যে সুর বেজে ওঠে হৃদয়ের বেতারে- আবদুল্লাহ শাকের

যে সুর বেজে ওঠে হৃদয়ের বেতারে- আবদুল্লাহ শাকের

মদীনার নবীপ্রেমী আনসারী লোকগণ আগে থেকেই জেনে গিয়েছিলেন আল্লাহর রসূল প্রাণের প্রিয়তম নবী আসবেন মদীনায়। তাই তারা নবীজির শুভ আগমনকে খোশ আমদেদ জানাতে প্রতিদিন সাতসকালে সানিয়্যাতুল বিদা নামক উপত্যকার পানে বেরোতেন। ওখানে উপত্যকার পাদদেশে নবীজির আগমনের প্রতীক্ষা করতেন দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। সকালের বেলা গড়িয়ে যখন সূর্যের আলো মাথার উপর বেয়ে শুকনো মরুর বালিতে চিকচিক করতো, তখন তারা হৃদয়ে বিষণ্নতা নিয়ে, একরাশ মলিনতা নিয়ে নিজ নিজ ঘরে ফিরে আসতেন। তবুও মন থাকে নবীজির প্রতীক্ষায়…
প্রতিদিনের মতো আজও ছুটলেন মদীনার পুরুষ, জোয়ান, শিশু-কিশোর সানিয়্যাতুল বিদার দিকে। এক স্নিগ্ধময় ঊষালগ্নে। জানা তো নেই প্রিয়তম নবী কখন এসে পড়েন! সবার মনে একই সুর, এই বুঝি নবীজি আসছেন। উঁচু উঁচু পাহাড় ঘেঁষে। পথের ধুলো-সিকতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে। কিন্তু না,আজও মদীনাবাসীদের না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরতে হলো। তাদের মন আজ ভার ভার।
এমন সময় মদীনার এক ইয়াহুদী নবীজিকে দেখতে পেলো-গ্রীষ্মের রোদে ফুটন্ত বালিময় পথ মাড়িয়ে আসছেন মদীনার দিকে। ধীর পায়ে। শান্ত ভাবে। ইয়াহুদী আগে থেকেই জানতো মদীনাবাসীদের মনের বাসনার কথা। তাই সে চিৎকার করে ডেকে ডেকে সবাইকে জানিয়ে দিলো নবীজির আসার কথা। সেই আওয়াজ শুনতেই মদীনাবাসী উজ্জীবনী শক্তি ফিরে পেলো। নারী ও শিশুরা ঘরের ছাদে ছাদে অপেক্ষমান। পুরুষেরা দলবেঁধে ছুটলো প্রাণের প্রিয়তমকে আহলান সাহলান জানাতে।
তারা গিয়ে দেখতে পেলো একটি গাছের ছায়ায় নবীজি আর সঙ্গী আবু বকর বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
তারা নবীজিকে আগে কখনো দেখেনি তাই কেউ কেউ আবু বকরকে নবী ভেবে সালাম দিচ্ছিলো।আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু বিষয়টি বুঝতে পেরে একটি চাদর নবীজির মাথায় মেলে ধরলেন। ফলে সকলের ভুল ও সংশয় দূর হলো। একটু পরে তারা আবেদন করলো, “ইয়া রসূলাল্লাহ! তাশরীফ নিয়ে চলুন। আপনি সব দিক দিয়ে নিরাপদ। আপনি যা-ই বলেন তা-ই শোনা হবে এবং মানা হবে।”
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সঙ্গী আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহু প্রায় পাঁচশতো লোকের কাফেলার সামনে থেকে রওনা করলেন মদীনার দিকে। বিশাল কাফেলার কী সুন্দর দৃশ্য! নবীজিকে কাছে পেয়ে সকলের তনুমনে খুশির ঢেউ বয়ে চলেছে। মনে প্রাপ্তির আহ্লাদ। এতোদিনের প্রতীক্ষা সফল হলো। নবীজির দশ বছরের খাদেম আনাস রাযিআল্লাহু আনহু বলেন, ‘এরপর আমরা আর কখনো এমন দৃশ্য দেখতে পাইনি।’ মানুষজন পথে পথে, চলাচলের রাস্তায়, ঘরের ছাদে, ঘরে দোরে জমায়েত হলো। সকলের মুখে একই কথা:
‘ আল্লাহু আকবার
আল্লাহর রসূল তাশরীফ এনেছেন
আল্লাহু আকবার
মুহাম্মদ এসেছেন
আল্লাহু আকবার
প্রিয় মুহাম্মদ এসেছেন
আল্লাহু আকবার
আল্লাহর রসূল তাশরীফ এনেছেন!
মুসলমানরা নবীজির শুভ আগমনকে খোশ আমদেদ জানালো। আনন্দে উদ্বেলিত হলো। যেনো এমন মুহূর্ত আর অমন আনন্দ আর কোনোদিন হয়নি তাদের। খুশিতে মদীনা ভেঙে পড়লো। গর্বে আর সুখে ফুলে ফুলে দুলে দুলে উঠছে। নিষ্পাপ শিশু-কিশোরদের কণ্ঠ বেয়ে বেরিয়ে এলো ঐতিহাসিক সঙ্গীত। মধুময় সুর। সেদিন তলাআ’ল বাদরু আলাইনার সুরে সুরে মেতেছিলো মদীনার চারধার। জোর আওয়াজে উচ্চারিত হয়েছিলো-
“আঙিনাতে উদয় হলো পূর্ণিমাচাঁদ
উপত্যকা সানিয়্যাতুল বিদা হতে..
তাই তো মোরা কৃতজ্ঞশীল
দিঘল সময়- অনন্তকাল!
হে প্রিয়জন, খোদার রসূল, ভালোই হলো
আপনি এলেন ইতায়াতের বারতা নিয়ে; মানবো মোরা
ধন্য হলো এই মদীনা, এই মদীনার মানুষগুলো
তাই তুলেছি মারহাবা রব; খুশির ফাগে, অনুরাগে।”
দেড় হাজার বছরের সময় পেরিয়ে আজও এই সঙ্গীত অমর হয়ে আছে মুসলমানের হৃদয়-মনে। সকলের ঠোঁটে ঠোঁটে উচ্চারিত হয় এই সুরসঙ্গীত।
মদীনার সাহাবায়ে কেরাম দীর্ঘ দিনের আকাক্সিক্ষত প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাছে পেয়ে ধন্য হলো। শান্ত হলো এতোদিনের ব্যাকুল হৃদয়।এক হাজার পাঁচশো বছরের আগের সেই সুর ও সঙ্গীত আজও বেজে ওঠে হৃদয়ের বেতারে..

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment