মাতৃভাষা : রক্তিম ইতিহাস

মাতৃভাষা : রক্তিম ইতিহাস

বাংলা। মধুর ভাষা। এ ভাষার রং লাল। এ ভাষায় প্রতিটি বর্ণমালা রক্তিম। এ ভাষার কারণেই হয়েছিল মায়ের বুক খালি। এ ভাষার ইতিহাস লেখা ভোরের রক্তিম সূর্যটায়। আমাদের এই মাতৃভাষা আন্দোলন হয়েছিল দুই পর্যায়ে: ১৯৪৭ থেকে ’৪৮ এবং ১৯৫০ থেকে ’৫২ পর্যন্ত।

প্রথম সংগ্রাম:
১৯৪৭। তখন ডাকটিকিট ছিল উর্দু ভাষায় এবং সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাও দিতে হত উর্দুতে। জুলাইয়ে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। তখন তার বিরুদ্ধে ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ চমৎকার এক প্রবন্ধ লিখেন। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, মিরপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্যোগে প্রথম পত্রিকা প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা: উর্দু না বাংলা’ এই শিরোনামে।
১ অক্টোবর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর প্রথম আহ্বায়ক ছিলেন ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন। এবং বিভিন্ন জেলায় এর শাখা গঠিত হয়।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শিক্ষামন্ত্রী এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী বরাবর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পেশ করা হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ববাংলা গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি জানান।
ধীরে ধীরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ কর্তৃক প্রতিবাদ, মিছিল ও ধর্মঘট জোরদার হলে, ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী খাজা নিজামউদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দাবি মেনে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু এর পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।
বরং ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় ও ২৪ মার্চ কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে প্রতিনিধিদল দাবিনামা নিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করে।
তমদ্দুন মজলিশ ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ১১ মার্চকে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে। তাদের মুখপাত্র ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫০ সালের ১৮ এপ্রিল কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে আরবি হরফে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেয়া হয়।

দ্বিতীয় সংগ্রাম:
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টনে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বাংলাভাষী ছাত্র সমাজ ও নেতৃবৃন্দ।
৩০ জানুয়ারি গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় কর্মপরিষদ’। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ’র নেতৃত্বে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ১১, ১২, ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস উদযাপিত হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি আবারো ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নুরুল আমিন সরকার একমাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেন। তবুও বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ পরেরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের লক্ষ্যে সারারাত ছাত্রাবাসে প্রস্তুতি নেয় এবং বহু প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন তৈরি করে।
একুশে ফেব্রুয়ারি সকালবেলা। শেখ আব্দুস সামাদের পরামর্শ মতে ছাত্ররা দশজনের দলে বিভক্ত হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। পক্ষান্তরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ফলে ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। উপায় না দেখে ছাত্ররা আইনসভা পরিষদে গিয়ে দাবি উত্থাপনের জন্য রওনা দিলে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে। ফলে ঝরে পড়ে আব্দুস সালাম, আবুল বরকত, রফিকুল ইসলাম, আব্দুল জব্বার ও আব্দুল আহাদের তাজা প্রাণ। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। বাংলার বর্ণমালা হয় লালে লাল।
ভাষার তরে রক্তদানের এ প্রথম ও শেষ ইতিহাস-ই ৮ ফাল্গুনের রক্তরাঙা প্রভাতে গুলমেহেরের শাখায় শাখায় ফুটে ওঠে। আর প্রতিবছরই আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় ভাষাশহীদদের কথা।
কিন্তু আমরা কি তাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করি? যাদের সম্মানার্থে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এবং আজও পর্যন্ত তা বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে।
আমরা কি রেখেছি তাদের রক্তার্জিত ভাষার মান? যে ভাষাকে ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সংবিধান ২১৪(১)অধ্যায়ে স্বীকৃতি দেয়- “ঞযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ ংযধষষ নব ঁৎফঁ ধহফ নধহমষর.”
এত কষ্টে কেনা ভাষার বিশুদ্ধ চর্চা যেন হয় সর্বমহলে। এ আহ্বান খাঁটি বাঙালিদের প্রতি।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য