্রিকস খুব জনপ্রিয়।

ইরাকে ঈদ
ইরাক বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা মেসোপটেমিয়ার জন্য সারা বিশ্বের বুকে গৌরবে মহীয়ান। রমজান এবং ঈদের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি উৎসবে ইরাকিরা বেশি গুরুত্ব দেয় খেজুরের ওপর। ক্লাইচা (বাদাম, খেজুর এবং গুলকন্দ দিয়ে তৈরি) নামের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার ইরাকে খুব প্রচলিত যা না থাকলে ইরাকিদের যেকোনো অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।

চীনে ঈদ
সকাল বেলা ঈদের নামাজ শেষে চাইনিজ মুসলিমরা পূর্বপুরুষদের স্মৃতি রোমন্থন করে দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিলি করে। তাছাড়া সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নিহতদের জন্য বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থাও করা হয় এই দিনটিতে।

মিসরে ঈদ
পিরামিডের এই দেশ ঈদ যাপনের ¶েত্রে অন্য দেশের চেয়ে এগিয়ে। একটানা চার দিন ঈদ উদযাপন হয়। মজাদার সব মাছের রান্না উৎসবকে করে তোলে রঙিন। নীলনদের দেশটির অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো ‘ফাত’, যা ভাত, মাংস, পেঁয়াজ, ভিনেগার ইত্যাদির মিশ্রণে রান্না করা হয়।

নাইজেরিয়ায় ঈদ
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া। প্রায় ২২ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটির অর্ধেক মুসলিম। আর তাই ঈদ বেশ ঘটা করেই পালিত হয় দেশটিতে। অধিকাংশ নাইজেরিয়ান মুসলমান থাকেন দেশটির উত্তর প্রান্তে, সেখানে রোজার ঈদের স্থানীয় নাম আস সাল্লাহ, যার অর্থ সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো। আর স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে নতুন পোশাক পরে প্রতিটি পরিবারের নারী-পুরুষ ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে ঈদের সকালে নামাজে যায়, যা স্থানীয় ভাষায় ‘দুরবার’ নামে পরিচিত। ঐতিহ্যবাহী খাবারে মাঝে সুয়া (শিক কাবাবের মতো খাবার), জল্লফ রাইস (টমেটো, মশলা এবং নানা সবজি দিয়ে রান্না করা ভাত) এবং মইন মইন (সেদ্ধ মটরের পুডিং) খাবার ঈদের আমেজকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

কেনিয়ায় ঈদ
ঈদের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কেনিয়ানদের ঈদ আনন্দ শুরু হয়ে যায়। রাস্তায় রাস্তায় সবাই নেমে আসে উৎসবের আনন্দে। পছন্দের কাপড় চোপড় কেনে নিজের জন্য, প্রিয়জনের জন্য, পরিবারের সদস্যদের জন্য। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, কিছু কিছু জায়গায় ঈদ উপল¶্যে রাস্তার ওপর জমে ওঠে গল্প বলার আসর। গল্পবলিয়েরা এদিন শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য রূপকথার গল্প শোনান। শিশুদের কাছে এটা বিশেষ আনন্দের। আর এই আনন্দ একমাত্র ঈদ উপল¶্যইে পাওয়া যায়।

ঈদ মুসলমানদের মধ্যে ধনী-দরিদ্র, বর্ণ-গোত্র, ভাষা, ভৌগোলিক অবস্থানগত পার্থক্য ও উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়ে ঈদের নামাজের জামাতে সমস্ত মুসলমানদেরকে এক কাতারে শামিল করে।

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য