১.
ছবির মতো সুন্দরগ্রাম রসুলপুর। গ্রামের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে সর্পিলাকার নাগর নদী। গ্রামের মানুষও খুব সহজ সরল। কৃষকরা সোনা ফলানো মাঠে সোনার বীজ বপণ করে। বাড়ির কৃষাণীরাও সমানতালে কৃষকের সাথে ক্ষেতে কাজ করে। সেই বীজ থেকে ফসল হয়ে কৃষকের গোলা ভরে যায়।
সংসারের জন্য খানিকটা জমা করে বাকিটা বাজারে বিক্রি করে দিব্বি সুখে কেটে যায় তাদের দিন। গ্রামবাসীর কোনো দুঃখ কষ্ট নেই। গ্রামের ধনীরা দরিদ্রের অভাব অনটনে পাশে দাঁড়ায়।
একে অপরের সুখ দুঃখের সাথি হয়। যেন গ্রামের সবাই সবার একসুতোয় বাঁধা আপনজন।
শীতের কুয়াশাঘেরা সকালে গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহ করে। ঘরে ঘরে পিঠা-পুলি বানানোর উৎসব জমে ওঠে। পুরো গ্রাম পিঠা-পুলির মিষ্টি ঘ্রাণে মৌ মৌ করতে থাকে। গ্রামের মেয়েরা স্বামীর বাড়ি থেকে স্বামীসহ বাবার বাড়ি বেড়াতে আসে। গ্রামে তখন আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।
২.
নদীর পাড় থেকে বিশকদম দূরে রইস আলী চাচার বাড়ির উঠোনের একপাশে বিরাট এক বটগাছ। এটি গ্রামের সবচেয়ে পুরনো এবং বড় বটগাছ। গ্রামের জীবিত কেউই এই গাছের জন্ম দেখে নি। চারিদিকে বিশাল জায়গাজুড়ে ডালপালা মেলে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে গাছটা।
বটের ডালে ডালে পাখিদের কিচিরমিচির রব শোনা যায়। দিনেরবেলা পাখিরা এখানে বসে গা জিরোয়। এখানেই তাদের বাসা। রাতে এখানেই থাকে।
৩.
গরমের সময় যখন লোকদের কাজ কর্ম থাকে না তখন গাছের দিগন্ত প্রসারী ছায়ায় বসে গ্রামবাসী অবসর সময় কাটায়। নদীর পাড় থেকে মনমাতানো শীতল সমীরণ এসে গা জুড়িয়ে দেয়। বটতলায় বাবা-চাচারা নিয়মিত গল্পের আসর বসায়। মা-ঝিরা পানের ডাবরি নিয়ে বসে বিরাট গাছের ছায়ার একপাশে মনের আল্পনা মিশিয়ে বিভিন্ন আকৃতির নকশিকাঁথা সেলাই করে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নানা ধরনের খেলায় মেতে ওঠে। কানামাছি, গোল্লাছুট, কুতকুত, ডাংগুলি হলো তাদের প্রিয়খেলা।
বটতলার পাশ দিয়ে গ্রামের প্রধান পায়ে হাঁটাপথ গিয়ে গ্রামের শেষ মাথায় ঠেকেছে। গ্রামের সবারই এ পথ ধরে যাওয়া আসা করতে হয়। তাই বটতলায় বসেই গ্রামের সবার আনাগোনা দেখা যায়।
৪.
সেদিনও লোকেরা বটতলায় বসে অলস সময় পার করছিল। লোকেরা সেই আলপথ দিয়ে আসে-যায়। কারো প্রতি কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। বিকেলবেলা যখন অগ্নিতাপ ছড়ানো সূর্যের তেজ কমে গিয়ে ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগছিল তখন জীর্ণবস্ত্র শীর্ণ দেহী এক অপরিচিত বৃদ্ধ লাঠির ওপর ভর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে গ্রামে প্রবেশ করে। বটতলার কেউই তার প্রতি প্রথমে খেয়াল করেনি। বৃদ্ধ লোকটি হেঁটে হেঁটে বটের ছায়ার শেষপ্রান্তে মহিলারা যেখানে কাঁথা সেলাই করে সেখানে এসে জিজ্ঞেস করে- মাগো, কেউ একজন বল দেকিনি, পচ্চিম পাড়ার ঐ তায়েবের মা’র বাড়ি কোনডা?
মহিলারা তায়েবের মা’র কথা শুনে জ্বিন দেখার মতো চমকে উঠল। কারণ আশেপাশের দশ গ্রামের বাচ্চা-বুড়ো সবাই জানে তায়েবের মা একজন পাক্কা ডাইনিবুড়ি ছিল। তাকে ঘিরে অনেক ভয়ানক ভয়ানক কাহিনি মা-ঝিদের রাতের গল্পের আসরের প্রধান উপজীব্য।
গ্রামবাসীরা তাকে তিরিশ-চল্লিশবছর আগে গ্রামছাড়া করেছিল। এখন তায়েবের মা’র বাড়ি ঘন ঝোঁপঝাড়ে ভর্তি। শ্যাওলা ধরা পাঁচিল আর ভাঙা ঘর-দোর। ইঁদুর আর সাপ-খোপের আখড়া।
তায়েবের মা’র বাড়ি গ্রামের এককোণে। রাতেরবেলা তো অবশ্যই দিনেরবেলায়ও পারলে কেউ এদিকে আসে না।
গ্রামে বাড়িটা জ্বিনের বাড়ি বলেই পরিচিত।
হঠাৎ এক আগন্তুক বৃদ্ধের মুখে তায়েবের মা’র কথা শুনে মহিলারা আঁতকে উঠেছিল।
মহিলাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলো- তায়েবের মা’র খবর নিচ্চেন, আমনে কেডা? কইত্তে আইছেন?
