প্রিয় মা!
তুমি কেমন আছো? আজ কতদিন হয়ে গেল তোমার সাথে কথা হয় না! তোমার চুলে বাঁধা বেলি ফুলের সুগন্ধি শোঁকা হয় না! তোমার নীল শাড়ির আঁচলে জড়িয়ে বায়না ধরা হয় না! তোমার মখমল কোমল কোলে মাথা রেখে ঘুমানো হয় না! শুয়ে শুয়ে তোমার ঘুমপাড়ানির গল্প শোনা হয় না!
মা, তুমি আসবে কবে? জানো, আমি এখনও পড়ন্ত বিকেলে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে তোমার অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকি ওই হিজল গাছটার দিকে! একদিন তুমি লুকিয়েছিলে গাছটার পেছনে। আমি তোমার খোঁজে সারা মাঠ দৌড়ে বেড়িয়েছিলাম। তোমায় না পেয়ে হতাশায় মাটিতে পা ছড়িয়ে কান্না শুরু করেছিলাম। তখন তুমি আচমকা গাছের আড়াল থেকে এসে আমায় কোলে নিয়ে বলেছিলে, ধুর বোকা! মাকে না পেলে এত অস্থির হয়?
সত্যি মা, আজ দুবছর যাবত তোমায় কাছে না পেয়ে আমি অস্থির হয়ে উঠেছি! অধৈর্য হয়ে পড়েছি!
মা, তুমি কি আর আসবে না? কবে আসবে মা?
মা তোমার মনে আছে? তুমি শেষবার আমাকে বিদায় দেবার সময় বলেছিলে, খোকা তুই যেদিন হিফয শেষ করবি, তোকে নিয়ে নানাবাড়ি বেড়াতে যাব! সুন্দর একটা জামা কিনে দেব! নানাবাড়ির চাঁদমাখা উঠানে বসে তোকে বীর খালিদের গল্প শোনাব!
মা, আজ তো তোমার খোকা হাফেয হয়েছে। কুরআনের মধুমাখা আয়াতগুলি হৃদয়ের সিন্দুকে সাজিয়ে রেখেছে। আজ খোকা বাড়ি এসেছে, তোমার হাত ধরে নানাবাড়ি যাবে বলে। কিন্তু আজ কোথায় তুমি?
জানো মা, কত রাত আমার দুচোখে ঘুম আসেনি! আমার ছোট্ট হৃদয়ে শুধু ভেসে উঠেছে জোসনামাখা রাতে বীর খালিদের গল্প শোনার কল্পছবি! আমি রাতের পর রাত অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় প্রহর গুনেছি শুধু সে রাতের জন্য!
আজ সেই রাত এসেছে! উঠানে চাঁদ নেমেছে! জোছনা চাঁদোয়া বিছিয়ে দিয়েছে! জোনাকিরা উঠানজুড়ে ওড়াওড়ি করছে। দীপ-জলসায় মিটিমিটি আলোতে আমি বসে আছি তোমার অপেক্ষায়। মা তুমি কি আসবে?
সবই তো আগের মত আছে। পুকুরের শানবাঁধানো পাড়, মাঝপুকুরে নেমে যাওয়া পিচ্ছিল সিঁড়ি, পুকুর পাড়ের তালগাছ- সবই আছে।
শুধু তুমি নেই! তুমি হারিয়ে গেছো আমার থেকে বহুদূরে! নেই তোমার মায়াবী আঁখিযুগল, মমতাভরা কোল, সিঁথিকাটা ঢেউ খেলা চুল, আর আমার জন্য মমতার সিন্দুকে রেখে দেয়া মিষ্টি মিষ্টি আদর!
মা, তুমি কবে আসবে? দেখো মা, আকাশ থেকে ভেসে ভেসে এসেছে মেঘের দল। তালগাছের মাথায় উঁকি দিচ্ছে চাঁদ। আমি খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে আছি। তাকিয়ে আছি দূর আকাশে। মামা বলেছিল, তুমি নাকি ওই আকাশে থাকো। চাঁদের সাথে তোমার খোকার গল্প বলে গর্ব করো। বলো যে, তোমার খোকার বুকের মিনারের সদা বাজে ত্রিশপারা কুরআনের সুললিত সুর। তাই আমি হৃদয়ের কথাগুলি বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম। যদি মেঘের পাখায় চড়ে উড়ে উড়ে যায় দূর আকাশে। মা, তোমার সকাশে।
বলো না মা, তুমি আসবে কি? কথা দাও মা! আসবে তো?
