ইয়েমেনিরা অবশ্য এর ধারেকাছে ঘেঁষে না। এমনকি নাম বলতেও ভয় পায়। তাদের ধারণা, নাম উচ্চারণ করলে অভিশাপ নেমে আসতে পারে। কাছে গেলে এর বিশাল হাঁ করা মুখ চোখের নিমেষে ভেতরে টেনে নেবে তাদের। এটি একটি কূপ। বিশাল এক হাঁ-মুখ এই কূপের। তার গভীর থেকেও গভীরে দেখা যায় না কিছুই।
নাম বারহুট কূপ। তবে নামে কূপ হলেও তা জলহীন। অথচ তাকে জুজুর মতো ভয় পায় ইয়েমেনের মানুষ। এটি রয়েছে ইয়েমেনের আল-মাহার প্রদেশের একটি মরুভূমিতে। প্রায় ১০০ ফুট চওড়া কূপটির গভীরতা ১১২ মিটার বা ৩৬৭ ফুট। একটি প্রমাণ মাপের ৩০ তলা বাড়ি অনায়াসে ঢুকে যাবে এই কূপের ভেতর। ইয়েমেনের মানুষ ঐ নাম মুখেও আনেননা। বারহুটকে তারা ডাকে ‘ওয়েল অভ হেল’ বা ‘নরকের কূপ’ বলে। বিশ্ববাসীর কাছেও বারহুটের এই নামটিই বেশি জনপ্রিয়।
বারহুটকে ঘিরে তৈরি হওয়া অতিপ্রাকৃত ধারণার অবশ্য একটা ভিত্তি আছে। তা হলো, কয়েকশো বছর ধরে প্রচলিত ইয়েমেনের কিছু উপকথা। যেখানে বারবার এই কূপের উল্লেখ করা হয়েছে ‘জিনদের কারাগার’ হিসেবে। এ প্রসঙ্গে ‘আরব্য রজনী’র আখ্যানে আলাদিনের ‘বন্ধু’ জিনের কথাও মনে পড়ে। আলাদিনের জিন যদিও প্রদীপে বন্দি ছিল। ইয়েমেনের উপকথায় দাবি, দুষ্ট জিনদের বন্দি করে রাখতেই এই অন্ধকূপ তৈরি হয়েছিল। এখানে একবার ঢুকলে সাধারণ মানুষের বেঁচে ফেরা অসম্ভব।
এমন নানা সংস্কার এবং ভয়ের কারণে এতদিন বারহুটের রহস্য জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। হাজার নাকি শত বছর ধরে এই কূপ রহস্য বয়ে বেড়াচ্ছে তার সঠিক কোনো তথ্যও নেই। ইয়েমেনিদের কখনো সাহসে কুলোয়নি কূপের রহস্য ভেদ করার। তবে মরুভূমির মাঝখানে ওই গর্তের ভেতর কী আছে, তা জানতে ভূতাত্ত্বিকেরা বরাবরই আগ্রহী ছিলেন। সম্প্রতি সেই আগ্রহ মেটানোর সুযোগও হয়েছে। ওমানের ১০ জন গুহাবিদ যাবতীয় সংস্কারকে পরোয়া না করে বারহুট অভিযানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এদের মধ্যে আট জন কূপের ভিতর প্রবেশ করেছিলেন। বাকিরা তাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিলেন।
ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৬৭ ফুট গভীরে বারহুটের তলদেশ। দিনের সব সময় সেখানে ভালো করে আলোও পৌঁছায় না। ওমানি গুহা বিশেষজ্ঞদের বারহুটের তলদেশ স্পর্শ করতে প্রায় অর্ধেক দিন লেগে যায়। তবে যে তথ্য তারা সংগ্রহ করেন, তার কাছে ওই পরিশ্রম কিছুই না। বারহুটে কোনো ‘জিন’ বা দৈত্যের দেখা পাননি তারা। কোনো লোহার শলাকা গাঁথা কারাগারেরও নয়। তবে অদ্ভুত একটা গন্ধ পেয়েছেন।
গুহার ভেতরে বহু পশুপাখির মৃতদেহ পড়ে ছিল। গন্ধটি সেসব থেকেই তৈরি হয়েছে বলে প্রাথমিক অনুমান গুহা বিশেষজ্ঞদের। তারা জানিয়েছেন, গন্ধটি পচনের নয়। অসহনীয়ও নয়। গন্ধের কারণ জানতে তারা মৃত পশুপাখির দেহগুলো সংগ্রহ করে এনেছেন। এ ছাড়াও গুহার মাটি, পাথর, বৃষ্টির জমা পানির নমুনা এনেছেন।
গুহার নিচে এক ধরনের উজ্জ্বল সবুজ নিটোল গোল পাথরেরও সন্ধান পাওয়া গেছে । একঝলকে দেখে মনে হতে পারে পাতিলেবুর রঙের এবং আকারের মুক্তা। তবে আসলে সেগুলো মুক্তা নয়। গুহার ভেতর চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির পানির ক্যালসিয়াম থেকে এই ধরনের পাথর তৈরি হয়। নাম ‘কেভ পার্ল’ বা ‘গুহা-মুক্তা’।
গুহার ভেতর চুনাপাথরও পেয়েছেন ওমানিরা। তবে এসব কিছুর থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান যে বিষয়টি তারা আবিষ্কার করেছেন, তা হলো- সত্যি। এতদিন ধরে যে ভয় ইয়েমেনিদের কাবু করে রেখেছিল, প্রকৃত পক্ষে তা যে ভিত্তিহীন, ওমানের এই গুহা বিশেষজ্ঞরা তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। বারহুটের কূপের সঙ্গে অন্যসব প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট গহ্বর বা গর্তের গঠনগত তেমন পার্থক্য নেই, তা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন।
গুহাবিদদের কথায়, এই ধরনের গহ্বরকে বলা হয় ‘সিঙ্কহোল’। ভূপৃষ্ঠের নিচে জমে থাকা পানিতে পাথর ধীরে ধীরে দ্রবীভূত হয়ে গেলে এমন গর্ত তৈরি হয়। বাহরুটের মতো কূপ তৈরি হতে লক্ষাধিক বছর সময় লেগে থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান। তারা জানিয়েছেন, এর সঙ্গে দুর্ভাগ্য, বিপদ বা আতঙ্কের কোনো সম্পর্ক নেই।
কিছুদিন আগেই ইয়েমেন সরকার জানিয়েছে, তারা বারহুটে ৫০ মিটারের নিচে নামতে পারেননি। যারা নেমেছিলেন তারা ভয় পেয়েছিলেন। ওমানি গুহাবিদরা অবশ্য জানিয়েছেন, তারা কোনো রকম ভয়কে গুরুত্বই দেননি। অজানাকে জানার অদম্য ইচ্ছেই ‘নরকের কূপে’র মাটি স্পর্শ করতে তাদের সাহায্য করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত সত্যিটা জানতে এবং জানাতে পেরে তারা গর্বিত। গুহাবিদদের ধারণা, হয়তো কোনো উপকথায় কোনো দিন তাদের এই আবিষ্কারের কথাও লেখা হবে। আর সেটাই হবে তাদের পুরস্কার।