১.
গ্রামের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলেদের নিয়ে যদি তালিকা তৈরি করা হয় তাহলে যার নামটা থাকবে সবার উপরে সর্বাগ্রে সে হলো সকলের পরিচিত দুষ্টের শিরোমণি দেলোয়ার। সবাই যাকে চিনে দুষ্টু দিলু নামে। সারাদিন এখান থেকে ওখানে ছুটে বেড়ানো, আম্মুর কথা না শোনা, বেলা-অবেলায় বল-ব্যাট হাতে বেরিয়ে পড়া, সমবয়সী ছেলেদের সাথে ঝগড়া বাধানো, কারণে অকারণে মারামারি করাÑ এ-ই যেন তার নিত্যকর্ম, এককথায় সকলের কাছেই ও পরিচিত ভীষণ ডানপিটে আর দুরন্তর হিসেবে।
দেলোয়ারের আব্বু-আম্মু বড় বিপাকে পড়েছেন ছেলেকে নিয়ে। একের পর এক বিচার শুনতে শুনতে তারা যেন ভীষণ বিরক্ত। কান যেন ঝালাপালা হয়ে গিয়েছে ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে শুনতে। আম্মু যে কতবার কতভাবে ওকে বুঝিয়েছেন, কখনো পিঠে হাত বুলিয়ে, কখনো বা দুধ-ভাত খাইয়ে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। অবস্থা সেই আগের মতই। এরপর যখন বুঝিয়ে-সুঝিয়েও কোন কাজ হয়নি তখন শুরু করেছেন পিটুনি দেয়া। কিন্তু এতেও কিছু হয়নি। অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। যেই সেই।
২.
প্রতিদিনের মত সেদিন বিকেলেও বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলেন দেলোয়ারের আব্বু বশির মিয়া। তীব্র গরমে শরীর হতে দরদর করে ঘাম ঝরছিল তার, ভীষণ বিরক্তবোধ করছিলেন, এমন সময় হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়লো গ্রামের পূর্ব পাশের খেলার মাঠটির দিকে, দেখতে পেলেন, গ্রামের সবগুলো ছেলে একসাথে হয়ে কী যেন করছে। কৌতূহল জাগলো বশির মিয়ার মনে। ছেলেগুলো খেলা বাদ দিয়ে একসাথে জড়ো হলো কেন? তৎক্ষনাৎ তিনি ছুটে গেলেন সেদিকে, কাছে আসতে না আসতেই তার কানে ভেসে এলো একটা ছেলের চিৎকার ধ্বনি। মনে হলো এ যেন পাশের বাড়ির করিমের ছেলের চিৎকার, দ্রুত এগিয়ে আসলেন তিনি জটলার দিক লক্ষ্য করে। এসে যা দেখলেন তাতে ‘থ’ হয়ে গেলেন তিনি। একেবারে যা ধারণা করেছিলেন হুবহু তাই। দেখলেন, ছেলেটা মাথায় দুই হাত চেপে ধরে জোরে জোরে চিৎকার করছে, আর হাত দুটো রক্তে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে। বশির মিয়াকে দেখার সাথে সাথে সবগুলো ছেলে দৌড়ে এলো তার দিকে, নালিশের সুরে বলতে লাগলো যে, দেলোয়ার খেলার মাঝখানে আরিফের সাথে ঝগড়া বাধে। ঝগড়া তুমুল পর্যায়ে চলে গেলে আরিফ রাগে ওকে ঘুষি দিয়ে দৌড় দেয়। দেলোয়ার ও পিছু নেয় আরিফের। কিন্তু একসময় আরিফকে ধরতে না পেরে পাথর ছুঁড়ে ওর দিকে, আর সে পাথর আরিফের মাথার এককোণে লাগলে ওখান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে।
সব শুনে দেলোয়ারের আব্বু যেন আকাশ থেকে পড়লেন। রাগে কটমট করে তাকালেন ওর দিকে। কিন্তু সময় ক্ষেপণ করলো না দেলোয়ার। আব্বু ওর দিকে তাকাতেই ও দিলো ভোঁ দৌড়। তবে বশির মিয়া ছেলের পিছনে ছুটে সময় নষ্ট না করে আগে আরিফকে নিয়ে গেলেন বাজারের এক ফার্মেসিীতে। সেখান থেকে ব্যান্ডিজ বেঁধে ওষুধ-পথ্য নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। ঘরে আসামাত্রই দেখলেন, দেলোয়ার ওর আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, আর বলছে, দেখ আম্মু! আমিতো আর ইচ্ছে করেই এমনটা করিনি। হঠাৎ বেশি রেগে গিয়েছিলাম। তাই রাগের বশে ওর দিক লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ি। পাথর যে ওর মাথায় লাগবে আমি কি তা জানতাম!
আব্বু তো প্রথমে তেড়ে এসছিলেন ওকে মারতে। কিন্তু আম্মু অনেক জোর করে বিরত রেখেছেন তাকে। সেদিনের মত তিনি আর কিছু করলেন না।
৩.
