প্রাণের প্রদীপ বইমেলা

প্রাণের প্রদীপ বইমেলা

অনেকে বলে থাকেন অহি থেকে বহি। আর বহি থেকে বই। তবে অহির কথাগুলোর একত্র যে নাম তা-ই কিতাবুল্লাহ। আল্লাহর কিতাব। মহাগ্রন্থ। পৃথিবীতে এরচেয়ে বেশি ছাপা হয়েছে এমন কোনো গ্রন্থ নিশ্চয়ই নেই। ছাপা ছাড়াও এ গ্রন্থ মুমিনের হৃদয়জুড়ে আটকে আছে। লাখো লাখো শিশু, কিশোর, তরুণ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মুখস্থ করে রেখেছে মহান আল্লাহর এই কিতাব। এরচেয়ে বেশি কোনো গ্রন্থ কখনোই পাঠ হয় না।
হ্যাঁ, বই থেকে লাইব্রেরি। অনেকগুলো লাইব্রেরি মিলে যে আয়োজন হয় তা-ই বইমেলা। বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের মনে বইমেলা মানেই একুশে বইমেলা। কেবল দেশে ফেব্রুয়ারি মাসের সেই মেলাই একমাত্র মেলা নয়। বরং ঢাকা বইমেলা, বাইতুল মোকারম চত্বরে ইসলামী বইমেলা, বিভাগ বা জেলা ভিত্তিক মেলার যাত্রাও এখন শুরু হয়েছে। ইদানিং রাজধানীতে বা বিভিন্ন জেলায় ইসলামী প্রকাশনীগুলো কিতাবমেলা শুরু করেছে। কিতাব মানেও বই। ঘুরেফিরে কিতাবমেলা মানে বইমেলা। কেবল উচ্চারণে একটু পার্থক্য।
একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমির সামনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। একাডেমির চত্বরেও কিছু স্টল থাকে। এটা ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হচ্ছে। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকা। বই আনন্দ কেবল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই নয়, দোয়েল চত্বর ছাড়িয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে পুরো ঢাকার শহরে।
এই বই, ভাষা, মায়ের গর্বের আকুতির জন্য শরীরের খুন দিতে হয়েছে বাংলাদেশের দামাল ছেলেদের। সেই দামাল তারুণ্যই মূলত মায়ের গর্বের ভাষা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছে। আট ফাল্গুন বা একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে বাঙালি তারুণ্য।
ইতিহাস : বাংলাদেশের বইমেলার ইতিহাস সুপ্রাচীন। স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই অতীতের কথা। যতদূর জানা যায়, বইমেলার গল্পটা শুরু হয় ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে। সে বছর ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা মাত্র ৩২টি বই নিয়ে বসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে। বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা বই সাজিয়ে বইমেলার সূচনা করেন। চিত্তরঞ্জন সাহা শুরুতে স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ নামে একটা প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। পরে এটি মুক্তধারা প্রকাশনীতে রূপ নেয়। সেই বত্রিশটি বইয়ের স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান।
চিত্তরঞ্জন সাহা একাই ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বইমেলা চালিয়ে যান। পরে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হয়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ অন্যরা যুক্ত হতে শুরু করে। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সালে বর্তমানের একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে।

বোধকে জাগায় বই
বই ভালো সঙ্গী। দুনিয়ার সব সঙ্গী একসময় চলে যায়, মরে যায়, কোনো কারণে হারিয়ে যায়- কিন্তু এই বই হারায় না সহজে। চাইলেই সঙ্গী হয় বই। পথ চলে বাসে, ট্রেনে, মোটরে এমনি সমুদ্র বা বিমান যাত্রায়। সবখানে বই সঙ্গে রাখা যায়। বই বার বার সহযোগিতা করে। পথ চিনিয়ে দেয়। শাসন করতে পারে। একই বই বার বার পড়েও স্বাদ নেওয়া যায়। শিশুরা বই ভালোবাসলে জিতে যায়। কিশোর আরও বেশি জিতে। কারণ, বিশেষত শহরের ছেলে-মেয়েরা বইকে সঙ্গে পেলে তাদের নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারে। যারা বই পড়েন তাদের বোধ জেগে ওঠে।

রকমারি আয়োজন
বইমেলায় এখন রকমারি আয়োজন দেখা যায়। চেনা যায় সমাজের সবচেয়ে ভালো মানুষদের পথচলার প্রয়াস। মেলায় থাকে ভিন্ন ভিন্ন স্টল বরাদ্দ। গণমাধ্যমগুলোর নিজেদের সম্প্রচারের জন্য আলাদা স্টল, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা স্টল, লিটল ম্যাগের আলাদা পরিসর, সাংস্কৃতিক ও নাটকের প্রকাশনার আলাদা স্টল, লেখকদের জন্য আলাদা কর্নার, শিশুদের জন্য আলাদা কর্নার। এখন বিভিন্ন জায়গায় বসার জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শারীরিক বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা, মোড়ক উন্মোচনের জন্য আলাদা মঞ্চ, গণমাধ্যমকর্মীদের কাজ করার জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিধা, খাবার বা পানীয়ের জন্য আলাদা আয়োজন, মলমূত্রের জন্য আলাদা ব্যবস্থা- এটা অসাধারণ অগ্রগতি হয়েছে মেলার। পুরো মেলা থাকে সিসিটিভির আওতায়।