মা, তুমি ছিলে আমার জান্নাত! তুমি চলে যাওয়ার পর এখনও দিন আসে। রাতের আকাশে চাঁদ হাসে। কিন্তু তোমার শিয়রে বসে মধুর সুরে কুরআন পড়ার সেই রাত আর আসে না! সোনালি ধানের আড়ালে লুকিয়ে আমাকে পাঠশালার মেঠোপথে এগিয়ে দেয়া সেই বিকেল আর আসে না। যতদূর দেখা যায় তোমার মতো অনিমেষ তাকিয়ে থাকবে, এমন কেউ আর আসে না! আসে না কুয়াশাভেজা ভোরে তোমার সাথে সবুজ ঘাসে হেঁটে চলার আনন্দঘন মুহূর্তগুলি!
মনে আছে মা? শিশিরের একটি ফোঁটা নিয়ে আমি তোমার কপোলে রেখে বলেছিলাম, এটা তোমার মাতৃস্নেহের উপহার! তুমি ঘাসফুলের মতো মিষ্টি হাসি দিয়ে বলেছিলে, আমার লক্ষ্মী আব্বুটি!
তোমার স্মরণের ঝাঁপিতে কি এই স্মৃতিটিও আছে? দুর্বাঘাসে হাঁটতে হাঁটতে তোমার একটি জুতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। তুমি ছেঁড়াজুতা খুলে হাঁটছিলে। তোমার দেখাদেখি আমিও একটি জুতা ফেলে দিয়েছিলাম। তুমি এত খুশি হয়েছিলে যে, ঘাসফড়িংয়ের মতো উড়ছিলে আর আমাকে বারবার শূন্যে ছুঁড়ে ‘সোনা মানিক’ বলে ডাকছিলে।
প্রিয় মা!
সেদিন বিকেলে বাবা আমায় নিয়ে গিয়েছিল তোমার কবর-পাশে। বিরহ-বেদনা আমায় এতটা জেঁকে ধরেছিল যে, হিম-শীতল বরফ গলে নামা ঝর্ণার স্রোতের মতো কান্নার ঢল আমার বুকে আছড়ে পড়ছিল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি মাটিতে বসে পড়েছিলাম। বাবা আমায় বুকে টেনে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।
সে রাতে আমি আবার তোমার কবর-পাশে গিয়েছিলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম, চাঁদের মায়াবী আভায় তোমার কবরখানা নীল আলোয় ছেয়ে গিয়েছে। সেদিন তোমার জান্নাত পাবার অটুট বিশ্বাস আমার হৃদয়ে গেঁথে বসেছিল। আমি ডালিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তোমার জন্যে কেঁদে কেঁদে দোয়া করেছিলাম। আমার কান্নামিশ্রিত শব্দ শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছিল। আমার বিশ্বাস, সে রাতের দোয়া কবুল হয়েছিল।
মা, তুমি কি আর আসবে না? জানো, তুমি চলে যাবার পর কোকিলের কুহু কুহু ডাক আমাকে পুলকিত করে না! সকালে জানালার ফাঁক গলে আসা সূর্যরশ্মির আলোকছটা আমার মনে শিহরণ জাগায় না! আদিগন্ত সবুজ ফসলের মাঠ ও সর্ষেফুলের হলুদ সমারোহ আমাকে আনন্দ দেয় না! দোয়েলের শিস আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায় না! গাছে ঝুলতে থাকা পাকা পাকা ডালিমের রক্তলাল রঙে আমার মনের স্বপ্ন ভাসে না!
এখন আর রাতে দুচোখে ঘুম জড়িয়ে আসে না! নির্ঘুম রাতে তোমার স্মৃতি কথা বলে ওঠে আমার সাথে! স্মৃতির প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় আমার মনের চৌহদ্দিজুড়ে! এখন আর ভালো লাগে না কোন কিছুতে! মন বসে না গল্পের বইয়ে, পড়ার টেবিলে!
এখন শুধু ভালো লাগে, নিঝুম রাতে দিঘির জলে চাঁদের জলছবি আঁকতে! দিঘির পাড়ে বসে আকাশে তাকিয়ে তোমার কথা ভাবতে! ভালোলাগে, দিনের শেষে গাছের ডালে বসে পাখির কিচিরমিচির আর বাতাসে উড়ে বেড়ানো তোমার রিনিঝিনি হাসির শব্দ শুনতে! ভালো লাগে, চাঁদের মিষ্টি নীলাভ আলো-আঁধারিতে উঠানে মাদুর পেতে তোমার স্মৃতিমাখা গল্প লিখতে!
মা, তুমি আসবে ফিরে? বলো মা, আসবে? আর কতদিন? আর যে তর সইছে না!
মা, তুমি একবার হলেও ফিরে এসো না আমার স্বপ্নের অলিন্দে! আমি তোমায় দেখব একটু দুচোখ ভরে!!