মহাজাগতিক মিটিং- সাঈদ মুহাম্মাদ সানোয়ার

মহাজাগতিক মিটিং- সাঈদ মুহাম্মাদ সানোয়ার

এক
প্রায় এক শতাব্দী পার হয়েছে পৃথিবী থেকে মানব সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে। চৌদ্দশত কোটি বছরের এই মহাবিশ্বের ছোট্ট একটা বিন্দুতে তারা কয়েক মিলিয়ন বছর দাপটের সাথে রাজত্ব করেছিল। কিন্তু কি জানি, এই পৃথিবী নামক গ্রহটা হয়তো কারো দীর্ঘদিনের রাজত্ব সহ্য করতে পারে না। মানুষের আবির্ভাবের আগে পৃথিবীকে তছনছ করেছিল বিশালদেহী ডাইনোসরেরা। সেগুলোর এক-একটির ওজন কয়েক টন পর্যন্ত ছিল। তাদের তুলনায় মানুষ নগণ্য। এই দাপুটে প্রাণীরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তারা পৃথিবীকে ধ্বংস করে যেতে পারেনি। হয়তো এর কারণ তাদের বুদ্ধি ছিল না। আর মানুষের বুদ্ধিই হয়তো পৃথিবীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গাছের ডালে বসবাস করা মানুষ পাহাড়ের গুহাকে তুলনামূলক নিরাপদ মনে করেছিল। এই তুলনা করার শক্তি মানুষের কেন্দ্রীয় প্রসেসিং ইউনিট ১-কে দ্রুত বিকাশে সহায়তা করেছিল। তারা পাহাড়ের গুহা আর বসতবাড়ির সীমানা পাড়ি দিয়ে মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছিল। কিন্তু এক সময় তারা এই তুলনা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। পৃথিবীকে তারা খণ্ড-বিখণ্ড করে নিজেদের অংশ রক্ষার জন্য কি সব ভয়ংকর অস্ত্র তৈরি করেছিল। কামান, গোলা, রকেট মিসাইল, পারমাণবিক বোমা আরো কত ভয়ংকর সব অস্ত্র। একদিন এই সব অস্ত্রের ব্যবহারই সুন্দর, সুজলা, সুফলা, বাসযোগ্য পৃথিবীকে বিষাক্ত করে তুলেছিল। পৃথিবীর সমস্ত জীবগোষ্ঠির জন্য এক ভয়ংকর গ্রহে পরিণত হলো পৃথিবী। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ দুই শতাংশের কমে এসে দাঁড়াল। বিষাক্ত কার্বনে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভারি হয়ে গেল। স্বপ্নের এই পৃথিবী তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক পদার্থের গুদামঘরে পরিণত হলে মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। ঘটনাটা ঘটেছিল আমাদের মহাকাশ ভ্রমণের দুই দশক পরে।
পৃথিবীর বিখ্যাত মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র আলফা কমিউনিকেশনের আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম মহাকাশ ভ্রমণে যাব। অবশ্য ভ্রমণ হলেও কিছু অফিসিয়াল কাজ করতে হবে। আমরা যে গ্যালাক্সিগুলোতে ঘুরব ওগুলোর গ্রহ-উপগ্রহ সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে হবে। আমাদের গ্যালাক্সির বাহিরে অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না, কোনো সংকেত পাওয়া যায় কি নাÑ এসব নিয়েও আমাদের গবেষণা করতে হবে। অনেকের যাওয়ার কথা থাকলেও শেষপর্যন্ত আমরা পাঁচজন বন্ধু প্রস্তুত হলাম। ডেরিয়ান, ক্রিসটোফেন, মারকো, জীবন আর আমি। আমাদের সাথে নিলাম ডজনখানেক ইঞ্জিনিয়ার রোবট, দুইজন ডাক্তার রোবট আর মহাকাশযান কন্ট্রোলের জন্য আরো কিছু রোবট। দীর্ঘ এই যাত্রার আগে আমরা প্রত্যেকে আমাদের পরিবারের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে বিদায় নিলাম। মা আঁচলে চোখ মুছে একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে আমাকে বিদায় দিলেন। আমি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে রুম থেকে বের হলাম। মনে হলো যেন আমি তার চোখের গভীর কোনো খাদে হারিয়ে যাচ্ছি। কোনো বিশাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি!