এই ঘটনার পর চিন্তায় পড়ে গেলেন দেলোয়ারের আব্বু-আম্মু। হতাশা জন্ম নেয় উভয়ের মনে। ভাবেন, ছেলেটা কি তাহলে এভাবেই শেষ হয়ে যাবে? আব্বু-আম্মু উভয়েই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে লাগলেন, যত দ্রুত সম্ভব একটা উপায় অবশ্যই বের করতে হবে। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না আম্মুর। হঠাৎ মনে পড়ে গেল পাশের বাড়ির হানিফ মিয়ার ছেলেটার কথা, ছেলেটার আমূল পরিবর্তনের কথা। আম্মু বললেন, পাশের বাড়ির হানিফ মিয়ার ছেলেটাকেও তো দেখতাম অনেক দুষ্টুমি করতো। সবাই অতিষ্ঠ হয়ে থাকতো ছেলেটার দুষ্টুমিতে। কিন্তু যেদিন ওর আব্বু ওকে মাদরাসায় ভর্তি করালেন এরপর থেকেই যেন ওর মাঝে পরিবর্তন টের পাওয়া যেতে লাগলো। সেদিন তো আমাকে দেখেই কত সুন্দর করে জিজ্ঞেস করলো, চাচি মা! কেমন আছেন? আচ্ছা! ওকে মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দিলে কেমন হয়?
সব শুনে আব্বু সায় দিলেন আম্মুর কথায়। বললেন, আমার তো দীর্ঘ দিনের আকাক্সক্ষা, আমাদের আদরের মানিকটাকে মাদরাসায় ভর্তি করাবো, হাফেয আলেম বানাবো, কিন্তু ওর বয়সের দিকে লক্ষ্য করে বিরত থাকছিলাম। আচ্ছা, আগামি সপ্তাহে ওকে নিয়ে ইনশাআল্লাহ শহরের মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসবো।
৪.
একসপ্তাহ পর আব্বু-আম্মু ওকে নিয়ে গেলেন শহরের এক বড় মাদরাসায়। হুযূরদের সাথে কথা বলে ওখানে ভর্তি করে চলে আসলেন বাড়িতে।
প্রথম প্রথম দেলোয়ারের সবসময় মন খারাপ থাকতো। আব্বু-আম্মুর কথা মনে পড়তো। সমবয়সী বন্ধুদের সাথে খেলাধুলার স্মৃতিগুলো বারবার মনে ভেসে উঠতো আর কান্না পেত। কিন্তু হুযূরের আদর-স্নেহ আর সমবয়সী বন্ধুদের দুষ্টুমি খুনসুটিতে ও ভুলে যায় সব। এখন আর মন খারাপ হয় না। হুযূর মাঝে মধ্যে ওকে চিপস, চকলেট কিনে দেন। এভাবে কেটে যায় কয়েক মাস। দেলোয়ারও অভ্যস্ত হয়ে যায় মাদরাসার আলোকিত পরিবেশে। সেই সাথে ও এখন আর কারো সাথে দুষ্টুমি করে না। শুধু শুধু কাউকে কষ্ট দেয় না, পড়াশোনায় পূর্ণ মনযোগ দেয়। হুযূর যা বলেন তা-ই মেনে চলে।
৫.
দীর্ঘ দু’মাস মাদরাসায় থাকার পর আসে প্রথম সাময়ীক পরীক্ষার ছুটি। ছুটিতে পাশের বাড়ির মাসুম বিল্লাহর সাথে বাড়ি আসে দেলোয়ার। ঘরে ঢুকেই প্রথমে সালাম দেয় আব্বু-আম্মুকে। আম্মু তো ওকে দেখামাত্রই কেঁদে ফেলেন। তবে সেই কান্না ছিল আনন্দের। পরম প্রাপ্তির। আব্বু-আম্মুর সাথে দেখা করে ও ছুটে যায় চাচা-চাচির সাথে দেখা করতে। সবাই তো অবাক! একসময়ের পুরো গ্রাম অতিষ্ঠ করে তোলা সেই ছেলেটা আজ কত ভালো হয়ে গেছে। সবাই খুশি হয়ে দোয়া দেয় ওর জন্য।
৬.
একদিনের ঘটনা, যোহর নামায শেষে মসজিদ থেকে ঘরে ফিরছিলো দেলোয়ার। উঠোন দিয়ে আসার সময় হঠাৎ ওর দৃষ্টি আটকে যায় মাথায় বস্তা বহনকারী একবৃদ্ধকে দেখে। লোকটি বস্তা নিয়ে হাঁটছিলো, কিন্তু পারছিলো না। হাঁপিয়ে উঠছিলো। তা দেখে ও দৌড়ে আসে বৃদ্ধের কাছে। নম্রস্বরে বলে, দাদু ভাই! আপনার তো অনেক কষ্ট হচ্ছে, দেন, আপনার বস্তাটা আমি নিয়ে যাই।
বৃদ্ধ প্রথমে দিতে চাইলো না। কিন্তু ওর পীড়াপীড়িতে দিতেই হলো। দেলোয়ার বস্তাটা বৃদ্ধের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিলো। তবে আসল ঘটনা কিন্তু ঘটেছিল অন্যখানে। সেটা হলো, বস্তা নিয়ে যাওয়ার সময় ওর বড়চাচ্চু দেখে ফেলে ওকে, এমন একটা মহৎ কাজে ওকে নিয়োজিত দেখে চাচ্চুর বুকটা গর্বে ফুলে উঠে। বাড়িতে এসেই চাচ্চু পুরো ঘটনা শোনান চাচীকে। চাচী শোনান দেলোয়ারের আম্মুকে। এভাবে সারাগাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে ওর ভালো কাজে সাহায্য করার এই ঘটনা।
বস্তাটি বৃদ্ধের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার পর ও ঘরে ফিরলে আম্মু দৌড়ে এসে চুমু খান ওর কপালে। কোলে তুলে নেন আদরের মানিকটাকে। আব্বু-আম্মু উভয়ই শোকরিয়া আদায় করেন আল্লাহর কাছে। দেলোয়ারের হঠাৎ এমন পরিবর্তন দেখে অবাক হয় সবাই। সকলেই মন থেকে দু’আ করে দেলোয়ারের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য।