প্রিয় গ্রাম তুমি অপরূপ

প্রিয় গ্রাম তুমি অপরূপ

আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ।
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
বন্দে আলী মিয়া, আমাদের প্রিয় কবি। ছড়ায় এঁকেছেন গ্রামের রূপ। ছড়ায় ছড়ায় প্রাণবন্ত-জীবন্ত হয়ে উঠেছে এদেশের গ্রামের হৃদয়ভোলানো চিত্র। গ্রাম মানেই সবুজ-শ্যামল, শান্ত, ছায়াঘেরা, মনোরম এক জনপদ। দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ, টইটুম্বুর খাল-বিলে নয়নাভিরাম শাপলা-পদ্ম! গ্রাম মানেই পাখিদের কোলাহল, ঝিঁঝিঁর ডাক আর জোনাকির স্বপ্নীল ওড়াউড়ি। গ্রামগুলোর অপার সৌন্দর্য একইসঙ্গে নয়নাভিরাম ও বৈচিত্র্যময়।
গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত কিংবা বসন্ত। প্রতিটি ঋতু বাংলাকে করেছে রূপময়, সৌন্দর্যময়। একেকঋতু সাজিয়েছে একেক রূপে। যেন তুলির আঁচড়ে আঁকা শিল্পীর ছবি। সত্যি গ্রাম দেখলে চিন্তা করতে হয় মহান প্রভু কত বড় শিল্পী। কত মহান, কত দয়াময়।
গ্রামের সৌন্দর্যে মন হারিয়ে যায়! গ্রামের হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য দেখতে পল্লীকবি জসিম উদ্দীন আকুলকণ্ঠে ডেকেছিলেন ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায়-
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,
ঘন কালো বন-মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।
গাছে গাছে পাখিদের গান, ভ্রমরের ওড়াউড়ি, সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁ পোকারদের ডাক, টিপটিপ আলো জ্বেলে জোনাকিদের ছুটাছুটি- ছোট ছোট ঝোঁপঝাড় যেন ফুলের বাগান। নিটোল করা ছবির মতো গ্রাম। তাই তো কবির সেই বিখ্যাত কবিতা আজও চির অমলিন-
‘আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন
মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন’।
ছনেছাওয়া গ্রামের ঘরগুলো যেন শান্তির ঠিকানা। কিছুদিন আগেও থাকার ঘরসহ সব ঘরই ছিলো ছনের। এরপর টিনের প্রচলন শুরু। তবে রান্নাঘর গোয়ালঘর এই সেদিনও ছিলো ছনের। এখনো আছে কিছু কিছু। সারি সারি ঘর। সাজানো গুছানো পরিপাটি উঠোন। এমন কয়েকটি ঘর নিয়ে হয় একটি বাড়ি। আর কয়েকটি বাড়ি নিয়ে একটি গ্রাম। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন।
একটি বাড়িতে ভাই বোন চাচা বা কাছের মানুষরাই সাধারণত থাকে- তবে আত্মীয় নয় এমন মানুষও থাকে একটি বাড়িতে। আত্মীয় হোক বা না হোক গ্রামের প্রতিটি বাড়ির মানুষের মাঝে গড়ে উঠে আত্মার সম্পর্ক। এতো মধুর সম্পর্ক তুমি আর কোথাও খুঁজে পাবে না। বিপদে-আপদে, সুখে-দুখে পাশে থাকবে আপন ভায়ের মতো- মুরুব্বিগণ থাকেন বাবা হয়ে।
যদিও এখন মানুষ স্বার্থপর। এককেন্দ্রীক হতে শুরু করেছে। মানুষ এখন অর্থের পিছনে ধাবমান। সম্পর্কগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে শুরু করেছে। তবুও গ্রামে প্রিয়-ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধা। গ্রামের শুদ্ধ ঠাণ্ডা বাতাস মন জুড়িয়ে দেয়। হৃদয়কে রাখে তৃপ্ত।
আরো আরো নয়নাভিরাম কত যে রূপ আছে! তা আমাদের অনেকের দেখাই হয়নি। ছড়িয়ে আছে বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র আমাদের এ রূপসী বাংলাদেশ। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়, জলপ্রপাত, বনভূমি এদেশকে করে তুলেছে অপূর্ব রূপময়। এছাড়াও বাংলাদেশের কিছু পাহাড়-পর্বত ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশ এক বিশাল বদ্বীপ। অর্থাৎ, সমভূমি অঞ্চল। এই বদ্বীপে দাঁড়িয়ে চোখ মেললেই চোখ জুড়িয়ে যায়, মন শীতল হয়- কবি তার কবিতায় লিখেছেনÑ
এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার?
ওথায় এমন ধুম্র পাহাড়?
কোথায় এমন হড়িৎ ক্ষেত্র
আকাশ তলে মেশে?
এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায়
বাতাস কাহার দেশে?
কবির কবিতায় ছড়া কিংবা গানে- গ্রাম বাংলার রূপ বর্ণনা করা হয়েছে শব্দের মালায়। এসো আরো একবার যাই প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দের কবিতায়Ñ
‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপর মাথা রেখে
অলস গেঁয়োর মতো এই খানে-কার্তিকের ক্ষেতে;
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার
চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ
তাহার আস্বাদ পেয়ে পেকে ওঠে ধান’।
প্রকৃতি রঙ বদলায় তার নিজস্ব নিয়মেই। প্রকৃতির পরতে পরতে কত বিচিত্র রঙ যে মিশে আছে! চোখ খুলে দেখলে, মনের গহিনে তা উপলব্ধি করলে অবাক হতে হয়। বারবার প্রকৃতি তাই বিশ্ব চরাচরে এক রহস্যের নাম। বিশেষ করে বাংলা ঋতুর বহু বিচিত্র রূপ-রস-গন্ধ মানুষ মুগ্ধ করে। বিস্মিত করে। এক অভাবনীয় রূপবিভায় বাংলার ঋতু-প্রকৃতি প্রতিটি বাঙালিকে আবেগ তাড়িত করে।
আমাদের গ্রাম। আমাদের প্রকৃতি। নয়নাভিরাম দৃশ্য-সবই মহান আল্লাহর দান। এই যে ঋতু বৈচিত্র-একেক সময় সময় একেক রূপ আমরা তার সাথেই মিলে চলি। রোদ বৃষ্টি ঝড় তুফানই আমাদের জীবনযাত্রা। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় সবকিছুর সাথেই গ্রামের জীবনযাত্রার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ঋতু বদলের সাথে সাথে বদলায় গ্রামের রং, রূপ, লাবণ্য।
শরতের শুভ্র মেঘ, রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি। নদীর তীরে তীরে কাশফুল, গাছে গাছে হাসনাহেনা কিংবা শিউলী, কামীনী, বেলী, বিল জুড়ে শাপলা, ঝকঝকে নীল আকাশ। যে রূপে হার মানে কবির কবিতা। শরতের রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রিয় কবি নজরুল লিখেছেনÑ
সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরনী?
নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী!
কামিনী, অপরাজিতা, গন্ধরাজ, মল্লিকাসহ নানারকম ফুল নিয়ে আসে হেমন্ত। নবান্ন উৎসবের সাথে পিঠা পায়েশ-গ্রাম বাংলার এতো এতো রূপ বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
শীতে হেমন্তের সাজ খুলে ফেলে গ্রামগুলো ঢেকে যায় কুয়াশার চাদরে। সেই কুয়াশা ভেদকরে সকালের সোনালি রোদ যখন গ্রামগুলোতে উঁকি দেয়, তখন দেখা মেলে ভিন্নরকম এক সৌন্দর্যের পশরা। মাঠ জুড়ে হলুদ সরিষাফুল, বিভিন্ন রকম শাক-সবজির বিপুল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সমারোহ শীতের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ। পল্লীকবির ভাষায়Ñ
‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।’
তবে গ্রামের রূপ সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে বর্ষায়। চারদিকে থৈ থৈ পানিতে গ্রামগুলো যেন ভেসে থাকে। সে এক অপরূপ দৃশ্য। রিমঝিম বৃষ্টি আর মেঘ বাদলের লুকোচুরিতে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি। ডালে ডালে ফোটে দৃষ্টিনন্দন কদম। বৃষ্টি ও বন্যায় ঝকঝকে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য আছে কার?
