ভূতবাড়ির রহস্য উদ্ঘাটন- রিজওয়ান মুহাম্মাদ আবুজর

ভূতবাড়ির রহস্য উদ্ঘাটন- রিজওয়ান মুহাম্মাদ আবুজর

ঈদের পরের সময়টা উদযাপন করতে সবাই কম বেশি সোচ্চার। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বন্ধু-বান্ধব কিংবা ফ্যামিলি মেম্বারদের সঙ্গে ট্যুরে যায়। কেউ যায় নব প্রযুক্তির উদ্ভাবিত সৌন্দর্য পার্কে। কেউ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপ-লাবণ্য উপভোগ করতে নদী, সমুদ্র, পাহাড় কিংবা ঝর্ণাতে গিয়ে ভিড় জমায়। ইতিহাসের পাতা থেকে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের পরিচয় লাভ করে অনেকের বুকের ভেতরটা আনচান করে। এজন্য তারা আত্মতৃপ্তি উপলক্ষে এ দেশের বিভিন্ন প্রাচীনতম স্থানে ভ্রমণের প্রোগ্রাম রাখে। এছাড়া কিছু মানুষের রয়েছে স্বজনদের প্রতি মনের টান। এরা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এসব স্থান সিলেক্ট না করে যায় আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে। এতে দুটি উপকার। প্রথমত আত্মীয়তা রক্ষা আর দ্বিতীয়ত আনন্দ করা। তবে মুজাহিদ, মুহাম্মদ, মুরসালিন নামের এই তিন বন্ধুর শখটা একটু ভিন্ন। যা অনেকটা বিস্ময়করও। আর মুহাম্মদের জন্য তো সাংঘাতিক ভীতিজনক।
এই তিনজনের দলনেতা হলো নির্ভীক মুরসালিন। ভয়ের ছিটেফোঁটা নেই যার মাঝে। আর মুজাহিদও অত্যন্ত সাহসী এক দুরন্ত কিশোর। একই মাদরাসায় একই ক্লাসে তাদের পড়ালেখা।
পরীক্ষার ছুটি হওয়ার আগে তিন জনের প্লান অনুযায়ী এক ভয়ংকার সিদ্ধান্ত হয়। তা হলো মুরসালিনের এলাকা থেকে প্রায় চৌদ্দ কিলোমিটার দূরে একটি ভুতুড়ে ভাঙ্গাবাড়ি আছে। যাকে সবাই ভূতবাড়ি বলে। রাতে তো দূরের কথা, দিনদুপুরেও যার আশেপাশে কেউ যায় না। ঈদের ঠিক দুই দিন পর তিন বন্ধুা সেখানে ভ্রমণ করবে। কিছু রহস্য থাকলে তা উদঘাটনের চেষ্টা করবে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে পুরো বাড়ি। এরপর লোকালয়ে এসে সেই ঘটনা বলবে। এই হলো ওদের ইচ্ছে ।