আমাদের সাথে দীর্ঘদিনের খাবারসহ মহাকাশযানের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি নিয়ে আলফা কমিউনিকেশনের২ সর্বাধুনিক মহাকাশযান ধ্রুব-১০ আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করল। এক এক করে ধ্রুব-১০-এর চারটি ইঞ্জিন গর্জে উঠল। একটা ধাক্কা দিয়ে ধ্রুব অসীম মহাকাশের উদ্দেশে ছুটে চলল । এর বেগ সেকেন্ডে আড়াই লক্ষ কিলোমিটার! ধীরে ধীরে অভিকর্ষ বল৩ কমে যাচ্ছিল। আমি একদৃষ্টে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মায়ের হাসির আড়ালের কান্নাটাকে অনুভব করে চোখগুলো ঝাপসা হয়ে এলো। গত দেড়শো বছরের মহাকাশ ভ্রমণে এই দৃশ্যটা যে আমি কতবার দেখেছি, তা কল্পনাতীত।

দুই
-রাজিব!
ক্রিসটোফেন, আমাদের ধ্রুব-১০-এর ক্যাপ্টেন। তার কণ্ঠে আমি চমকে উঠলাম। “আমরা প্রক্সিমা সেন্টোরির৪ কাছাকাছি চলে এসেছি। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা লাগবে। সবাই প্রন্তুতি নাও।”
“ঠিক আছে” বলে আমি মহাকাশযানের মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে আমার কক্ষের দিকে যাচ্ছি। আমরা প্রক্সিমা সেন্টোরির গ্রহগুলো পর্যবেক্ষণ করব। আর এখান থেকে আমাদের গ্যালাক্সি মানে মিল্কিওয়ে ছায়াপথ মাত্র চার আলোকবর্ষ দূরে। প্রাণহীন, নিথর, বিষাক্ত পৃথিবীতে তো আর ফিরতে পারবো না, তাই আমাদের শেষ গন্তব্য আমাদের প্রতিবেশী গ্রহ মঙ্গলে যাব। মঙ্গল গ্রহ থেকে আমরা কিছু সংকেত পেয়েছি। যার দ্বারা বোঝা যাচ্ছে কিছু মানুষ মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপন করেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে কোনো মহাকাশ কন্ট্রোল রুম নেই। কারণ আমরা ডিটেক্টরের মাধ্যমে এখনো খুঁজে পাইনি। অনেক আগেই মানুষ আয়রন অক্সাইডের আবরণে আবৃত লাল গ্রহটিকে নিজেদের বসবাসের জন্য প্রস্তুত করেছিল। নাসার একদল বিজ্ঞানী দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় মঙ্গলের ৯৬ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন তৈরি করতে পেরেছিল। মোক্সি কার্বন ডাই-অক্সাইড৫ থেকে অক্সিজেনের একটি পরমাণু বের করে অবশিষ্ট কার্বন মনোক্সাইড থেকে তাপ শোষণ করতে থাকলে অক্সিজেনের আগেই কার্বন ঘনীভূত হয়ে আলাদা হয়ে যায়। কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে এনে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াও শুরু করা গিয়েছিল।
আমরা প্রত্যেকে নিরাপত্তা জ্যাকেট পরে নিলাম। প্রক্সিমা সি৬ নামক গ্রহটাতে একটা বিশেষ স্পেসশিপের মাধ্যমে আমরা নামব। আমাদের দীর্ঘ অভিযানের শেষ পর্যবেক্ষণ এই গ্রহে। মহাকাশযানের জ্বালানি প্রায় শেষের দিকে। খুব সাবধানে আমাদেরকে এখানে অবতরণ করতে হবে। এখানে প্রাণের উপস্থিতি আছেÑ এটা নিশ্চিত। তবে তাদের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। তারা যদি আমাদের থেকে বুদ্ধিমান হয়ে থাকে, তাহলে আমাদেরকে নিয়ে তাদের কৌতূহলও একটু বেশি হবে। হয়তো ল্যাবরেটরিতে নিয়ে পিচ পিচ করে সাজাবে। অণুু-পরমাণু, সব আলাদা আলাদা করে দেখবে।
নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিলাম। ত্রিমাত্রিক জগতের৭ এই অস্ত্রগুলো তাদের জগতে কাজ করবে কি নাÑ সেটাও আমরা জানি না। বরাবরের মতো এবারও ধ্রুব-১০-এর দায়িত্ব রোবটদেরকে দিয়ে আমরা বিশেষ স্পেসশিপের মধ্যে গিয়ে বসলাম। বিশেষ বলছি তার কারণ, এই শিপটার কন্ট্রোলারে এমন একটা অ্যালগরিদম রয়েছে যেটা চারপাশের একশ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো মহাজাগতিক প্রাণী থাকলে তা চিহ্নিত করতে পারে। সমতল ভূমিতে এটা আবার গাড়ির মতো চালানোও যায়।
