সুরা বাকারা: মুত্তাকির পরিচয় ও পরিণতি
বন্ধুরা! আমরা সবাই জানি কুরআন শরিফের প্রথম সুরার নাম ‘সুরা ফাতিহা’। এরপরের সুরা-ই হলো ‘সুরা বাকারা’। কুরআনুল কারিমের ধারা বর্ণনায় দ্বিতীয় ‘সুরা বাকারা’। যদিও অবতীর্ণের ধারাবাহিকতায় ৮৭ নম্বর সুরা এটি। নবিজি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করলে এ সুরা অবতীর্ণ হয়। নানা প্রেক্ষিতে বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ সময়ে সুরাটি অবতীর্ণ হয়। মদিনাতে নাজিল কৃত মোট সুরা সংখ্যা ৮৫। সুরা বাকারা মদিনায় নাজিল কৃত সুরাগুলোর প্রথম সুরা। এটি কুরআনুল কারিমের দীর্ঘতম সুরা। গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ সুরাগুলোর অন্যতম।
সুরা বাকারার ফজিলত ও মহত্ত্ব অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-যে বাসায় সুরা বাকারা তেলোয়াত করা হয়, সে বাসায় শয়তান প্রবেশ করে না।
[তিরমিজি শরিফ, হাদিস : ২৭৮৫]
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন- সব কিছুরই শিখর ও ডগা রয়েছে। কুরআনুল কারিমের শীর্ষ ডগা ‘সুরা বাকারা’। সুরা বাকারায় একটি আয়াত আছে যেটি সকল আয়াতের সরদার ও কেন্দ্রবিন্দু। আর তা হলো আয়াতুল কুরসি।
[তিরমিজি শরিফ, হাদিস : ২৭৮৬]
এভাবে অসংখ্য হাদিস শরিফ থেকে সুরা বাকারার ফজিলত ও মর্যাদা সুপ্রমাণিত।
বন্ধুরা! সুরা ফাতিহার শেষের দিকে আমরা ‘ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম’ পাঠ করি। এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে ‘সিরাতে মুস্তাকিমে’র আবেদন করে থাকি। আল্লাহর কাছে হেদায়েত চেয়ে থাকি। ‘সিরাতে মুস্তাকিমে’র হেদায়েত বলতে বুঝায়- দীনি দিকনির্দেশনা। জীবন-মরণে চূড়ান্ত সফলতার দিশা। যতবার আমরা সুরা ফাতিহা পাঠ করি, ততবার আমরা আল্লাহর কাছে দীনের সঠিক সরল পথের দোয়া-প্রার্থণা করি। সুরা বাকারা থেকে সুরা নাস পর্যন্ত সে দোয়ারই প্রতি উত্তর। আমাদের সে দোয়ারই প্রতিফলন ও বাস্তবায়ন।
মূলতঃ পুরো কুরআনুল কারিমই ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ নির্দেশক। যে ব্যক্তিই তার জীবনে কুরআনুল কারিমের ফরমান মেনে চলবে, নিশ্চিত সে সঠিক পথের দেখা পেয়ে যাবে। কাক্সিক্ষত গন্তব্যে সহজে পৌঁছে যাবে। অনায়াসে দুনিয়া-আখেরাতে শান্তি-সফলতা অর্জন করতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
বন্ধুরা! সুরা ফাতিহায় পেশকৃত আবেদন মঞ্জুর করে আল্লাহ আমাদেরকে পুরো কুরআন দিয়েছেন। আল্লাহ নিজে বলেন- (অর্থ) আলিফ লা-ম মি-ম! এই কিতাবে কোনো সন্দেহ নেই। এটি মুত্তাকিদের জন্য পথপ্রদর্শক; যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে। নামাজ কায়েম করে এবং আমার দেয়া রিজিক থেকে ব্যয় করে। যারা আপনার প্রতি অবতীর্ণ কিতাবে বিশ্বাস করে, আপনার পূর্ববর্তী কিতাবে বিশ্বাস করে এবং আখেরাতকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এরাই তাদের রবের হেদায়েত প্রাপ্ত। তারাই পূর্ণ সফল।
[সুরা : বাকারা, আয়াত : ১-৫]
সুরা বাকারার আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ বলে দিয়েছেন- হেদায়েত ও সিরাতে মুস্তাকিমের অনুসন্ধানি ও অভিলাষীদের একমাত্র উপায় কুরআনুল কারিম। কুরআনুল কারিমে ভাষাগত, তথ্যগত ও পরিণাম গত ভুল নেই। কোনো দিক থেকে এতে এতটুকি ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। সকল মানদণ্ডে এটি পরিক্ষিত ও উত্তীর্ণ। কারণ; এটি মহাজ্ঞানী, সৃষ্টির আধার, মহামহিয়ান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরীত ও অবতারিত।
কুরআনুল কারিম বিশ্ব চরাচরের জন্য হেদায়েত ও পথনির্দেশিকা। হেদায়তের সকল পথ ও মতে থিতু করার একমাত্র মাধ্যম কুরআনুল কারিম। বিকল্পহীন উপায় কুরআনুল কারিম। দীন ও ইসলামের সকল শাখা ও মাত্রায় পরিপূর্ণতা দানে কুআনুল কারিমের কোনো বিকল্প নেই।
বন্ধুরা! পুরো কুরআন যেমন হেদায়েত ও আলোকবর্তিকা, তার অংশবিশেষও আলোর মিনার। পথের দিশারী। নামাজে সুরা ফাতিহা পড়ার পর পুরো কুরাআনুল কারিম থেকে বড় একটি আয়াত বা ছোট তিন আয়াত পড়া হয়। যাতে সে পঠিত আয়াত ও সুরা-অংশ সুরা ফাতিহার আবেদন ও দোয়ার প্রতি উত্তর হয়। বড় একটি আয়াত বা ছোট তিন আয়াতে সাধারণত কথা পূর্ণতা পায়। এইটুকুতেই সুরা ফাতিহার সরল সোজা পথের প্রার্থনার জবাব হয়ে যায় আলহামদুলিল্লাহ!
