পিতৃপ্রিয়

হাকিমের ফিরার খবর শুনে খাদীজা তার ঘরে ছুটে গেলেন। আরো অনেক আত্মীয়-স্বজনই তার ঘরে এসে ভিড় জমিয়েছে। সবার ব্যাকুলিত হৃদয়ে একটিমাত্র অব্যক্ত কৌতূহল ক্ষণে ক্ষণে ফুঁড়ে উঠছেÑ উকায মেলা থেকে কার কী আনা হয়েছে।
উকায মেলা জাহেলী আরবের বিখ্যাত একটি মেলা। বহু বছর ধরে আরবের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে এটি। এই রমরমা মেলায় বর্ণিল সাজে সেজে উঠে উকায প্রান্তর।
সবার ব্যাগ্রদৃষ্টি উকায থেকে নিয়ে আসা হাকিমের রঙ-বেরঙের রাশিকৃত পণ্যগুলোর উপর নিবদ্ধ। প্রত্যেকের আবদার মতো হাকিম তাদের হাতে কাক্সিক্ষত জিনিসটি তুলে দিচ্ছে।
লোকে বলে যার ধন আছে তার মন নেই। কিন্তু মক্কার বিখ্যাত এই বংশের সামনে কথাটি ভিত্তহীনতার দুর্নামে লজ্জিত হতে বাধ্য। ধন-সম্পদে তাদের যেমন রয়েছে সাগরের প্রচুরতা, তেমনি মনেরও আছে মরুভুমির প্রশস্ততা। তাদের কাছে এসে খালি হাতে ফিরে যাওয়ার মতো অভিযোগ কখনো কেউ শুনেছে কী না সন্দেহ।
চকিতে খাদীজার দিকে ফিরে হাকিম বলতে লাগলোÑ ফুফু! মেলা থেকে কয়েকটা বালক ক্রয় করে নিয়ে এসেছি। ভাবছি আপনাকে একটা উপহার দিবো। এদের মধ্য থেকে আপনার পছন্দমতো একজনকে নিয়ে যান। খাদীজার দৃষ্টি যায়েদ নামক একটি আটবছরের বালকের চোখে আটকে গেলো। কী সুকুমার সুললিত!
দৃষ্টিতে নেই রুক্ষতা। আছে তীক্ষ্নতা, পেলবতা আর দৃঢ়তার অদ্ভুত মিশেল। গোলাপের পাপড়ির মতো স্মিত দুটি অধর। খুব পছন্দ হলো তাকে খাদীজার।
গোলাম নয়- সন্তানের মতোই আদর-স্নেহে মাতৃমমতায় বড়ো করতে লাগলেন যায়েদকে।
খাদীজার যখন বিয়ে হলো মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে, মক্কায় দুটি নক্ষত্র যেনো একত্রিত হলো। জ্ঞানের গভীরতায়, চরিত্রের মধুরতায় এবং গুনের বিচিত্রতায় যেনো একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নিরত।
খাদীজা ভাবলেনÑ বিয়ে উপলক্ষে স্বামীকে নিজের সবচেয়ে প্রিয় ও আকর্ষণীয় জিনিসটি উপহার দিবেন। প্রিয় জিনিস নির্ণয় করতে তার খুব একটা ভাবতে হলো না। মূল্যবান অন্য সবকিছুকে অতিক্রম করে খুব সহজেই মাথায় আসলো কিশোর যায়েদের নাম।
এবার খাদীজার মাতৃমমতার সাথে যুক্ত হলো মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহহি ওয়া সাল্লাম) পিতৃস্নেহ। দুজন হয়ে গেলেন যায়েদের অঘোষিত পিতা-মাতা। তাঁদের সান্নিধ্য সৌরভে যায়েদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটতে লাগলো।
এখানে সে আরাম আয়েসে নিরুদ্বেগ জীবন যাপন করলেও নিখোঁজ সন্তানের বিরহে শোকাকুল হয়ে আছেন তার জন্মদাতা মাতা-পিতা। মায়ের সাথে নানার বাড়ি যাওয়ার পথে দস্যুদের হাতে লুণ্ঠিত যায়েদ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মায়ের কাছ থেকে। এরপর কয়েক হাত বদল হয়ে এখানে এসে পৌঁছে।
পুত্রের বিয়োগে যায়েদের মা স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। হতাশার নিকষ অন্ধকার গভীর খাদে নিমজ্জিত হয়ে তিনি হাতড়ে বেড়ান পুত্রের সাথে তার বিভিন্ন আনন্দ বেদনার স্মৃতি। তখন শোক আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। পুরো পৃথিবীটাকে তাঁর কাছে মরুভূমির মতো জনমানবহীন লাগে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে উন্মাদিনীর মতো আচরণ করতে থাকেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে যেনো নেমে এসেছে মরুভূমির শুষ্কতা।