স্পেসশিপের স্ক্রিনে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মহাকাশযানটা প্রক্সিমা সেন্টোরাই নক্ষত্রের সীমানায় পৌঁছে গেছে। এখান থেকে আর মাত্র পনের মিনিটে আমরা প্রক্সিমা সি গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছে যাব। মহাকাশযানের ইঞ্জিনগুলো সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নিঃশব্দে প্রায় দুই লক্ষ কিলোমিটার বেগে ধ্রুব-১০ সি গ্রহের টানে তার কক্ষপথের দিকে এগোচ্ছে।
নির্দিষ্ট কক্ষপথে যাওয়ার পর আমাদের স্পেসশিপটা ধ্রুব থেকে আলাদা হয়ে গেল। আমরা গ্রহের দিকে এগোচ্ছি। ক্যাপ্টেন ক্রিসটোফেন আমাদের সবাইকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দিলেন। প্রত্যেককে তাদের অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে নিতে বললেন। মহাজাগতিক কোনো প্রাণী দেখলেও তাদের উপর আক্রমণ করতে নিষেধ করে দিলেন। হঠাৎ মনে হলো আমাদের স্পেসশিপটা প্রক্সিমা সি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছে। গ্রহটাতে তখন রাত। তবুও একটা উজ্জ্বল আলোয় সমস্ত গ্রহটাকে আলোকিত করে রেখেছে। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সাথে সাথেই স্পেসশিপে দুটি স্ক্রিন অন হয়ে গেল। একটাতে মহাজাগতিক প্রাণীর সংকেত ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে উঠছে আরেকটাতে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাসের পরিমাণ ভেসে উঠছে। মারকো আর জীবন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল।“তেজস্ক্রিয় লেডের পরিমাণ শতকরা ২৫ ভাগ! কার্বন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন কিছুটা পরিমাণ থাকলেও অক্সিজেনের পরিমাণ খুবই কম। মাত্র ০.০১ শতাংশ!”
মার্কোর কথা শেষ না হতেই জীবন বলতে শুরু করল, “খুবই বিষাক্ত বায়ুমণ্ডল! এখানে যে প্রাণীগুলো আছে তারাও নিশ্চয়ই খুব ভয়ংকর। এই বিষাক্ত পরিবেশে তারা কিভাবে বেঁচে আছে?”
“নিশ্চয়ই তারা হয়তো আমাদের চেয়েও বুদ্ধিমান। তারা হয়তো এই পরিবেশে টিকে থাকার মতো প্রযুক্তি তৈরি করেছে যেমন আমরা বায়ো টেকনোলজির৮ মাধ্যমে হরমোন প্রয়োগ করে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য৯ ক্ষয় হ্রাস করতে পেরেছি। এতে আমাদের আয়ু বেড়েছে।”
ডেরিয়ানকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম,“এটা ঠিক যে আমরা আমাদের মৃত্যুকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিয়েছি কিন্তু এতে তো আমাদের একটা বিরাট ক্ষতিও হয়েছে। টেলোমিয়ার হরমোন১০ প্রয়োগের ফলে আমাদের রিপ্রডাক্টিভ সিস্টেম১১ চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে হয়ে গেছে। চিন্তা করতে পারো, আমরা কখনো বাবা হতে পারব না! বংশগতির ধারাবাহিকতা হারিয়ে যাচ্ছিল। জানি না, মঙ্গল গ্রহে মানুষ কিভাবে আছে। তারা আবারও মৃত্যুকে জয় করার নেশায় ছুটছে নাকি অল্পে তুষ্টির গুণ অর্জন করেছে। পণ্যের মতো মানুষের ক্লোন১২ তৈরি করার প্রতিযোগিতা আর চাহিদা মতো বিভিন্ন বুদ্ধিমত্তার মানুষ ল্যাবে তৈরি করার মতো হীন কাজ যদি এখনো তারা করতে থাকে, তাহলে তো পৃথিবীর শান্তি বিনষ্টকারী এই জীবটি মহাবিশ্বের একমাত্র কলঙ্ক!”