[তাফসিরু হিদায়েতিল কুরআন, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৩৯]
বন্ধুরা! কুরআনুল কারিম মানব-দানব বরং সকল সৃষ্টির জন্য পথ-প্রদর্শক। মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্য উন্মুক্ত হেদায়েত। অবশ্য মুত্তাকি মুসলমানদের জন্য বিশেষ পথ-প্রদর্শক। কুরআনুল কারিম বিশ্ব চরাচরের জন্য প্রস্ফুটিত ব্যাপক পথপ্রদর্শক হলেও শুভপরিণতি ও চূড়ান্ত সফলতার দিশারী কেবল মুত্তাকিদের জন্যই। হেদায়েতের নানা স্তর ও শাখা রয়েছে। কুরআনুল কারিমের মাধ্যমে বিশেষায়িত হেদায়েত কেবল মুত্তাকিদের কপালেই জোটে।
মুত্তাকির বাংলা খোদাভীরু। সহজে বললে- যিনি আল্লাহকে ভয় পান। ভেতরে-বাইরে, প্রকাশ্যে-নিভৃতে সর্বত্র সবকিছুতে আল্লাহকে ভয় করেন। বোধ-বিশ্বাস, কাজে-কর্মে সব কিছুতে কেবল আল্লাহকে মানেন। একমাত্র তাঁকে খুশি করতেই মরেন-বাঁচেন। জীবনের প্রতিটি কাজ করেন বা ছাড়েন।
সুরা বাকারার ৩ ও ৪ সংখ্যক আয়াতে মুত্তাকির যেসব গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে, তার নির্যাস হলো-
১. যিনি অদৃশ্যে বিশ্বাস করেন; আল্লাহ, ফেরেশতা, তাকদির, জান্নাত-জাহান্নাম, নবি-রাসুল ও আসমানি কিতাব, পরকাল-সহ নবিজি কর্তৃক বর্ণিত না-দেখা সব কিছু বিশ্বাস করেন।
২. যিনি যথাযথভাবে নামাজ আদায় করেন। পূর্ণ যত্নসহ সকল আহকাম মেনে নামাজ আদায় করেন। আল্লাহ তায়ালার সকল বিধিবিধান সযত্ন পালন করেন।
৩. যিনি আল্লাহর দেয়া রিজিক ও সম্পদ থেকে দান করেন। নিজের সহায়-সম্পত্তি আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত মনে করে মুক্ত মনে খোলা হাতে দান করেন। সুষ্ঠুভাবে যাকাত পরিশোধ করেন। সদকাতুল ফিতর আদায় করেন। মন খুলে নফল দান-খয়রাত করেন।
৪. যিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অবতীর্ণ কিতাব ‘কুরআনুল কারিম’ বিশ্বাস করেন। কুরআনুল কারিমকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরীত সত্য কিতাব মনে করেন। মনেপ্রাণে সম্মান করেন। মুখে স্বীকার করেন। কাজে প্রয়োগ করেন। সে মোতাবিক নিজেকে ও নিজের অধিনস্তদের পরিচালনা করেন।
৫. যিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ববর্তী নবি ও কিতাব বিশ্বাস করেন। পূর্ববর্তী সকল নবি-রাসুলকে সত্য বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন। তাঁদের প্রতি নাজিল কৃত কিতাব ও সহিফাকে সত্য ও হক জ্ঞান করেন।
৬. যিনি আখেরাত ও পরকালকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। কবর, কবরের সাওয়াল-জবাব, পরকাল, পুনরুত্থান, সাওয়াব-আজাব, ও জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি বিশ্বাস করেন। নবিজি কর্তৃক বাতলানো সকল সংবাদ ও তথ্যাদিকে সত্য বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন।
যার মাঝে উপর্যুক্ত ছয় গুণ পাওয়া যাবে তিনি মুত্তাকি। তাঁর পরিণতি ও পুরস্কার হলো- তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়েত প্রাপ্ত। আল্লাহ কর্তৃক স্বীকৃত দীনপ্রাপ্ত। প্রকৃত দীনদার ও সফল দীন পালনকারী। তিনি পূর্ণ সফল। দুনিয়া আখেরাতে চিরজয়ী। শান্তি-সুখের অধিকারী। এক কথায়-তিনি জান্নাতি। আল্লাহ আমাদেরকে প্রকৃত মুত্তাকি হিসেবে কবুল করুন! দীনের সঠিক পথে চলে চূড়ান্ত সফলতা জান্নাত লাভ করার তৌফিক দান করুন!
