পৃথিবী এতোটা সুন্দর ছিলো না। সুন্দর ছিলো না আরব। মক্কা-মদীনাও ছিলো না সুন্দর। ভালো ছিলো না সেখানকার মানুষ। মানুষের মনে ছিলো কষ্ট, দুঃখ, হাহাকার আর হিংস্রতা।
বালিময় সে এক দেশ। ঘরে বাইরে যেদিকে তাকানো যায়, শুধু বালি আর বালি। তার ওপর দুঃসহ তাপ ছড়ানো খাঁ খাঁ রোদ। মানুষের সেকি কষ্ট! খাবারদাবার, পানি, একটুকরো ছায়া-সবকিছুরই সংকট। এ ছাড়াও ছিলো যুদ্ধ। গোত্রে গোত্রে সংঘাত। ছোট ছোট কথা কাটাকাটি বা স্বার্থে একটু-আধটু আঘাত পেলেই এক গোত্রের সঙ্গে অন্য গোত্রের লেগে যেত যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ চলতো বছরের পর বছর।
চারদিকে বিরাজ করতো ভয়-শংকা। কখন কে কাকে মেরে ফেলে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পথে পথে ওঁৎ পেতে থাকতো নিষ্ঠুর সব দস্যুর দল! তারা বণিকদের উপর চড়াও হতো। বণিকদের সঙ্গে থাকা টাকাপয়সা, মালপত্র আর উট, ভেড়া কেড়ে নিতো। কোনো কোনো উগ্র ডাকাত জীবনও কেড়ে নিতো হরহামেশা।
শিক্ষা-দীক্ষা ছিলো না মানুষের মাঝে। মনুষত্য ছিলো না কারো অন্তরে। ছিলো না কোমল হৃদয়। দয়া-মায়া ছিলো না এক বিন্দুও। এতটাই নিষ্ঠুর ছিলো যে, কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলে, বাবা-মা হয়েও আপন কন্যা সন্তানকে তারা জীবন্ত কবর দিতো। সন্তানের মরণ চিৎকারে আকাশ বাতাস কম্পিত হতো, কাঁদতো। গৃহপালিত পশুপাখি ছটফট করতো। কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রী শিশু কন্যার কান্নার আওয়াজ তাদের কানে পৌঁছতো না। তাদের হৃদয়ে তা কোনো দয়ামায়ার সৃষ্টি করতো না।
এসব কারণে অই সময়টিকে বলা হতো জাহেলী যুগ। মানে, মূর্খতার যুগ। বর্বরতার যুগ।
আর সেই অন্ধকারময় মূর্খতা ও বর্বরতার যুগে এ পৃথিবীতে আসেন আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তিনি আসেন আলো হয়ে- আঁধারে ছাওয়া পৃথিবীকে আলোকিত করতে।
তিনি আসেন ফুল হয়ে।
ফুলের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দেন বিশ্বময়।
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফুলের মতো ছিলেন- ফুলের মতো সুন্দর, স্বচ্ছ, পবিত্র, ঘ্রাণময়, সুশোভিত। তাঁর সৌন্দর্যকে শব্দে লেখা যায় না। কল্পনার তুলিতে সেই সৌন্দর্যের ছবি আঁকা যায় না। তিনি ছিলেন আলো ঝলমলে চাঁদের চেয়ে সুন্দর।
আমাদের আকা! আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন কবি ছিলেন- প্রিয় কবি, সাহাবী কবি হযরত হাসসান ইবনে সাবিত রাদিআল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সৌন্দর্য বর্ণনা করে কবিতায় লিখেছেন,
আমার চোখ দেখেনি কাউকে তোমার মতো নিখুঁততর,
কোনো নারীর সন্তানই নয় তোমার থেকে সুন্দরতর;
তোমার সৃষ্টিতে নেই বিন্দুমাত্র ত্রুটি
যেনো তোমার ইচ্ছাতে তুমি হয়েছো সৃষ্টি।
শুধু কি তাই! সকল সাহাবায়ে কেরাম আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা-এর স্বর্গীয় সৌন্দর্য়ের প্রশসংশা করেছেন।
হযরত আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু বলেছেন:
“আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত পরিষ্কার, উজ্জ্বল, সুন্দর এবং সুদর্শন ছিলেন যে, তাঁর শরীর যেন রূপা দ্বারা মোড়ানো ছিল। তাঁর চুল ছিল কিছুটা কোঁকড়ানো।”
হযরত আদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিআল্লাহু আনহু বলেছেন:
“আমি একবার পূর্ণিমার রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। সে রাতে তিনি লাল ডোরাকাটা একটি কাপড় পরেছিলেন। আমি একবার পূর্ণিমার চাঁদের দিকে আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে তাকালাম। শেষপর্যন্ত আমি এ সিদ্ধান্তে পৌছলাম, পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও আল্লাহর রাসূল বেশি সুন্দর ও উজ্জ্বল।”
হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদিআল্লাহু আনহু বলেছেন:
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব লম্বাও ছিলেন না আবার খুব বেঁটেও ছিলেন না। বর্ণের দিক থেকে তিনি একদম সাদাও ছিলেন না, আবার একদম কালোও ছিলেন না বা বাদামীও ছিলেন না। (তিনি ছিলেন উজ্জ্বল, ১৪ তারিখের রাতের পূর্ণ চাঁদের থেকেও দীপ্তিমান।”
হযরত বারা ইবনে আযিব রাদিআল্লাহু আনহু বলেন:
“আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মধ্যম আকৃতির (হালকা লম্বা); তাঁর ছিলো চওড়া কাঁধ, কানের লতি পর্যন্ত ঘন চুল; তিনি একটি লাল ডোরাকাটা কাপড় ও একটি চাদর পরতেন। আমি তাঁর মতো সুন্দর কাউকে বা কিছুই দেখিনি।”
হযরত আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু বলেছেন:
“আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতো সুদর্শন কাউকে দেখিনি। যেনো সূর্যের উজ্জ্বলতা তাঁর পবিত্র চেহারা থেকে বিচ্ছুরিত হয়। তাঁর থেকে দ্রুত হাঁটতে আমি আর কাউকে দেখিনি, যেনো তাঁর জন্য জমিনকে ভাঁজ করে দেওয়া হতো। কিছুক্ষণ আগেই হয়তো তিনি এখানে ছিলেন এবং পরমুহূর্তেই তিনি দূরে চলে গেছেন। তাঁর সাথে হেঁটে তাল রাখা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যেতো।”
সেই নবী এলেন পৃথিবীর বুকে। মানুষের পৃথিবীতে।
শিশুকাল থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত, উত্তম চরিত্রের অধিকারী। পাড়া প্রতিবেশি সবাই বিস্ময়ে হতবাক হতো তাঁর উত্তম চরিত্র মাধুরী দেখে। মা আমিনার কলিজার টুকরো! চোখের তারা! বিশ্ববাসীর জন্য রহমাতুল্লির আলামীন। কিশোর বয়সেই যিনি পেয়েছেন আল আমীন উপাধী– মহা সত্যবাদী।
তিনি কোনো দিনও কাউকে কষ্ট দেননি। সামান্যতম দুর্ব্যবহার করেননি কোনো মানুষের সাথে। গরিব দুখি মানুষের পাশে থাকতেন সব সময়। মানুষের কষ্টে তিনি কাঁদতেন- তেমন আবার মানুষের সুখে হাসতেন। আল্লাহা কৃতজ্ঞতা জানাতেন।
হেরার গুহায় তিনি ধ্যান করতেন-একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন বুকে নিয়ে। চিন্তা করতেন মানুষের কল্যাণের।
মানুষ তাঁর প্রেমে মুগ্ধ।
মুগ্ধ চারিত্রিক মাধুরীতে।
তাঁর আমানতদারিতায় অভিযোগ নেই কারো। সেই নবী আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমাদের নবী অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে আলো জ্বেলেছিলেন।
মূর্খ মানুষের হৃদয়ে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন।
যুদ্ধ-বিগ্রহে ভরপুর সমাজে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।
মিথ্যা-কুসংস্কারকে তিনি দু’পায়ে দলেছেন।
মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন- মানুষের সম্মানকে। মনুষত্ব-মানবিকতাকে তিনি তুলে ধরেছেন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার করে।
উদারতা কাকে বলে তাও শিখেয়েছেন। স্নেহ-প্রেম, মায়া-মমতা বিলি করেছেন হৃদয়ে হৃদয়ে।
তিনি মানুষের নবী!
বিশ্ববাসীর নবী।
তিনি রাহবার, তিনি শান্তির দূত, তিনি শান্তির বারতা ছড়িয়েছেন বিভিন্ন জাতি-গোত্র ও দেশে দেশে, বিশ্বের ঘরে ঘরে।
আমরা তোমাকে ভালোবাসি হে রাসূল!
আজও দুশো কোটি মুসলমানের হৃদয়ে স্পন্দন তুমি। দুশো কোটি কলিজার চেয়ে তুমি অনেক অনেক দামি। দুশো কোটি হৃদয় তোমাকে ভালোবাসে হে রাসূল।
তোমার নামে দরুদ পড়ি!
তোমার প্রেমে কাঁদে আমার-আমাদের মন!
আহত পাখি হয়ে তোমার রওজায় ছুটে চলে এ মন। গভীর রজনীতে চোখ কাঁদে তোমার জন্যে। তোমাকে দেখি নাই! তবুও ভালোবাসি অন্তর থেকে! নিরন্তর ভালোবাসি হে রাসূল আমার। তোমার ভালোবাসা, তোমার প্রেম হৃদয়কে শীতল করে। চোখ বন্ধ করে কল্পনার জগতে ভাসি, চেষ্টা করি তোমাকে দেখার! মনে হয় তোমার প্রিয় সাহাবীদের সাথে বসে আছি তোমার দরবারে।
পৃথিবীর সব প্রেম যেখানে পরাজিত- সেখানে তোমার ভালোবাসা জয়ী।
শুধু তোমার জন্য এ পৃথিবী ব্যাকুল। তুমি ফুলের মতো সুন্দর হে নবী!
তুমি তারার চেয়ে আলোকিত, চাঁদের চেয়েও দীপ্তিময়! তোমার জীবনের কোথাও নেই কোনো কালিমা। নেই কোনো অহঙ্কার। জেনেশুনে কোনো অন্যায় করোনি তুমি। ভুলও করোনি। আমরা গর্বিত তোমার মতো সর্বগুণে গুণান্বিত নবী পেয়েছি বলে। আর এ কারণেই প্রতিক্ষণে আল্লাহর শুকরিয়া করি আমরা তোমার উম্মত হতে পেরেছি বলে।
হে রাসুল! তোমার ভালোবাসা নিয়ে চলতে চাই- মরতে চাই। আর কবির মতো করে বলতে চাই-
‘আল্লাহর কসম! তুমি আমার হৃদয় রাজ্যে আর কল্পনার জগতে বিচরণ না করলে কখনও সূর্য উদিত হয় না এবং অস্তও যায় না । তোমাকে নিয়ে আলোচনা ছাড়া আমি কোনো সম্প্রদায়ের সাথে কোনো কথাই বলি না। আর যখনই কোনো পেয়ালায় চুমুক দেই, তখনই তাতে তোমার ছবি ভেসে ওঠে। সুখে দুঃখে তোমার আলোচনা করার সময় আমার শ্বাস-প্রশ্বাসে শুধুই তোমার ভালোবাসার স্পন্দন অনুরণিত হয়। হায় আফসোস! যদি তোমার সাক্ষাৎ লাভের সামর্থ্য থাকতো, তাহলে সাক্ষাৎ লাভের জন্যে হামাগুড়ি দিয়ে (উপুড় হয়ে হলেও) তোমার কাছে এসে উপস্থিত হতাম!!’
তোমাকে ভালোবাসি হে রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।