মানুষের প্রতি আল্লাহর যেসব নিয়ামত ও দানের কথা প্রাতস্মরণীয় ভাষা তার অন্যতম। বৈচিত্র্যময় ভাষা আর নিরূপম বাক-প্রতিভার গুণে মানুষ অন্য সব প্রাণী থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ মানুষকে বাকশক্তি দিয়েছেন বলেই এতসব আবিষ্কার স্বার্থক হচ্ছে। বাকশক্তির বদৌলতে মানুষ গান গেয়ে আমোদিত হয়। কবিতা আবৃত্তি করে নিজে তৃপ্ত হয়। বক্তব্য দিয়ে শ্রোতাকে মুগ্ধ ও বিনোদিত করে। তাই ভাষার এ নেয়ামতের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ‘পরম করুণাময়, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাষা।’ {সূরা আর-রহমান, আয়াত : ১-৪}
নিপুণ শিল্পকুশলতায় আল্লাহ যেমন অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বসুন্ধরা সৃষ্টি করেছেন, তেমনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তিনি নানা বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক বানিয়ে। মানুষের গোত্র ও গাত্রবর্ণ, স্বরের রুক্ষতা-কোমলতা, দৈহিক উচ্চতা-খর্বতা আর রুচি-অভিরুচির ভিন্নতার মতো তার ভাষায়ও দিয়েছেন নান্দনিক বিভিন্নতা। আল-কুরআনুল কারীমে তাই মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি আর রকমারি সৃষ্টির মতো ভাষার বিভিন্নতাকেও আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয় এরমধ্যে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। {সূরা আর-রূম, আয়াত : ২২}
মাতৃভাষার গুরুত্ব সব জাতির কাছেই আলাদা। মাতৃভাষার প্রতি আবেগই অন্যরকম। মাতৃভাষায় যেভাবে মানুষ মনের কথা তুলে ধরতে পারে অন্য ভাষায় তা পারে না। আমাদের হাসি-কান্না আর আনন্দ-বেদনা কিংবা বৈরিতা-মিত্রতা আর আশা-হতাশার সবই প্রকাশ করে মাতৃভাষা। শিশুর প্রতি মা জননীর তুলনারহিত স্নেহ, মায়ের প্রতি শিশুর অস্ফূট ভালোবাসা আর তরুণ-তরুণীর নন্দিত-নিন্দিত সব ভালোবাসারই দূতিয়ালি করে এই মাতৃভাষা। পৃথিবীর প্রত্যেক জাত-বর্ণের লোকই তাই মায়ের মতোই ভালোবাসে তার মাতৃভাষাকে।
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ পয়গম্বর তথা আল্লাহর দূত মুহাম্মদ রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাই মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করেন নি। আল্লাহর বিশেষ হিকমতের কারণে উম্মী তথা নিরক্ষর থাকা এই নবীও দেখা যায় দাওয়াত তথা স্বজাতির কাছে রবের বার্তা প্রচারে মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বের ইঙ্গিত করেছেন। অন্যসব ক্ষেত্রের মতো তিনি বরং মাতৃভাষায়ও শ্রেষ্ঠ আরব ছিলেন। এ কোনো কবি-সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিকের দাবি নয়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী লোকটিই ভাষা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি নিজে আরবদের মধ্যে সবচে শুদ্ধভাষী ব্যক্তি ছিলেন; কারণ, তিনি কুরাইশ বংশীয় সন্তান আর তিনি বেড়ে উঠেছিলেন ভাষার দিক থেকে প্রসিদ্ধ আরবের তৎকালীন সা‘দ ইবন বকর গোত্রে।
যত্নসহ ভাষা লালন তথা শুদ্ধভাবে জানা এবং চর্চা করা মাতৃভাষার গুরুত্বের অপরিহার্য দাবি। শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা বলতে ও লিখতে পারা যে কোনো দায়িত্বসচেতন নাগরিকের কর্তব্য। আর মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বানকারী মুবাল্লিগ ও দীন প্রচারক আলিমদের জন্য এর গুরুত্ব আর সবার চেয়ে বেশি। সব ভাষাই আল্লাহর নেয়ামত বা দান হিসেবে কোনোটাই অকারণ পূজনীয় বা বর্জনীয় নয়। কেবল পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ভাষা এবং ইসলামী জ্ঞানের সবচে বড় ও বিশ্বস্ত ভাণ্ডার হিসেবে আরবিই যা আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদার অধিকারী সকল মুসলিমের কাছে। কিন্তু আরবীর গুরুত্ব যদি হয় ইসলামী জ্ঞান আহরণের স্বনির্ভর ঠিকানা বলে তবে সেই জ্ঞান প্রচারের অপরিহার্য দায়িত্ব ও দাওয়াতে দীনের জিম্মাদারির কারণে অনন্য গুরুত্বের দাবি রাখে মাতৃভাষা।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুকাল থেকেই বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলতেন। তিনি জীবনে একটি মিথ্যা বাক্যও উচ্চারণ করেন নি। বচনে, আচরণে, পোশাকে, আখলাকে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও বিশুদ্ধ থাকাই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাঁর ভাষা ছিল শুদ্ধ এবং উচ্চারণ ছিল সুস্পষ্ট। তিনি দ্রুত বাক্য বলতেন না। তাঁর প্রতিটি বাক্যই শুধু নয়, প্রতিটি অক্ষরও অন্যরা বুঝতে পারতেন। তাঁর ভাষণ পদ্ধতি এমন ছিল যে, যত বড় মাহফিল হতো, তাঁর স্বর তত উচ্চ হতো। যার ফলে বিদায় হজে আরাফার ময়দানে (মাইক ছাড়া) লাখ লাখ মানুষের তাঁর ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় নি।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে মাতৃভাষা মতো নেয়ামতের যথার্থ কদর করার তাওফীক দান করুন। ভাষার অপপ্রয়োগ ও অপভাষা থেকে বেঁচে বলার তাওফীক দান করুন। আমীন।