আজ সেই গ্রাম হারিয়ে যাচ্ছে। শহরের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে গ্রামে। ইট-পাথরে ঢেকে যাচ্ছে গ্রামের কাচাঘরগুলো। আকাশ সংস্কৃতি মোবাইল ইন্টারনেট কেড়ে নিচ্ছে দূরন্ত সেই শিশু-কিশোর উচ্ছল জীবন। গ্রামের রূপ আছে আছে অনাবিল সৌন্দর্য কিন্তু নেই কোলাহলমূখর, মাঠ-পুকুর ঘাটগুলো আছে আগের মতোই কিন্তু নেই ঝাঁকে ঝাঁকে ডুব-সাঁতার খেলার সেই প্রাণবন্ত কিশোরের হাট। গ্রাম মনকে টানে, হৃদয়কে মথিত করে। কতদিন যাওয়া হয় না গ্রামে। গ্রাম মনকে প্রফুল্ল করে-হৃদয়কে করে আলোড়িত-আলোকিত, ফ্রেশ। গ্রামে না যেতে পারার কষ্ট থেকে বা আফসোস থেকে কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন ‘আমার সবুজ গ্রাম’ কবিতাটি-
কতেদিন হয়নি যাওয়া আমার সবুজ গ্রামে
সোনাবিল, পদ্মাদিঘি, উত্তরকঙ্গের
সেই ধুলোওড়া পথ, বিষণ্ন পাথার,
আঁখ মাড়াইয়ের দৃশ্য, ক্লান্ত মহিষ
কতেদিন হয়নি দেখা; কতেদিন হয়নি
শোনা দুপুরে ঘুঘুর ডাক, হুতোম পেঁচার
শব্দ ঃ হয়তো এখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে
প্রায় শুকিয়ে যাওয়া গ্রামের নদীটি, কখনো
শহরে সবুজের সমারোহ দেখে এই প্রিয় গ্রামটিকে
মনে পড়ে যায় ঃ কোনো পুরনো দিনের
গান শুনে, দোয়েল-শালিক দেখে
আমি খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি;
ফিরে যাই আমার সবুজ গ্রামে, হাটখোলাটিতে
এখনো টিনের চালে কখনো
বৃষ্টির শব্দ শুনে উত্তরবঙ্গের
সেই দুঃখিনী গ্রামটি মনে পড়ে।
এমনকি আছে তার মনে রাখবার মতো
তবু এই উলুঝুলু বন, বিষণ্ন পাথর
নেহাৎ খালের মতো শুকনো নদীটি, এখনো
আমার কাছে রূপকথার চেয়েও বেশি রূপকথা।
‘রূপকথার চেয়েও বেশি রূপকথা।’ এই যে কবির কথা! এখানেই বাংলার রূপ কত যে সুন্দর তা বর্ণনা করা যাবে না সে মেসেজ দেয়া আছে। রূপ কথার মানেই হলো অকল্পনীয়। যা কল্পনাকেও হার মানায়। কল্পনাকে হার মানানো সেই সৌন্দর্য শব্দের মালায় গাঁথা যাবে না, হৃদয়ে ধারণ করা যায়।
আমরা সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে গ্রামে যেতে চাই। গ্রামীণ সৌন্দর্যকে আমরা উপভোগ করতে চাই। নিশ্চিন্তে হারিয়ে যেতে চাই প্রকৃতির কোলে। গ্রামগুলো বেঁচে থাকুক তার আপন মহিমায়। অতুলনীয় সৌন্দর্য, বৈচিত্র আর ঐতিহ্যগুলোও টিকে থাকুক প্রজন্মের অহংকার হয়ে। শেষে কবির ভাষায় সেই প্রিয় কবিতাÑ
‘ধনধান্যে পুষ্পেভরা আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে এছে দেশ এক-সকল দেশের সেরা;
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা;
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।’

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য