মুসলিমদের হারিয়ে যাওয়া কাশ্মীর
তাশরিফ মাহমুদ
–
তুমি কি কাশ্মীরের নাম শুনেছ? শুনেছ নিশ্চয়ই। ছবির মতো সুন্দর
পাহাড়, বরফে ঢাকা গাছ, ফুলের মাঠ, শান্ত লেক-সব কিছু মিলে এক
অপার সৌন্দর্যে ভরপুর কাশ্মীর। একে বলা হয় ‘পৃথিবীর জান্নাত’। কিন্তু
সেই জান্নাতে এখন ভয়, দুঃখ আর শূন্যতা। কাশ্মীরের মূল জনগণ
মুসলিমর, তাঁরা এখন অনেক কিছু হারিয়ে ফেলতে পারে নিজেদের।
যেমন কেউ হারিয়ে ফেলে নিজের বাড়ি, নিজের নাম, নিজের চেনা
রাস্তা তেমনই কাশ্মীরের মুসলমানরাও ভবিষ্যতে আরও হারিয়ে
ফেলতে পারে নিজেদের পরিচয়, সংস্কৃতি, এমনকি স্বপ্ন দেখার
সাহসটুকুও।
শত বছরের ইতিহাস, রাজনীতি আর যুদ্ধের কারণে কাশ্মীর এমন
জায়গায় দাঁড়িয়ে, যেখানে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে গেছে।
কীভাবে এমন হলো? কীভাবে এক স্বর্গভূমি ধীরে ধীরে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে উঠল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই আমাদের
কাশ্মীরের গল্পে যাত্রা।
অনেক আগে কাশ্মীর ছিল বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র।
এরপর মুসলমান শাসকেরা আসেন, কাশ্মীরে
ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই শান্তিপূর্ণভাবে
ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলামের আলোয়
এখানকার প্রায় জনগোষ্ঠি উদ্ভাসিত হয়।
১৮৪৬ সালে ব্রিটিশরা কাশ্মীর ‘বিক্রি’ করে দেয়
হিন্দু রাজা গুলাব সিংয়ের হাতে। শুরু হয় মুসলমান
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ওপর সংখ্যালঘু হিন্দু
শাসকের শাসন। মুসলমানরা ছিল কৃষক, শ্রমিক,
আর রাজার প্রশাসন ছিল উচ্চবর্ণ হিন্দুদের হাতে।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়। তখন
কাশ্মীর স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পাকিস্তানি
উপজাতিদের হামলা আর ভারতের চাপের মুখে
পড়ে কাশ্মীরের হিন্দু রাজা ভারতের সঙ্গে
‘যোগদানের দলিল’ স্বাক্ষর করেন। তখন থেকেই
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ, সেনা
মোতায়েন আর সীমান্ত বিভাজনের মধ্যে পড়ে
কাশ্মীর।
এই বিভাজনের সবচেয়ে বড় শিকার হন
কাশ্মীরিরা। বিশেষ করে মুসলমানরা পড়ে চরম
সংকটে, যুদ্ধ, সেনা পাহারা, রাজনৈতিক বিভাজন
আর সাংস্কৃতিক নিঃশেষণের শিকার হয়ে।
কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও ৩৭০ ধারা
অনুযায়ী তার কিছু ‘বিশেষ মর্যাদা’ ছিল। যেমন:
কাশ্মীরে বাইরের লোক জমি কিনতে পারত না, কাশ্মীরি জনগণ নিজেরা আইন বানাত, নিজেরা
প্রশাসন চালাত। কিন্তু ২০১৯ সালের আগস্টে হঠাৎ
এক ঘোষণায় ভারত সরকার এই ধারা বাতিল করে
দেয়।
তারপরই কাশ্মীরিদের জীবনে নেমে আসে গভীর
অন্ধকার। মোবাইল, ইন্টারনেট, সংবাদপত্র, সব
বন্ধ। চারদিকে সেনা, পাহারা, আতঙ্ক। হাজার
হাজার তরুণকে বিনা কারণে গ্রেপ্তার করা হয়।
কাশ্মীরিদের কণ্ঠ যেন চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়।
কেউ কিছু বলতে পারছিল না, কেউ কিছু শুনতেও
পাচ্ছিল না।
এর মানে দাঁড়ায় কাশ্মীর এখন আর কাশ্মীরিদের
নয়। বাইরের মানুষ এসে জমি কিনতে পারছে,
ব্যবসা খুলতে পারছে, চাকরি পাচ্ছেÑযেখানে
কাশ্মীরিরা নিজের ঘরেও এখন অতিথি হয়ে
পড়েছে।
কাশ্মীরে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ মুসলমান।
কিন্তু তারা আজ সেখানে সবচেয়ে বেশি
অনিরাপদ। কোনো প্রতিবাদ করলেই সেনাবাহিনী
এসে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। মুসলিম তরুণদের
