বৈদ্যুতিক বাতির জনক হিসেবে মার্কিন বিজ্ঞানী এডিসন স্বীকৃতি পেয়েছেন ১৮৮০ সালে। তবে তার আগে আরো অনেকে বাতি আবিস্কারের চেষ্টা করছেন, সফলও হয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু বিষ্ময় হল তাদেরকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি!
যে কয়েকটা আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে সামনে এগিয়ে যেতে সরাসরি সাহায্য করেছে এবং মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে; তার মধ্যে অন্যতম বৈদ্যুতিক বাতি। বৈদ্যুতিক বাতি আসার পর মানুষ শুধু দিনে নয়, রাতেও সাচ্ছন্দ্য মত কাজ (বাতি আবিষ্কারের আগে আগুন জ্বালিয়ে কাজ করতে হত রাতের বেলা, যা অনেকটা বিপজ্জনক) করছে। বর্তমান সময়ে এসে বিষয়টা হাস্যকর মনে হলেও ওই সময়ে বিষয়টি ছিল যুগান্তকারী। বৈদ্যুতিক বাতি কতটা সহজ করেছে যাপিত জীবন, তা নিয়ে কারো কোন কৌতূহল নেই। তবে বিতর্ক আছে এর আবিষ্কারক নিয়ে। কারণ, বাতি আবিষ্কারের পেছনে অবদানটা শুধু এডিসনের, বিষয়টা এমন নয় মোটেও।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যুতের আবিষ্কার। উনিশ শতকের শুরুতে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা বের করেন বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি। এটি ব্যবহার করে তিনি আবিষ্কার করেন ‘ভোলাটিক পাইল’, যা কার্যত একটি ব্যাটারি। ভোলাটিক পাইল ব্যবহার করে ব্রিটিশ রসায়নবিদ হামফ্রি ডেভি একটি ‘আর্ক ল্যাম্প’ বা ‘ব্যাটারিচালিত বাতি’ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। ডেভি এই বাতি আবিষ্কার করেন ১৮০৬ সালে, এডিসনের প্রায় ৭০ বছর আগে! তবে সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। ডেভি যে বাতিটি আবিষ্কার করেছিলেন, তা ছিল খুব বেশি উজ্জ্বল। পাশাপাশি এটি কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। আবার বাতিটি অনেক বেশি পরিমাণ বিদ্যুতের বিনিময়ে জ্বলছিল খুব কম সময় ধরে। ফলে গৃহস্থালি কাজে বাতিটি ছিল ব্যবহারের অনুপযোগী। একই সঙ্গে দিনরাত শ্রম দিয়ে যাচ্ছিলেন অন্যরাও। স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস বাউম্যান ১৮৩৫ সালে কপার-ফিলামেন্টের একটি বাল্ব আবিষ্কার করেন। আবার প্লাটিনাম-ফিলামেন্টের বাল্ব আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ওয়ারেন ডে লা রু। কিন্তু বাউম্যানের বাল্বটি পুড়ে যেত খুব দ্রুত, আর ওয়ারেনেরটি তৈরি করা ছিল খুবই ব্যয়বহুল। এই দুটি সমস্যা সমাধানের রাস্তা ছিল একটাই; ভ্যাকুয়াম টিউব প্রযুক্তি। তখনো ঠিকমতো আবিষ্কৃত হয়নি ভ্যাকুয়াম টিউব। ভ্যাকুয়াম টিউব এমন এক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে কোনো স্থান থেকে বাতাস পুরোটা বের করে ফেলা যায়। এই প্রযুক্তি না থাকায় বাল্বগুলোর ভেতরটা বায়ুশূন্য করা যাচ্ছিল না। আর এ জন্য বাল্বও বেশি সময় ধরে জ্বলছিল না।
এদিকে স্কুলের একজন বোকব ছাত্র ছিলেন টমাস আলভা এডিসন। প্রতিটি পরিক্ষায় ফেল করতো সে। স্কুলের অন্য শিক্ষার্থীসহ টিচাররাও তার প্রতি এক প্রকার বিরক্তিবোধ করতো। সমাজ ও স্কুলের একজন বোঝা হিসেবে বিবেচিত ছিলেন এডিসন। একদিন স্কুল থেকে তার মায়ের কাছে একটি চিঠি লেখা হয় সেখানে বলা হয়, ‘আপনার ছেলে খুবই অমনোযোগী ও মেধাহীন একজন ছাত্র’। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে টমাসের মা এই চিঠির উত্তরে স্কুল বরাবর একটি চিঠি লেখেন, সেখানে বলেন, ‘আমার ছেলের মেধা এতো বেশি তাকে রাখার সামর্থ্য এই নগন্য প্রতিষ্ঠানের নেই’।
মায়ের থেকে পাওয়া এই উৎসাহ পেয়ে টমাস এডিসন জীবনের জ্যামিতি নতুন করে আঁকেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে নব উদ্যমে পথ চলা শুরু করেন। একটা সময় গিয়ে সাফল্যে ডাকে সাড়া দিতে সক্ষম হন। পড়া-লেখায় খুব পিছিয়ে থাকা সেই ছেলেটি পূর্ণভাবে আবিষ্কার করেন বাল্ব। মানব জাতির মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর একটি, যা বিংশ শতাব্দীর জীবন যাত্রাসহ এই সময়েও ব্যপক প্রভাব ফেলছে। বাল্ব আবিষ্কারে সবার ব্যর্থতা দেখে রাতদিন কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, পরিপূর্ণ একটি বাল্ব আবিষ্কার করতেই হবে। একের পর এক পরীক্ষার পর এডিসন ১৮৭৮ সালের দিকে উচ্চরোধসম্পন্ন কটন ফিলামেন্টের একটি বাল্ব আবিষ্কার করেন, যা টানা ১৪ ঘণ্টা জ্বলতে সক্ষম ছিল। এর ঠিক এক বছর আগে, অর্থাৎ ১৮৭৭ সালে চলে আসে আধুনিক ভ্যাকুয়াম টিউব প্রযুক্তি, যা ব্যাপকভাবে এডিসনকে সাহায্য করে। বাল্বটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের উপযোগী, এমন প্রমাণ পেয়ে আর দেরি করেননি এডিসন, স্বত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করে বসেন ১৮৭৯ সালে। এক বছর পর ১৮৮০ সালের জানুয়ারি মাসে জাঁকজমক আয়োজনের মধ্যে দিয়ে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, বৈদ্যুতিক বাল্বের আবিষ্কারক ‘টমাস আলভা এডিসন’।
নিউইয়র্কের ম্যানহাটন দিপে তার প্রথম বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্হাপন করা হয়।
কথিত আছে যে, পরিপূর্ণ বাল্ব আবিষ্কার করতে গিয়ে তিনি দশ হাজার বার ব্যর্থ হয়েছেন। পরবর্তীতে এ প্রসঙ্গে কোন এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি দশ হাজার বার ব্যর্থ হয়নি বরং এটি কাজ না করার দশ হাজারটি কারণ বের করেছি’।