তিন
মহাজাগতিক প্রাণীদের সংকেত অনুসরণ করে আমাদের স্পেসশিপটা ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। একটা মৃদু কম্পন করে স্পেসশিপটা ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করলো। আমরা সবার কমিউনিকেশন মডিউলগুলো চেক করে নিলাম। অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো লাগিয়ে ক্যাপ্টেন ক্রিসটোফেনের পিছনে পিছনে আমরা সবাই ভূপৃষ্ঠে নামলাম। চারদিকে একধরনের আলো- আঁধারির খেলা চলছে। অন্ধকার তবে সবকিছু দেখা যাচ্ছে। মনে হয় বস্তুগুলো আলো বিকিরণ করছে। পরিবেশটা মনে হয় খুব ঠান্ডা। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত জ্যাকেটের ভিতর থেকেও কিছুটা অনুভব করা যাচ্ছে। কিছুটা দূরে একটা পাথরের মতো কিছু দাঁড়িয়ে আছে। সেটা থেকে খানিকটা দূরে একটা লম্বা উঁচুনিচু খাদ। ভূপৃষ্ঠের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালিকণাগুলো মনে হয় জ্বলছে। কোথাও কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না। তবে আশেপাশে যে প্রাণীরা আছে, তা তো নিশ্চিত। তাই আমরা সবাই আরো সাবধান হলাম।
চারপাশটা আমরা খুঁজে দেখব। ক্যাপ্টেন আর জীবন একদলে আর আমরা বাকি তিনজন আরেক দলে ভাগ হয়ে স্পেসশিপের চারপাশে একশ গজ জায়গা খুঁজব। কোথাও কোনো প্রাণীর দেখা পাওয়া যায় কি না খুঁজে দেখব।
আমরা চারদিকটা খুঁজে দেখলাম। কিন্তু কোথাও কোনো প্রাণীর দেখা পেলাম না। সবার ভিতরে একটা অজানা আতংক চেপে বসেছে।
হঠাৎ ক্যাপ্টেনের চোখ থেকে হলুদ রঙ্গের একটা তীব্র আলো জীবনের চোখে প্রবেশ করছে। জীবনের চোখ থেকে আরেকটা সবুজ আলো এসে ক্যাপ্টেনের চোখে প্রবেশ করছে। আমরা তিনজন কিছুটা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে একে অপরের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম। আস্তে আস্তে আরো কিছুটা কাছে এগিয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে তাদের কাছ থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে। কিন্তু শব্দটা কি বোঝা যাচ্ছে না।
তাদের অজান্তেই মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে তাদের দেখা হয়েছিল। তারা বুঝতে পারার আগেই সেই প্রাণীরা তাদের শরীর দখল করে নিয়েছে। আমরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলামÑ তারা আলোক রশ্মি বিনিময়ের মাধ্যমে হয়তো এক অপরের সাথে যোগাযোগ করছে। হঠাৎ তারা দুজনে ঘুরে আমাদের দিকে তাকাল। মারকো একবার তাদের দেখে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। তাদের মুখের আকৃতি পরিবর্তন হয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। চোখ দুটি বড় বড় গোলকের মতো হয়ে গেছে। চোখের মধ্যে নানান রকম আলো কিলবিল করছে। একমুহূর্ত তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আমাদের দিকে হাঁটা শুরু করেছে। ডেরিয়ান তার হাতে একটা ভারি অস্ত্র তাদের দিকে তাক করে আছে। মারকো আমাদের দুইজনের পিছনে এসে দাঁড়িছে। আমি ডেরিয়ানকে বাধা দিলামÑ “অস্ত্র চালিও না, ওরা মানুষ। আমাদের বন্ধু!”