কী কী বই প্রকাশিত হয় মেলায়
ছোটদের ছড়া, শিশুতোষ গল্প, সংগীতের বইসহ উপন্যাস, কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, ভ্রমণ, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সায়েন্স ফিকশন, রহস্য, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য, অনুবাদ, নাটক, সঙ্গীত, রাজনীতি, রম্য, ধর্ম ও বিবিধ বিষয়ের ওপর লেখকদের বই পাওয়া যায় মেলায়। ক্রমশ বাড়ছে মেলায় সৃষ্টিশীল লেখনী এবং প্রকাশকও। অবশ্য এরপরও গুণীজনরা বলে থাকেন, মানসম্মত বইয়ের সংখ্যা কম। একসময় আলেম লেখকগণ সেরকম বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় যেতেন না। তবে এখন বিশেষত তরুণ আলেমগণ যাতায়াত শুরু করেছেন। লিখছেনও। সাহিত্যের সব শাখায় তাদের বিচরণ দেখা যাচ্ছে।

যেভাবে হয় প্রকাশনী নির্বাচন
বইমেলায় যে প্রকাশনী থাকবে সেগুলো একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অংশ নেয়। সেটি অনেক আনন্দেরও। শেষে লটারিও হয়। তবে মেলায় কোন কোন প্রকাশনা সংস্থার স্টল স্থান পাবে, কেমন স্টল করতে পারবে, তার জন্য বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে আলাদা কমিটি গঠিত হয়। ২০১০ সাল থেকে এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ হয়েছে। প্রকাশিত বইয়ের কপি জাতীয় আর্কাইভ ও জাতীয় গণগ্রন্থাগারে জমা দেওয়া হয়েছে কিনা, কর-নির্দেশক-নম্বর (ঞওঘ) ঠিক আছে কিনা যাচাই করার পাশাপাশি প্রকাশিত নতুন বইয়ের কপি বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা দেওয়ার বিষয়টিও বাধ্যতামূলক রয়েছে। সব ঠিক থাকলেই প্রকাশনা সংস্থা বইমেলায় স্টল পায়।

ই-বুক এবং প্রত্যাশা
পৃথিবী ধীরে ধীরে দখলে নিচ্ছে ই-বুক। একটা সময় হয়তো তথ্যপ্রযুক্তি ও ভার্চুয়াল জগত ছাড়া কোনো কিছুই চিন্তা করা যাবে না। কাগজের বই থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারি একেবারেই। স্কুল-কলেজের শ্রেণিকক্ষেও ভবিষ্যতে কাগজের বই আমরা তুচ্ছ জ্ঞান করতে পারি। শিশুর পেছনে বড় থলে ঝুলিয়ে বই বহনের দায় আর চাপাতেও না পারি। বাংলাদেশের ডিজিটাল অবস্থা সে পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারেনি। একটা সময় এসে যেতে পারে যখন সত্যি সত্যিই আর কাগজের বই থাকবে না। সবাই কিনতে চাইবে ভার্চুয়াল বুক। তখন মেলাও হবে ই-বুকের। ই-বুক মেলা।

বিশ্বের প্রথম বইমেলা
বই বেচাকেনার মেলা বলা হতো ফ্রাংকফুর্টের বইমেলাকে। এটি মূলত বিশ্বের প্রথম বইমেলা। এখন বিশ^জুড়ে অনেক আড়ম্বরপূর্ণ বইমেলা হলেও বইয়ের ইতিহাস অনেক প্রাচীন নয়। মুদ্রিত বইয়ের ইতিহাস কিছুদিন আগের মাত্র। প্রথম মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার হয় ১৫৫৪ সালে জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে। আর তখন থেকেই ছাপানো বই মানুষের হাতে আসে। সম্ভবত ওই বছর বা তার পরের বছর মুদ্রিত বইয়ের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় ওই ফ্রাংকফুর্ট শহরে। বিশ্বের প্রথম বইয়ের মেলা শুরু হয় ফ্রাংকফুর্ট শহরে। ওখানে লেখকদের পাণ্ডুলিপি ক্রয়বিক্রয় হতো। মেলাকে কেন্দ্র করেই লেখক-প্রকাশকের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল জার্মানিতে।

আমরা বই পড়ি। অন্যকে বই পড়তে উৎসাহিত করি। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াই। তবে দ্বীনী বই, সৎচিন্তার বই, মননশীল বই, সৃজনশীল উপাদেয়, আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ভালোবাসাকে বাড়ায় এমন বই সবসময় শিশু-কিশোরের মন রাঙিয়ে দিতে পারে। যে যেমন বই পড়বে সে তেমনই রঙে সুসজ্জিত হবে। বিশেষজ্ঞ লেখক আলেমদের লেখনীও কিশোরদের হৃদয় জাগিয়ে তুলতে পারে। সুন্দর পৃথিবী নির্মাণে অগ্রসর করে দিতে পারে এসব বই। আল্লাহ আমাদের সে সব আলোকিত মানুষদের জ্ঞানের কথা, কুরআন ও হাদিসের কথা বইয়ে বইয়ে জানবার তাওফিক দিন। আমীন।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য