: মা আমারে তোমরা চিনবা না। আমি গেরামে তোমাগো বাপ-দাদার লগে চলতাম। সেইডা এক-দুইশোবছর আগের কতা। সে যাউজ্ঞা, এহন আমারে কওদেহি তায়েবের মা’র বাড়ি কোনহানে?
মহিলারা বৃদ্ধের কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লো। বলে কি, এক-দুইশোবছর আগে থাকতো। এই লোক পাগল নাকি।
এদিকে করিমের মা বুদ্ধিকরে গ্রামের মুরুব্বী শরাফত আলী চাচাকে এক ছোট্টছেলে মারফত খবর পাঠিয়েছে। শতবর্ষী শরাফত চাচার পেটা শরীর। এখনো লাঠি ছাড়া দিব্বি চলতে পারেন। তবে একটু দেখে শুনে চলতে হয় এই আর কি। চাচা বটতলাতেই বসে গল্প করছিলেন। করিমের মা’র খবর পেয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে তিনি আরো কয়েকজনকে সাথে নিয়ে সেই বৃদ্ধের কাছে উপস্থিত হলেন। শরাফত চাচাকে দেখে বৃদ্ধ এক রহস্যময় বিকট হাসি হাসতে লাগলো। ততক্ষণে বটতলায় বৃদ্ধকে ঘিরে এক জটলা লেগে গেছে। শরাফত চাচা একজনের কাছ থেকে ঘটনার আদ্যোপান্ত শুনে চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন- বাবা আমনে যহন এই গেরামেরই লোক তাইলে এদ্দিন কনে আছিলেন?
বৃদ্ধ এবার হাসি থামিয়ে বললো- শরাফত আমি তোমারে হইতে দেখছি। এই বটগাছটা সেদিন আছিল না। আমি আর আমার বাপে মিইল্যা এই গাছটা লাগাইছিলাম।
বৃদ্ধের কথা শুনে শরাফত চাচা বেশ অবাক হলেন। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। লোকটা আবার আমার নামও জানে। এ আবার সেই ডাইনিটার কেউ নয়তো? হয়তো তার পাঠানো কেউ নইলে সেই ডাইনিটারই আরেক রূপ।
এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে শরাফত চাচার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। তিনি জটলার মধ্যেই গ্রামের আক্কাস, আবুল, রুস্তমসহ আরো কয়েক জোয়ানকে ডেকে বললেন- এই বুইড়ারে এক্ষনি তোমরা গেরাম ছাড়া কইরা দিয়া আও। এরে হয়তো সেই ডাইনিডা পাঠাইছে। এই লোক গেরামের ক্ষতির লাইগা আইছে।
সাথে সাথে জোয়ানরা বৃদ্ধকে তাড়িয়ে নৌকাযোগে অন্যত্র পাঠানোর জন্য নদীর ঘাঁ পর্যন্ত নিয়ে এলো। বৃদ্ধও কোনো কথা না বলে জোয়ানদের আগে আগে হেঁটে নদীর ঘাটে এলো।
শরাফত চাচারা জোয়ানদের সাথে সাথে এলেন। গ্রামের অন্যরাও এলো। ঘাটে সুজন মাঝি ও আরো কয়জন নৌকা নিয়ে প্রস্তুত ছিল।
৫.
কিন্তু এবার সেই বৃদ্ধ লোকটি গ্রাম ছেড়ে কিছুতেই অন্যকোথায় যাবে না বলে বেঁকে বসলো। জোয়ানরা তাকে নৌকায় তুলে দিতে তোড়জোড় শুরু করল। কিন্তু কিছুতেই যখন কিছু হলো না তখন শরাফত চাচার নির্দেশ দিলেন- লাঠি হাতে লও আর বুইড়ার পিঠে মারো।
জোয়ানেরা এবার লাঠি নিয়ে মারতে উদ্যত হলো। বৃদ্ধ অবস্থা বেগতিক দেখে একদিকে কাত হয়ে ঝপাস করে নদীর পানিতে ঝাঁপ দিলো। কোমর পানিতে ডুব দেয়ার আগে শুধু একটি কথাই বলেছিল- আমারে তুই গ্রাম ছাড়া করলি শরাফত, তুই শ্যাষ।
এ কথা বলেই সে পানির নিচে ডুব দিল এবং চিরদিনের জন্য যেন কোথায় হারিয়ে গেলো। গ্রামবাসীর চোখের সামনে ভোজবাজির মতো ঘটনাটা ঘটে গেল। দক্ষডুবুরি লাগিয়ে নদীর উজান-ভাটিতে অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাকে আর কোথাও পাওয়া গেলো না।
৬.
বৃদ্ধের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। লোকেরা যার যার বাড়ি ফিরে গেলো। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে শরাফত চাচার বাড়িতে পরামর্শসভা বসলো। গ্রামের গণ্যমান্য লোকেরা বসে সেই ডাইনির বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। পরেরদিন সকালে একদল যুবক বাড়িটি সমূলে গুঁড়িয়ে ধুলোয় মিশিয়ে দিল।
কিন্তু হুট করে সেদিন বিকেলেই শরাফত চাচার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল। সন্ধ্যার যে সময়টায় বৃদ্ধ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল ঠিক সেই সময়েই শরাফত চাচার ইহলীলা সাঙ্গ হলো। গ্রামে হাহাকার পড়ে গেল। আর সেই বট গাছটির পাতা ঝড়ে পড়ে দুইদিনের মধ্যেই মারা গেলো। গ্রামের আকাশ অশান্তির কালো মেঘে ছেয়ে গেল।
গ্রামে মহামারি-দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। মানুষ অকাতরে প্রাণ হারাতে লাগল।