“কিন্তু ওদের শরীর তো এ গ্রহের প্রাণীরা দখল করে নিয়েছে, কি ভয়ংকর ভাবে পরিবর্তন হয়েছে ওদের মুখের আকৃতিÑ দেখছো না?”
“ হুম, ওদেরকে আঘাত করলে যদি কোনো ক্ষতি না হয় তার উপর যদি আরো ক্ষেপে যায়, তাহলে তো আমরা ভীষণ বিপদে পড়ব।”
ওরা আমাদের দিকে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। হাঁটার ভঙ্গিটাও পরিবর্তন হয়ে গেছে। মনে হয় মুখের মতো শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু জ্যাকেটের নিচে থাকায় তা দেখা যাচ্ছে না। মারকো চোখ বন্ধ করে আমাদের জড়িয়ে ধরেছে। ডেরিয়ান টান টান করে নিখুঁত লক্ষ্যে অস্ত্রটা ধরে আছে। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে।

চার
ধীরে ধীরে তারা একেবারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে তারা সমস্বরে বলল
-স্বাগত, প্রক্সিমা সি গ্রহে!
আমরা তো ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেছি। কি বলব বুঝতে পারছি না। ডেরিয়ান ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। আমিও চোখ বড় বড় করে একবার ডেরিয়ানে দিকে তাকালাম। মারকো আমাদেরকে ছেড়ে দিয়ে মনে হয় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জীবনের জ্যাকেটের ভিতর থেকে আওয়াজ হচ্ছেÑ
– আপনারা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী। দেড় শতাব্দী আগে আপনাদের বসবাস ছিল পৃথিবী নামক একটা গ্রহে। কিন্তু সেটা এখন আপনাদের বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী।
– কিন্তু আপনি সেটা কিভাবে জানলেন?
আমার প্রশ্নে মনে হয় বেচারা কিছুটা অবাক হয়েছে।
– আমাদের একটা দলসহ আমি একবার পৃথিবীতে গিয়েছিলাম অনেক বছর আগে এবং পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার সময়ও আমাদের একটা দল পৃথিবীতে ছিল। তারা সব কিছুর ডাটা সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে। আমি মানুষদেরকে নিয়ে অনেক গবেষণা করেছি। স্ব-স্বীকৃত এই বুদ্ধিমান প্রাণীদের আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি।
-কিন্তু আমরা তো কখনো পৃথিবীতে কোনো মহাজাগতিক প্রাণীর আগমনের কথা শুনিনি!
– আমাদের আকৃতি আপনাদের হিসাবে ১০-২ সেন্টিমিটার। অনেক ক্ষুদ্র! আমরা অনায়াসেই যে কোনো বস্তুর আকৃতি ধারণ করতে পারি এবং সেই বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যেমন আপনাদের দুইজন বন্ধুর শরীর নিয়ন্ত্রণ করছি।
মারকো পিছন থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আপনারা আমাদের বন্ধুদের ছেড়ে দেবেন না?”
– অবশ্যই দেবো। অন্য কোনো বস্তুর আকৃতি ধারণ করলে হয়তো আপনারা ভয় পেয়ে যেতেন। তাই আমরা মানুষের আকৃতিতেই দৃশ্যমান হয়েছি। আপনারা আমাদের অতিথির মতো। আসুন আপনাদেরকে আমাদের গ্রহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানাই।
ডেরিয়ান তার অস্ত্রটা জ্যাকেটে ঢুকিয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “পৃথিবী ধ্বংসের সময় যে দলটা পৃথিবীতে ছিল আমরা আগে তাদের সাথে দেখা করতে চাই।”
– ঠিক আছে চলুন তাহলে।
ক্যাপ্টেন আর জীবনের রূপধারী মহাজাগতিক প্রাণী দুটির পিছনে পিছনে আমরা হাঁটছি। কিছুক্ষণ পর আমরা আলোকোজ্জ্বল, সুনসান একটা জায়গায় উপস্থিত হলাম। হঠাৎ চারপাশে নানান রকম আলোর ঝলকানি শুরু হলো। ক্যাপ্টেন আর জীবনের চোখ থেকেও কিছু আলোক রশ্মি বের হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকটি পাথরের মতো কিছু আমাদের সামনে উপস্থিত হলো। জীবন আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “পৃথিবী ধ্বংসের সময় এরা পৃথিবীতে ছিল। আপনারা এদেরকে প্রশ্ন করতে পারেন।”
আমি কিছু জিজ্ঞেস করতেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মারকো বলে উঠল, “এই আলোগুলো কিসের?”
