শীতের গ্রাম – রিজওয়ান মুহাম্মাদ আবুজর

শীতের গ্রাম – রিজওয়ান মুহাম্মাদ আবুজর

গ্রামে শীতের আগমন অনেকটা ভিন ্নভাবেই হয়। হয়তো তাকে ভিন্নভাবে বলবে না; বরং শীতাগমনের প্রকৃত রূপটা গ্রামেই উন্মোচিত হয়। হেমন্ত যখন সশরীরে প্রকৃতিতে বিরাজমান, সবুজ ধানের শীষগুলো সোনা রঙের শাড়ি জড়ায় গায়ে-মুখে, প্রফুল্ল চিত্তে প্রাণখোলা হাসি হেসে কৃষক যখন ফসল দেখে প্রাণভরে, ঠিক তখনই উত্তরা হিমায়িত হাওয়ার সাথী হয়ে, ধানের শাখে শাখে আলোড়ন তুলে আগমন করে শীত।
পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে সুরভিত থাকে আকাশ-পাতাল, শীত ভেজা মৃদু হাওয়া উদাস চিত্তে শিহরণ জাগায় ক্ষণে ক্ষণে। বাতাসে জন্ম নেওয়া আদ্রর্তা শরীরে ছড়িয়ে দেয় ঝিমঝিমে ভাব।
শীত শহরে নামে চুপিসারে। ছদ্মবেশী রূপে। শহুরে মানুষদের কাছে শীত মানে উষ্ণ এসির কৃত্রিম সুখ, ট্যাপের মুখ বেয়ে ঝরা কুসুম কুসুম গরম পানি, অত্যাধুনিক সব কাপড়চোপড় আর শীত ঠেকানোর অপার বিলাসিতা।
শীত যে কেমন? তার প্রভাবে কর্ণকুহরে, চোখে-মুখে, সর্বাঙ্গে ঠিক কেমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়? তা শহুরে জীবনে অনেকটাই অপরিচিত। তারা শীত দেখে না, দেখে শীতের পণ্য। তারা শীত ছোঁয় না, ছোঁয় শীত লুকানোর অত্যাধুনিক সব উপায়-উপকরণ।
শহরে শীত নামে না, নামে শহরের রাস্তায়, অলিতে-গলিতে, ঘিঞ্জি বস্তির দশ দিকে। শীত শহরকে পরশ বুলায় না পরশ বুলায় শেষ বিকালেও ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অনাথিনীর উসকোখুসকো চুলে, শুষ্কতায় জটজটে হওয়া তার মায়াভর্তি চেহারায়, তার কোমলমতি শরীর ও পাদুকাবিহীন পায়ের নিচে।
শহরে শীত মানে কি এই?
একদিকে ইট-এসির প্রকোষ্ঠে ঐশ্বর্য্যশালী কিছু জীবন অপর দিকে রাস্তায়,বস্তিতে থরথর করে কাঁপা কতিপয় করুণ প্রাণ!
না, শীত মানেই এটা নয়।
শীত আগমনের প্রকৃত রূপ আমি দেখেছি। আমার গ্রামে। অন্যান্য গ্রামেও। শীতের সে অনিন্দ্য সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে বারংবার থমকে দাঁড়িয়েছি শিশির ঝরা প্রভাতে। যে শিশিরের বাহারী রূপ প্রণয়ের চিঠিতে, বাউলের আবেগাপ্লুত কণ্ঠে, কবিতার ছন্দ-সুরে, রূপকথার কল্প-গল্পে উঠে আসে হাজারবার। আমিও যখন শিশির সিক্ত ভোরে কুয়াশার হিল্লোল ভেদ করে বিচরণ করি ঘাসের বুক দাপিয়ে শিশির রাজ্যে আলোড়ন জাগে। হুড়মুড়িয়ে ভিড় জমায় আমার পদদ্বয়ে। সুখানুভূতি ছড়িয়ে পড়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে, শিরা-উপশিরায়।
গ্রামে শীত মানে কাকচক্ষু শিশির মাড়িয়ে লাল ছেপারা আর রেহাল বুকে জাপটে মক্তবে দৌড়ানো। কুয়াশা তরঙ্গে ভেসে আসা রস বিক্রেতার হাঁক-ডাক। মিষ্টি রোদে চকমক করে ওঠা নরম দূর্বাঘাস। শীতের সকাল মানেই মরিচা ধরা টিন চুইয়ে টুপ করে নেমে আসা পানির ফোঁটা। মায়ের হাতের গরম ভাপা আর ঠাণ্ডা রসের অমায়িক স্বাদ আস্বাদনে মুখিয়ে থাকা।
শীতের গ্রাম মানেই পাতা ঝরা বন-বাদার। ধান কাটা জমি জুড়ে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা মুখরিত সন্ধ্যা। প্রভাতের মৃদু হাওয়ায় দোল খেয়ে প্রস্ফুটিত হওয়া ফুলকলি। দিগন্ত জোড়া মাঠে হলুদের ঈর্ষণীয় রাজত্ব। শীতকালীন ফল-ফলাদি হাতে অতিথিদের আগমন। বাড়ি বাড়ি থেকে ছড়িয়ে পড়া দুধ পিঠার সুমিষ্ট ঘ্রাণ।
শীতের খাবার মানেই প্লেটে ছড়িয়ে থাকা নিত্যনতুন সবজির লোভাতুর স্বাদ। শীতের সন্ধ্যা মানেই খড়-কুটোয় আগুন লাগিয়ে উত্তাপ পোহানোর অনাবিল সুখস্পর্শ। শীতের রাত্রি মানেই লেপে পা ঢুকিয়ে কতশত গল্প।
কত সুন্দর বলেছেন কবি মুজাহিদ “শীতের গ্রাম যেন কুয়াশার অবগুণ্ঠনে লুকিয়ে থাকা অভিরূপ নববধূ।”
শৈশবের শীতানন্দ ছিল আরো মধুময়। অগণন সুখস্মৃতি লেপ্টে আছে সেকালের শীতে। শীতের সে আগমন রূপ আজও বিদ্যমান কেবল নেই আমি। শীতের অবগুণ্ঠন আজও গ্রামকে নববধূর সাজে সজ্জিত করে শুধু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার অবকাশ মেলে না আমার। তবুও শীতের পুনশ্চ আগমনগীতি, আড়ম্বর, অপরূপ অলংকার আমাদেরকে বারংবার উপহার দেয় অবিস্মরণীয় স্মৃতি জড়ানো একেকটি শীতল গ্রাম।

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য