সন্দেহের চোখে দেখা হয়, যেন তারা অপরাধী।
কাশ্মীরি মুসলমানদের ভাষা উর্দু বা কাশ্মীরি, কিন্তু
এখন হিন্দিকে সরকারিভাবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ধর্মীয় উৎসব, মসজিদে জমায়েত, ইসলামিক
পোশাক এসবও সন্দেহের চোখে দেখা হয়।
তাদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, ইতিহাস সব কিছু ধীরে
ধীরে মুছে ফেলা হচ্ছে। স্কুলে কাশ্মীরি ইতিহাসের বদলে অন্য রাজ্যের ইতিহাস পড়ানো হয়। তাদের
মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ‘তোমরা এখানে
একেবারেই অগুরুত্বপূর্ণ।’
কাশ্মীরি কিশোররা এখন আর স্বাভাবিক জীবন
কাটাতে পারে না। স্কুলে যেতে গেলেও সেনার
চেকপোস্টে দাঁড়াতে হয়। মাঠে খেলতে
গেলেও হুমকি শুনতে হয়।
মোবাইল ব্যবহার করলে
সন্দেহ হয় ‘তুমি হয়তো
সন্ত্রাসী’।
অনেকে বলেও
ফেলে ,
‘আমরা জন্ম
থেকেই অপরাধী
হয়ে গেছি,
কেউ
আমাদের
মানুষ ভাবে
না।’ কেউ
কেউ ভয় পেয়ে
চুপ করে যায়,
কেউ আবার ঘরে
বসে কাঁদে। আর কেউ
কেউ সাহস করে দেয়ালে লিখে
ফেলে, ‘আমি কাশ্মীরি। আমার কণ্ঠ
তুমি চুরি করতে পারো, কিন্তু আমার হৃদয় নয়।’
কাশ্মীরের স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে আজ ভয় ছড়ানো
হয়। সাংবাদিকরা কী লিখবে, তা আগে অনুমোদন
নিতে হয়। অনেক সাংবাদিককে রাতের আঁধারে
ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কেউ কেউ নিখোঁজ হয়ে
গেছে। অর্থাৎ কাশ্মীরের সত্য কাশ্মীরিরাও জানতে
পারে না। সত্য বলার স্বাধীনতা কেটে ফেলা হয়েছে
তরবারির মতো।
জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান
রাইটস ওয়াচ সবাই বলেছে, কাশ্মীরে
মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। কিন্তু ভারতের সরকার
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে।
একদিকে কথা বলা বন্ধ, অন্যদিকে বিচার চাওয়ার
পথও রুদ্ধ। কাশ্মীরি মুসলমানদের জীবনে যেন এক
চুপচাপ মৃত্যু ঘটছে না গুলিতে, না বোমায়, বরং
আত্মা আর স্বপ্নের নিঃশেষে
আমরা যারা অন্য রাজ্যে বা দেশের বাসিন্দা তাদের
অনেকেই কাশ্মীর নিয়ে চুপ থাকি। কেউ ভাবে,
ওটা তো ভারতের ভেতরের বিষয়। কেউ ভাবে,
ওটা রাজনীতি। কিন্তু মানবতা আক্রান্ত হলে কোনো
রাজনীতি কী থাকে?
আমরা যদি আজ চোখ ফিরিয়ে নিই, তাহলে
কাল আর কারও পাশে দাঁড়াতে
পারব না। কাশ্মীরের
মুসলমানরা আজ হারিয়ে
যাচ্ছে আমরা কি
শুধুই দর্শক?
নিরব থাকবে
কী আমাদের
কলম, শিল্প,
সাহিত্য, কণ্ঠ,
সেমিনার,
সংবাদ ,
সাংবাদিকতা?
তুমি যদি ভাবো
‘আমি তো ছোট,
আমার কীই-বা
করার আছে’, তাহলে
জানো, পৃথিবীর অনেক বড়
পরিবর্তন এসেছে কিশোরদের
হাত ধরে। তোমার একটা প্রশ্ন, একটা
লেখা, একটু সচেতনতা কারও জন্য আশার আলো
হতে পারে।
তুমি কাশ্মীরের গল্প জানো, এখন তুমি চুপ থাকবে
না। তুমি হয়তো একদিন লেখক হবে, সাংবাদিক
হবে, নেতা হবে তখন যেন সত্য বলার সাহস
থাকে তোমার চোখে, জবানে ও কলমে। যেন তুমি
বলতে পারো, ‘আমি কাশ্মীরের পাশে ছিলাম,
কারণ ওরা ছিল মানুষ।’
কাশ্মীর হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে তার ইতিহাস,
ভাষা, সংস্কৃতি ও অনুভব। কাশ্মীরের মুসলমানরা
আজ যদি নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে হয়তো একদিন
তোমার গল্পও কেউ শুনবে না। তাই আমাদের
দরকার সাহস, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর
হৃদয়।
কাশ্মীরের আকাশে আবার হাসুক শিশুর মুখ,
পাহাড়ে বেজে উঠুক মানবতার গান এই কামনায়,