জীবন বলল, “মানুষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বাকযন্ত্র থেকে বিশেষ উপায়ে কিছু শব্দ তৈরি করে আর অন্য জন তা একটা জটিল উপায়ে শ্রবণ করে। কিন্তু আমরা বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে আলো বিকরণ করে যোগাযোগ রক্ষা করি।”
ডেরিয়ান পাথর সদৃশ প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা পৃথিবী ধ্বংসের প্রায় বিশ বছর আগে মহাবিশ্ব ভ্রমণের জন্য বের হয়েছি। এরপর হঠাৎ একদিন আমাদের কন্ট্রোল রুম থেকে বলল, “পৃথিবীতে কিছু ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে বিভিন্ন প্রাণী মারা যাচ্ছে। মনে হয় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এই বার্তার পর আমরা আর কোনো সংকেত পৃথিবী থেকে পাইনি।”
একটা প্রাণী একটু নড়েচড়ে উঠে বলতে শুরু করল, “কিছু দেশ তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারা একে অপরের উপর বিভিন্ন প্রাণঘাতী রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হামলা করে। সারা পৃথিবীতে কয়েক হাজার পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এক দেশ আরেক দেশকে লক্ষ্য করে মিসাইল নিক্ষেপ করে। টানা কয়েক দিনের যুদ্ধে পৃথিবী থেকে গাছপালা, বিভিন্ন প্রাণী প্রায় উজার হয়ে যায়। অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। বিষাক্ত কার্বনে পৃথিবী গিজগিজ করতে থাকে। নানা রকম তেজস্ক্রিয় পদার্থে ভরে ওঠে পৃথিবী। তারপর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত জীব ধ্বংস হয়ে যায়। সূর্য থেকে আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি এখন সরাসরি পৃথিবীতে প্রবেশ করছে। পৃথিবী আগামী কয়েকশ মিলিয়ন বছরেও মানুষের বাসযোগ্য হবে কি সন্দেহ!”
আমি বললাম, “আমরা মঙ্গল গ্রহে ফিরে গিয়ে বসবাস করতে চাচ্ছি। সেখানে আমাদের কিছু স্বজাতিরা আছে। আপনারা কি এ বিষয়ে কিছু জানেন?”
“হ্যা, আগে থেকেই কিছু মানুষ মঙ্গল গ্রহে বসবাস করছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অনেকে সেখানে চলে গেছে। আমরা পৃথিবী থেকে ফেরার পথে মঙ্গল গ্রহে উঠেছিলাম। কিন্তু তারা সেখানে তখনো অনেকটা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে জীবন যাপন করছিল। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পানি এবং অক্সিজেনের খুব সামান্যই তারা যন্ত্রের মাধ্যমে তৈরি করতে পেরেছিল। কিছু গাছপালাও তারা লাগিয়েছিল।”
“ভবিষ্যৎ মঙ্গল গ্রহকে বসবাসের জন্য সুন্দর করে গড়ে তুলতে আপনাদের কোনো পরামর্শ আছে?” ডেরিয়ানের প্রশ্নের জবাবে আরেকজন প্রাণী বললেন,“মঙ্গলে মানুষকে মানবিক হতে হবে। সীমানার প্রাচীর ভেদ করে উদার সমাজ গড়তে হবে।”
একটু পিছনে থাকা একটা মহাজাগতিক প্রাণী বলে উঠল, ‘উচ্চাকাক্সক্ষা’ ত্যাগ করে, অল্পে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।”
একটা প্রাণীর আকার কিছুটা বড় হতে হতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসল। আমাদেরকে একটা যন্ত্র দিয়ে বলল, “এটা আমাদের গ্রহের সাথে কমিউনিকেশন যন্ত্র। সরাসরি এই যন্ত্রের মাধ্যমে আমরা যোগাযোগ করতে পারবো। আজকের এই মহাজাগতিক মিটিং এ প্রক্সিমা সি গ্রহের পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য এটা উপঢৌকন।”
আমরা তিনজন উপহার গ্রহণ করে ধন্যবাদ দিলাম। “আপনাদের এই উপহার এই মহাবিশ্বে বহিঃনাক্ষত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বার উন্মুক্ত করবে বলে আমরা আশাবাদী।”
ক্রিসটোফেন আর জীবনের রূপ থাকা মহাজাগতিক প্রাণীরা মিটিং শেষে আমাদের সাথে স্পেসশিপ পর্যন্ত চলে আসল। তারপর আমাদেরকে বিদায় জানিয়ে তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে সবুজ রঙের রশ্মি বিনিময় করল। কি জানি তার মানে কি!
