মধ্যরাত এখন। ভোরে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে আমদের শিক্ষাসফর। তাই বিনতে আদীব হুযূরের ‘সুন্দরবনে সুন্দর কিছু মুহূর্ত’ লেখাটি পড়ার জন্য প্ষ্পুসমগ্র নিয়ে বসলাম। পুরো সফরনামাই তো জ্ঞানসমৃদ্ধ, তবে এর মাঝেও বিশেষ কিছু বিষয় পাথেয় হিসাবে ভালোভাবে মনে গেঁথে নিলাম।
*****
রাতের বাকী অংশটুকু বিভিন্ন ব্যস্ততায় কেটে গেলো। একটু পর গাড়ি ছেড়ে দিবে। সবাই প্রায় প্রস্তুত। আমি এককোণে দাঁড়িয়ে দু’রাকাত সালাত আদায় করে নিলাম। ভোর চারটায় সবাইকে নিয়ে গাড়ি ছুটে চললো যমুনা সেতুর উদ্দেশ্যে। যাতে ফজরের সালাত সেখানে গিয়ে আদায় করা যায়। গাড়ি যখন উত্তরার সেক্টররোড থেকে বেরিয়ে অভ্যন্তরীণ সড়কে উঠলো, তখন নীরব শহরটাকে দেখে ভেতরে পবিত্রতার আবেশ অনুভব করলাম। মনে হলো ঘুমন্ত শহরের উপর অঝোরে রহম ঝরছে। যেহেতু তাহাজ্জুদের সময় ছিলো তাই মনে হলো রাতের এ শেষ প্রহরে হয়তো বা কোন নেক বান্দার দু’হাত আসমান পানে উঠেছিলো একফোঁটা রহমতের আশায়।
গাড়ি অনেকটা নির্বিঘ্নেই চলছিলো। তবু গাজীপুর এসে ফজর আদায় করে নিতে হলো কারণ, একটু পরই সূর্য ওঠে যাবে। সালাত শেষে আবারো রওনা হলাম যমুনাসেতুর উদ্দেশ্যে। আমাদের সফর সুন্দরবনে হলেও পথিমধ্যে আরো কিছু জায়গা পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যমুনাসেতুও তার মধ্যে একটি।
কিছুক্ষণ পর সূর্য উঁকি দিলো। আমরা তখন টাঙ্গাইলে। এখানের প্রাকৃতিক দৃশ্য মোটামুটি দেখার মত। সড়কের দু’পাশে বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। অনেকেই ঝিমুচ্ছিলো। আমি বাইরের প্রকৃতি দেখছিলাম জানালা দিয়ে। এক সময় গাড়ি যমুনাসেতু স্পর্শ করলো। সেতুর কথা শুনে সবাই জেগে উঠলো। যমুনার বর্তমান অবস্থা দেখে পূর্বধারণা না থাকায় ভেবেছিলাম উপর থেকে পানির প্রবলতা দেখে হৃদয়ে ভয়জনিত শিহরণ জেগে ওঠবে। কারণ, আমাদের পুরনো একশত টাকার গায়ে এমন ছবিই দেয়া। কিন্তু কোথায় পানি! এত বিশাল নদীর বুকে যে বড় বড় চর জেগে ওঠেছে
তা দেখে হৃদয়ে বড় ব্যথা অনুভব করলাম। দায়িত্বশীলদের অবহেলার কারণে কিভাবে নদীমাতৃক দেশটি তার ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলছে! যমুনাসেতুর ওপারে সিরাজগঞ্জ। সিরাজগঞ্জের বড় বৈশিষ্ট্য হলো এখানে ঘন জনবসতি নেই। এটা আগেই জানা ছিলো। দেখতে দেখতে গাড়ি সেতু অতিক্রম করে সিরাজগঞ্জের মাটি স্পর্শ করলো। যতদূর দেখা যায় চেষ্টা করলাম মানুষের ঘর-বাড়ি দেখার জন্য। কিন্তু ধারে-কাছে তেমন কোন ঘরই চোখে পড়লো না, বরং আদিগন্ত সবুজেরই সমারোহ। ‘দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ’ কথাটি এতদিন শুধু বইয়ের পাতায় পড়েছি। আজ প্রকৃতির পাতায় পড়ার সৌভাগ্য হলো। আরো কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতির এক ভিন্নরূপ চোখে পড়লো। সড়ক থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে দু’পাশেই বিভিন্ন নয়নাভিরাম বাগান তৈরি করা হয়েছে। কোথাও খেজুরবাগান, কোথাও নারকেলবাগান, আবার কোথাও বাগান করা হয়েছে কলা ও তালগাছের। বাগানগুলো সারিবদ্ধ বৃক্ষঘেরা চারকোণ বিশিষ্ট। মাঝে আবার গাছ-পালাশূন্য ফাঁকা জায়গাও রয়েছে কোনটায়। এছাড়াও বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঝে মাঝে একটি দুটি করে তালগাছ ও খেজুরগাছ দাঁড়িয়ে আছে। এ দৃশ্যের সৌন্দর্য আমাকে অন্যরকম কাছে টানছিলো। যেন ছবির মতোই গ্রামটি। আসলে এ শুধু সরল বর্ণনা, কাগজের বুকে সে সৌন্দর্যের ছবি আঁকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পথিমধ্যে সকালের নাস্তার জন্য যাত্রাবিরতি দেয়া হলো।
আমরা নাস্তা নিয়ে একটি ছায়াঢাকা সবুজ মাঠে চলে এলাম। ঘাসের ডগায় শিশির দেখে লোভ হলো। তাই খালি পায়ে একটু পরশ নিলাম। নাস্তার পর গাাড় আবার এগিয়ে চললো। সড়কটির কাজ সম্ভবত বেশিদিন আগের না। এখনো বেশ মসৃণ রয়েছে। দু’পাশে সারি সারি গাছ। বসন্তের সাজে দারুণ লাগছিলো। ছায়াঢাকা এমন মসৃণপথে গাড়ি চালাতেও মজা, গাড়িতে চড়তেও মজা। সিরাজগঞ্জের পর নাটোর জেলা শুরু হলো। এখানেও একই রকম দৃশ্য বিরাজ করছে। তবে সিরাজগঞ্জে ভুট্টা দেখেছিলাম কি না মনে নেই, এখানে দেখতে পেলাম ভুট্টাগাছের সুদৃশ্য সমারোহ। যারা ঘুমিয়েছে বা দেখেনি এসব সৌন্দর্যের বিবরণ তাদের কাছে অতিরঞ্জন মনে হতে পারে। কিন্তু না দেখায় দায় তো আমার না। নাটোর শেষে পাবনা শুরু হলো। পাবনার শুরুর দিকে একই রকম দৃশ্য দেখা গেলেও শেষে এসে দেখতে পেলাম বেশ কিছু লিচুবাগান। যা সবাইকে মুগ্ধ করেছে। এরপর চলতে চলতে গাড়ি কুষ্টিয়ায় প্রবেশ করলো। শুধু গাড়িতে বসেই কতগুলো জেলা পার হয়ে গেলো! পথের দু’পাশের দৃশ্য দেখা ছাড়া তেমন কিছুই সম্ভব হলো না। যদি অল্প সময়ের জন্যও প্রতি জেলায় একবার করে যাত্রাবিরতির সুযোগ হতো এবং সেখানের মাটি ও মানুষকে কাছ থেকে দেখা ও অনুভব করা সম্ভব হতো, তবে কত ভালো হতো! কিন্তু সময় এত অল্প ছিলো যে, শেষপর্যন্ত পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত অনেক জায়গায়ও বাদ দিতে হয়েছে।
কুষ্টিয়ায় প্রবেশের সময় আমরা লালনশাহ সেতু দিয়ে পদ্মানদী পার হচ্ছিলাম আর আমাদের ডানপাশে ছিলো ঐতিহাসিক হার্ডিক ব্রীজ। টাঙ্গাইলে যমুনার যে অবস্থা দেখে এসেছি এখানে পদ্মার অবস্থা তার চেয়েও ভয়াবহ। বুকে এত বড় বড় চর ধারণ করেও এগুলো এখনো নদী নামে বেঁচে আছে! আমরা প্রথমে ফকীর লালন শাহের মাজারে গেলাম। এখানে এসে কোন লাভ হয়েছে না সময়ের অযথা অপচয় ঘটেছে তা আজো আমার মনে প্রশ্ন হয়ে আছে! মাজারের ডানপাশের বড় ভবনটি দেখলাম খালেদা জিয়ার আমলে সরকার করে দিয়েছে। এমনই হয়! আশ্চর্য হলাম যে, এখানেও মানুষ দূর থেকে ছুটে আসে! এখানে কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলাম রবি ঠাকুরের ‘কুটি বাড়ী’। বাড়ির ভেতর রবি ঠাকুরের ব্যবহৃত অনেক কিছুই সংরক্ষণ করা আছে। তবে সবই যে প্রাচীন তা নিশ্চিত বলা কঠিন। এখান থেকে বের হয়ে আমারা কুষ্টিয়ার শহরে চলে গেলাম। শহরে আমরা দুপুরের আহার শেষ করে বিকেলে গিয়ে পৌঁছলাম কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভেতরে প্রবেশ করে আমরা প্রথমে কেন্দ্রীয় মসজিদে সালাতুল আসর আদায় করলাম। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে মোটামুটি আশ-পাশের সবগুলো জায়গা দেখলাম। এখানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মন অপূর্ব প্রফুল্লতায় ভরে গেলো। সেই সিরাজগঞ্জ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট পর্যন্ত সবুজের যত রূপ-বাহার দেখেছি, ভেতরে প্রবেশ করে মনে হয়েছে এখানের তুলনায় সেগুলো তিনভাগের একভাগ হবে। এটা সহজেই আমি অনুধাবন করতে পেরেছি। কারণ, আলহামদুলিল্লাহ আমি শুরু থেকেই তন্ময় ছিলাম স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টির সৌন্দর্যের মাঝে। কেননা, আমি অনুভব করি, প্রকৃতির যত নিকটসান্নিধ্য অর্জন করা যায় সৃষ্টির তত নিগূঢ়রহস্য বান্দার সামনে উন্মোচিত হয়।
যদিও এটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, তবে তা নামমাত্র। আমাদের নষ্ট রাজনীতির চিত্র কতটা ভয়াবহ তা এখানে এসে আমার সামনে আরেকবার জীবন্ত হয়ে ওঠলো। যে মসজিদে আমরা সালাতুল আসর আদায় করেছি তার বামপাশে অবস্থিত ‘শহীদ জিয়া হল’। দেখে অবাক হলাম! পুরো হলের প্রতিটি কক্ষের দরজায় সেঁটে আছে একটা করে সাদা কাগজ, যার মাঝে বড় করে লেখা ‘ছাত্রলীগ’।
এত বড় বিশ্ববিদ্যালয় ভালোভাবে পরিদর্শনের জন্য যে সময়-সুযোগের প্রয়োজন ছিলো তার কিছুই আমাদের ছিলো না। তাই শুধু এক বিকেল বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেই সন্তুষ্ট থাকলে হলো এবং কাছে এসেও দেখতে না পারার অনুভূতি নিয়েই ফিরে যেতে হলো।
মাগরিবের কিছু পূর্বে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করলাম এবং কিছুদূর গিয়ে জীর্ণ এক মসজিদে সালাত আদায় করলাম। এরপর গাড়ি আমাদেরকে নিয়ে সোজা সাতক্ষীরা অভিমুখে রওনা হলো। মাঝে আরো দুটি জেলা পার হতে হবে। ঝিনাইদাহ ও যশোর। সুতরাং গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো। গাড়ির হেডলাইটের আলোতে সামনের রাস্তাকে আমার কাছে সুরঙ্গপথের মত লাগছিলো। উপরটা ঘন গাছ-গাছালীতে ছাওয়া। রাস্তাও অতো প্রশস্ত নয়। তবে ভালোই লাগছিলো দেখতে। রাত দেড়টা বা দুইটায় আমরা সাতক্ষীরা পৌঁছলাম। প্রথমে আমরা সালাতুল ইশা আদায় করলাম। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে খোলপেটুয়া নদীর ওপারে। সুতরাং নদী পার হও এখন। এই গভীর রাতে নদী পার হওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়! প্রথমে ভয় পেলাম। কিন্তু উপায় কী! সবার সঙ্গে বোটে চড়ে বসলাম এবং ভয় বুকেই নদী পার হলাম। এতরাতে বোট পাওয়া যেতো না যদি সঙ্গে শ্রদ্ধেয় হাবিবুল্লাহ মামুন স্যার না থাকতেন। মূলত তার বাড়ি এখানে হওয়াতেই এই ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয়েছে। স্যারের মাধ্যমে আগেই জানতে পেরেছিলাম এ এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। আমাদের নিষ্প্রাণ রাজনীতির চরিত্র এমনই। স্বজনপ্রীতির ছোঁয়ায় কোথায় আজকের গোপালগঞ্জ আর কোথায় সাতক্ষীরার এ অঞ্চল!! দরিদ্র হলেও এ অঞ্চলের মানুষ বড় উদার। এই গভীররাতে আমরা যে আন্তরিক আপ্যায়ন পেয়েছি তা শুধু অকৃতজ্ঞই ভুলতে পারে। পরদিন সকালে আমি ও আরেকজন বাদে সবাই খেলতে গেলো। আমি রয়ে গেলাম লেখার মায়ায়! বসে বসে লিখলাম একা একা। যোহরের পর সবাই বোটে চড়ে রওনা হলাম সুন্দরবন দেখতে। অনেকের মাঝেই বাঘ দেখার কৌতূহল কাজ করছিলো। কেউ কেউ বলাবলিও করছিলো। স্থানীয় এক মুরব্বী বারণ করলেন। কেউ কেউ তাতে চুপসে গেলো। আমরা কপোতাক্ষ নদ হয়ে সুন্দরবনের একটি অংশে গিয়ে ওঠলাম। প্রথমেই দেখা পেলাম বানরের। শুরুটা ভালোই ছিলো ওদের সঙ্গে। কিন্তু একটু পরই বাঁদরামি করে আমাদের কে বেশ নাজেহাল করে ছেড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা ভেতরে যেতেই দেখা পেলাম হরিণের। কিন্তু বানরের জ্বালায় দেখে শান্তি পেলাম না। একটু একটু করে বনের গভীরে যাচ্ছিলাম আর ভয় বাড়ছিলো। কেউ কেউ বলছিলো সুন্দরবনে এলাম বাঘ দেখবো না তা কিভাবে মানা যায়! শোন কথা! যাক্, শেষ পর্যন্ত বাঘগুলো পর্দা রক্ষা করেছে। আমরা ওয়াচটাওয়ারে ওঠে চারোপাশে দৃষ্টি বুলালাম। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। বনের ভেতর কত রকম গাছ! এখন একটার নামও মনে পড়ছে না। চেনার সুবিধার্থে গাছে গাছে নাম ঝুলানো আছে। ঐসময় ভেবেছিলাম মনে থাকবে। কিন্তু..এ জন্যই সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখার ব্যবস্থা করা উচিত ছিলো। সূর্য হেলে পড়ার আগে আগেই আমরা বন থেকে বেরিয়ে এলাম। মূলত আমাদের পরিকল্পনা ছিলো আকাশনীলা যাওয়া। কিন্তু সঙ্গত কারণেই না কি আজকের জন্য আকাশনীলায় যেতে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা আছে। আমরা কিছুক্ষণ নদীভ্রমণ করে এক মসজিদে গিয়ে সালাতুল আসর আদায় করলাম।