আশেপাশের কোন কাফেলা চষে ফেলার বাকি রাখলেন না যায়েদের পিতা। চেনা-অচেনা সব এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরলেন। কিন্তু যায়েদের গন্ধটিও পেলেন না। পুত্রের খোঁজে শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ান দিকভ্রান্তের মতো। পুত্রের বিরহে যায়েদের পিতা যে মর্মভেদী শোকসঙ্গীত রচনা করেছেন তা যে কোন পাষণ্ডের হৃদয়কেও বিগলিত করতে যথেষ্ট।
পিতা-মাতার এখন একটিই শুধু আকুতি- আদরের ধনটি বেঁচে আছে না মরে গেছে এটুকু জানতে পারলেই তারা খুশি।
আরবের মরুভূমির উপর দিয়ে বহতা নদীর মতো বহু সময় বয়ে গেলো। কতো কিছু ঘটে গেলো। শুধু যায়েদের হদিসটুকু পাওয়া গেলো না।
এক হজ্বের মৌসুমে যায়েদের স্বগোত্রীয় একটি হজ্বের কাফেলা মক্কায় উপস্থিত হলো। বাইতুল্লাহ তাওয়াফের সময় তারা চমকিত হলো। অভাবিত। অপ্রত্যাশিত। যায়েদ যে!
নিজের গোত্রের লোকদের দেখে যায়েদেরও আনন্দের শেষ নেই। হজ্ব শেষে তারা যায়েদের বর্তমান অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে তার পিতাকে সবিস্তার সুসংবাদ জানালো। পিতা-মাতা উভয়ে যেনো নতুন করে জীবন লাভ করলেন।
পরিবার-পরিজন আত্মীয়-স্বজন-খুশিতে সকলের প্রাণ আকুল। আনন্দে সকলের চিত্ত বিহ্বল।

যায়েদের পিতা হারেসা কোন কালবিলম্ব না করে নিজের কলিজার টুকরার মুক্তিপণের অর্থসমেত ভাই কা’বকে সঙ্গে করে মক্কার উদ্দেশ্যে সফর শুরু করলেন। তপ্ত মরুভূমিতে অবিরাম সফর। অক্লান্ত অবিশ্রান্ত। এ যে বহু দিনের হারানো মানিকের উদ্দেশ্যে সফর!
বালিয়াড়ির প্রতিটি বালুকণা যেন তাদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

মক্কায় পৌঁছে তারা সরাসরি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাড়িতে গিয়ে হাযির হলেন। এখানে আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে তারা আরয করতে লাগলেন- হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর! আপনারা পবিত্র কাবার সম্মানিত প্রতিবেশী এবং মহামান্য খাদেম। আপনারা দুঃখীদের দুঃখহারী, অভাবগ্রস্তদের অভাব পুরণকারী, বিপদগ্রস্তের বিপদ বিদূরণকারী। আমরা একটি বিনীত আবেদন নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। আমাদেরই প্রিয় সন্তান বিক্রিত দাসরূপে আপনার কাছে অবস্থান করছে। আমরা সন্ধান পেয়ে তাকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে এসেছি। এর বিনিময়ে আপনাকে যতো দরকার দিতে রাজি আছি।
-কে সে আপনার সন্তান? -মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দরদমাখা প্রশ্ন।
-যায়েদ বিন হারেসা- একসাথে বলে উঠলো উভয়ে।
-আমার কোন মুক্তিপণের প্রয়োজন নেই। যায়েদ আপনাদের সাথে চলে যাবে না এখানেই থেকে যাবে- এ সিদ্ধান্ত বরং সে নিজেই নিবে। সে চলে যেতে চাইলে আমার পক্ষ থেকে কোন বাধা নেই। আর আমার কাছে থেকে যেতে চাইলেও কোন আপত্তি নেই।

এর চেয়ে সুন্দর ফায়সালা আর কী হতে পারে! এটাই হবে- হারেসার উচ্ছ্বসিত সম্মতি।
-তোমার বাবা এসেছেন তোমাকে নিয়ে যেতে, তুমি কী বলো?
-না আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না!
বুকটা ধুক্ করে উঠলো পিতার।
মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও পরিকল্পনা টুকরো টুকরো হয়ে শুকনো পাতার মতো চারদিকে উড়তে লাগলো।
যায়েদের এমন দৃপ্ত অস্বাভাবিক উত্তর শুনে তার পিতা ও চাচা থতমত খেয়ে গেলেন। অপ্রতিভ ও বিব্রত হলেন।
তাহলে কি তুমি স্বাধীন জীবন ত্যাগ করে দাসত্বের শৃঙ্খলেই আবদ্ধ থাকতে চাও? -ছেলের প্রতি পিতার সকরুণ জিজ্ঞাসা।
আল্লাহর শপথ! আমি মুহাম্মাদের মধ্যে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন অপূর্ব অভাবিত গুণ ও স্বভাব-চরিত্র পেয়েছি, যা ছেড়ে আমি অন্য কোথাও যেতে পারবো না।
সন্তানের এমন দৃঢ় সংকল্প শুনে পিতার পরম আশ্বস্ত হওয়ার আর কী বাকি থাকে?
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুশি হয়ে যায়েদকে নিয়ে কাবা চত্বরে হাজরে আসওয়াদের সামনে জনসম্মুখে ঘোষণা দিলেন- হে লোকসকল! সাক্ষী থাকো তোমরা- যায়েদ আজ থেকে আমার পুত্র আর আমি যায়েদের পিতা। সে আমার উত্তরাধিকারী আমিও তার উত্তরাধিকারী।
যায়েদ আজীবন তার এই পিতৃপ্রিয় পিতার কাছেই থেকে গেলো।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য