এরপর হঠাৎ দুইজনে মাথায় হাত দিয়ে ঢুলছে। মনে হলো ভারসাম্য হারিয়ে পরে যাবে। তার আগেই আমরা তাদের ধরে ফেললাম। এরপর তাদেরকে নিয়ে আমরা স্পেসশিপে উঠলাম। অনেকক্ষণ তাদের জ্ঞান ফিরল না। ততক্ষণে আমরা মূল মহাকাশযান ধ্রুব-১০-এ ফিরে এসেছি।
ধ্রুব-১০ এর ইঞ্জিনগুলো গর্জে উঠলো। প্রক্সিমা সি’র মহাকর্ষ ভেদ করে মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে ছুটে চললাম আমরা। যখন তাদের জ্ঞান ফিরল, সমস্ত ঘটনা শোনার পর মহাকাশে একটা হাসির রোল পড়ে গেল।

নির্ঘণ্ট
১. কেন্দ্রীয় প্রসেসিং ইউনিট : যেখানে সমস্ত তথ্য প্রক্রিয়াকরণ হয়। মানুষের মস্তিষ্ক।
২.আলফা কমিউনিকেশন : কাল্পনিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
৩. অভিকর্ষ বল : গ্রহ বা উপগ্রহ কোনো বস্তুকে যে বলে আকর্ষণ করে।
৪. প্রক্সিমা সেন্টোরি : একটি অনুজ্জ্বল লাল বামন নক্ষত্র, এটি পৃথিবী থেকে ৪.২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। সূর্যের তুলনায় এর ভর মাত্র ১২ শতাংশ এবং উজ্জ্বলতা ১/৬০০ ভাগ।
৫. মোক্সি : মার্স অক্সিজেন ইন-সিটু রিসোর্স ইউটিলাইজেশন এক্সপেরিমেন্ট। নাসার আবিষ্কৃত যন্ত্র যা কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে ব্যবহার যোগ্য অক্সিজেন এবং বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড তৈরি করে। কিন্তু গল্পে উল্লেখিত মোক্সি অত্যাধুনিক,যা কার্বন মনোক্সাইড কে বিশ্লেষণ করে অক্সিজেন এবং কার্বন আলাদা করতে পারে।
৬. প্রক্সিমা সি : প্রক্সিমা সেন্টোরিকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণনরত কাল্পনিক গ্রহ।
৭. ত্রিমাত্রিক জগৎ : দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা নির্ভর জগৎ। যেমন: পৃথিবী, চাঁদ।
৮. বায়ো টেকনোলজি : জীবন্ত জীব দেহাংশ ব্যবহার করে মানব কল্যাণে ব্যবহার করার পদ্ধতি।
৯. টেলোমিয়ার : ক্রোমোসোমের দুই প্রান্তের বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঞ্চল, যা নির্ধারণ করে একটি কোষ আর কতবার বিভাজন হবে।
১০. টেলোমিয়ার হরমোন : কোষ বিভাজনের সময় টেলোমিয়ারের ক্ষয় হ্রাসকারী কাল্পনিক হরমোন। যা প্রয়োগ করলে মানুষের আয়ু বেড়ে যায়।
১১. রিপ্রডাক্টিভ সিস্টেম : প্রজননতন্ত্র।
১২. ক্লোন : মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর কোষ ব্যবহার করে প্রতিরূপ তৈরির পদ্ধতি।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য