ঈদের ঠিক দু’দিনের মাথায় ওদের কাক্সিক্ষত দিন চলে এলো। নিজ নিজ বাড়ি থেকে সবাই মুরসালিনের বাড়িতে একত্রিত হলো। মধ্যাহ্নভোজন শেষে তিন বন্ধু ভূতবাড়ির উদ্দেশে রওনা হলো। আছরের আজানের ঠিক আধঘণ্টা আগে তারা কাঠলতলীতে পৌঁছলো। গাড়ি যাওয়ার মতো রাস্তা শেষ। এখন ভূতবাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। সময় লাগবে প্রায় আরো আধঘণ্টা। নিরুপায় হয়ে তিন বন্ধু গল্প করতে করতে হাঁটা দিলো।
হঠাৎ মুরসালিন বলে উঠল- উদ্দেশ্যহীন কোনো কাজ কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি করিনি। কোনোদিন হবেও না ইনশাআল্লাহ। ভূতবাড়ির এই এডভেঞ্চারের মাঝেও আমার বিরাট উদ্দেশ্য আছে। তবে তোদের দুজনের কী কারণ? বল দেখি।
-আমি তো ছোটখাটো একজন ছড়াকার ও কবি। অনেকে শিশুসাহিত্যকও বলে। গল্প-উপন্যাস লেখাও আমার নেশা সে কি তোদের অজানা? কোনো একজন লেখক বলেছিলেন এরকম জায়গাগুলোতে সফর করলে সাহিত্যের গভীরতা সৃষ্টি হয়। গল্প-উপন্যাসের কাহিনী পাওয়া যায়। কঠিন কঠিন কবিতা লেখা যায়। তো এটাই আমার মূল কারণ। তাছাড়া এরকম ভয়ঙ্কর জায়গাতে ঘোরাফেরার একটুও শখ আমার নেই। প্রাঞ্জল ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল মুহাম্মদ।
আমার আসার কারণ হলো…… মুজাহিদের মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নেয় মুরসালিন। বলে, আগে তো আমারটা শুনবি! আমি এসেছি আনন্দ উপভোগ করতে। এরকম ভয়ঙ্কর জায়গাতে ঘুরে আমি যে মজা পাই তার বিন্দুমাত্র অন্য কোথাও পাই না।
সগর্বে কথাগুলো বলে দু’আঙুল দ্বারা পাঞ্জাবির কলার টানে বিশেষ ধরনের ভাব নেওয়ার চেষ্টা করল মুরসালিন।
দুজনের বলা শেষে মুজাহিদ বলল, এবার আমি বলব?
হুম, তাড়াতাড়ি বল। দেরি করছিস কেন? মুরসালিন তাকে তাড়া দেয়।
আমার আসার আলাদা কোনো কারণ নেই। তোরা এসেছিস তাই আমিও এলাম। বলেই একগাল হাসি ছড়ায়।
এভাবে বৈচিত্র্যময় গল্পগুজবের মধ্যে তারা গন্তব্যে পৌঁছে। ততক্ষণে বিকেলের রক্তিম সূর্যটা ডুববে ডুববে ভাব। দিনের আলো ফিকে হয়ে রাতের আঁধার জন্ম নিচ্ছে। মানুষের কোলাহলের শব্দ থমকে গিয়ে পাখিদের কিচিরমিচির সুরে চারদিক মেতে উঠছে। কোনো জনমানব তাদের চোখে পড়ছে না। লোকালয় এখান থেকে দশ-পনেরো মিনিটের দূরত্বে। আর একটু সামনে এগোলেই ভুতুড়ে বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে ওরা।
সবার আগে হাঁটছে মুরসালিন। এরপর মুজাহিদ। আর মুহাম্মদ সবার পিছনে। ভয়ে মুহাম্মদের পা কাঁপলেও দোয়া-দরুদ পড়ে নিজেকে সাহস জোগাতে চেষ্টা করছে। আর একটু এগুতেই তারা বাড়ির সামনের মাঠটিতে এসে পড়ে। দ্রুত বাড়িটার দিকে তাকায় সবাই।
যতটা ভয়ঙ্কর ভেবেছিলাম ততোটা ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না বাড়িটাকে- বলে তাচ্ছিল্যের হাসি ছড়িয়ে দেয় মুরসালিন।
সে ভেবেছিল বাড়ির মাঝখান দিয়ে একটা দুশো তিনশো বছরের বুড়ো বটগাছ মাথা উঁচিয়ে আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা করবে। পুরো বাড়ির দেয়াল হবে ফাটাফাটা এবং অনেক বেশি পরগাছা ঝুলে পড়বে সেখান দিয়ে। যেন বাড়িটা দেখেই বুকের ভেতরটা আঁতকে ওঠে। মনে পড়ে যায় প্রেতাত্মার কথা!
তিন বন্ধুা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বাড়িটার মূল ফটক ঘেঁষে দাঁড়ায়। কিন্তু পাশে পড়ে থাকা বিড়ি-সিগারেটের খালি প্যাকেট দেখে অবাক হয়। মানুষের যাওয়া-আসা যেহেতু নেই তবে কি এসব ভূত খেয়েছে! নাকি নিত্যদিনই মানুষ এখানে চলাফেরা করে? তারা সতর্ক হয়। নিশ্চয়ই কোনো কারণ তো এর পেছনে আছেই।
চোর ডাকাতের আস্তানাও হতে পারে। ভীত কণ্ঠে মুহাম্মদ বলে ওঠে।
হুম, এটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার কথায় সায় জানায় মুজাহিদ।
ফটকের পাশে একটুখানি ভাঙ্গা অংশ। মুরসালিন সেখানে উঁকি দিয়েই হকচকিয়ে যায়। ঠোটের উপর দু’আঙুল চেপে অতি সাবধানে ভেতরে উঁকি দিতে বলে বাকি দুজনকে। তারা দেখতে পায় চারজন মানুষ গোল হয়ে বসে খুব মনোযোগের সাথে কী যেন করছে!
এরমধ্যে মাগরিবের আজান শেষ। হয়তো নামাজ পড়াও শেষ। তবে প্রকৃতির মাঝে এতোটাই আলো এখনো আছে যার সাহায্যে বিশ পঁচিশ হাত দূরের মানুষগুলোকে অনেকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের এখানে আসার কারণ কী? তা জানার খুব ইচ্ছ মুরসালিনের! যদিও মুজাহিদ, মোহাম্মদ ওকে ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে নিষেধ করেছে। মুরসালিন অভয় দিয়ে বলে, কোনো সমস্যা নেই। আমি তো আছি।
আপাতত লুকিয়ে ওদের ভালো মতো দেখতে পাওয়া যায় এমন একটা নিরাপদ জায়গা প্রয়োজন। বাড়ির পেছন দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে গোয়েন্দাগিরির জন্য সুন্দর একটি জায়গা পেয়েও গেল। যেখানে অনায়াসে লুকিয়ে পাশের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে তাদের দেখতে পাওয়া যায়। লক্ষ্য করা যায় তাদের পরবর্তী গতিবিধি।
খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের মাঝেই কাক্সিক্ষত ঘটনা প্রকাশ হলো। লোকগুলোর আলোচনা তখনও শেষ হয়নি। অন্ধকার বাড়ছে। কয়েকটা মানব মূর্তির নড়াচড়া ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎ ওরা দেখতে পায় পাশের রুম থেকে কী যেন টেনে আনছে তাদেরই একজন। সাথে সাথে একজন মানুষের বিলাপ ধ্বনি। প্রকৃতির মাঝে মিশে যাচ্ছে লোকটার ভয়ার্ত কন্ঠস্বর।
তারা সচেতনতার সঙ্গো কি ঘটতে যাচ্ছে তা লক্ষ্য করেই যাচ্ছে।
আচমকাই তিনটা বুলেটের শব্দ তাদের কানে ধাক্কা খেল। সাথে সাথেই ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তিন গোয়েন্দার শরীর। মোহাম্মদ তো হুঁশ হারিয়ে ফেলবে প্রায়! পায়ের কাঁপাকাঁপিতে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সে। গোয়েন্দাগিরি শেষ। পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে তারা। ভূতবাড়িতে ভূত নয়- ডাকাত থাকে। এবার খুব সাবধানে পালাতে পারলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে তারা।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য