তৃতীয় দিন খুব ভোরেই আমরা ফিরে আসার প্রস্তুতি নিয়ে বের হলাম। যে মানুষগুলো এ দু’রাত উষ্ণ আন্তরিকতায় আমাদের আগলে রেখেছিলেন তাদের সঙ্গে শেষ দেখা হলো না। মনে হলে এখনো ভেতরটা কেমন করে ওঠে। খুবই সরল মনের মানুষ এরা। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন কষ্টের কাঁটাতারে যেন আবদ্ধ। দেশে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে এরা প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভোরে অনেক মহিলাকে দেখেছি নদীতে জাল দিয়ে চিংড়ি মাছের পোনা ধরতে। এর মাধ্যমেই তার জীবিকা নির্বাহ হয়! যারা আমাদেরকে আপনের মত আপ্যায়ন করেছেন, চেষ্টা করেছি তাদের আন্তরিকতার গভীরকে স্পর্শ করার জন্য। গ্রামীণজীবনের ছোঁয়ায় শহুরেদের থেকে এরা এখনো অনেক ভালো। উভয় জাহানে সুখী হও হে ভালো মানুষেরা!!
******
আমরা প্রথমে নদী পার হলাম। এরপর গাড়িতে করে বংশীপুর এসে নামলাম। এখানে নামার উদ্দেশ্য প্রাচীন এক শাহী মসজিদ। মসজিদের পাশে রয়েছে মোঘল বাদশাহ আকবরের দু’জন সৈনিকের কবর। আমরা অল্প সময়ে মসজিদ ও কবর দুটি যিয়ারত করে ফের রওনা হলাম। সাতক্ষীরার মাটিতে আর নামা হবে না। গাড়ি যখন চলতে শুরু করলো, আমি অনুভব করলাম দু’দিনের সবুজ সম্পর্কটি ছিঁড়ে যাওয়ার ব্যথা, যে সম্পর্ক নিজের অজান্তেই এখানের মাটি ও মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠেছিলো।
আমরা এখন খুলনা হয়ে বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ দর্শনে যাবো। যোহরের সময় গাড়ি খুলনায় পৌঁছলো। আমরা যোহরের সালাত আদায় করলাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে। সালাত শেষে আমি হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটু ভিতরের দিকে গেলাম। ভেতরের বাগানঘেরা পরিবেশ খুব ভালো লাগলো। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দেখে এসেছি। সেখানে মনে হয়েছে পুরো প্রকৃতিই বসন্তের সফল প্রতিনিধিত্ব করছে। এখানেও অনেক ভালো লাগছিলো। এখানে পুকুরে লাল শাপলাফুল দেখলাম, যা ইতিপূর্বে শুধু সুন্দরবনেই দেখেছিলাম। আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে কিছুটা সময় আর কিছু পরিশ্রম ব্যয় করতে হলো। যেটা অপ্রত্যাশিত ছিলো। এ সময়ে যতুটুকু সম্ভব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। খাবারের পর্ব শেষ হলে রওনা হলাম ষাটগম্বুজ মসজিদ অভিমুখে। পৌঁছতে পৌঁছতে আসর হয়ে গেলো। আমরা আরো কিছু দূর অগ্রসর হয়ে ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা খান জাহান আলী রহ.-এর মাজার দেখে এলাম। এরপর ফিরে এসে টিকিট সংগ্রহ করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে এসে যে যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম এবং মনোযোগ সহকারে গম্বুজগুলো গুণে ফেললাম। ছোটকালে এ গম্বুজ গণনা নিয়ে কত কিস্সা-কাহিনী শুনেছি! কিন্তু ছোটকালের সেই ভুল ভাঙলো কাছে এসে। মূলত গম্বুজ একাশিটি। গণার পর কয়েকজনের সাথে কথা বলে স্পষ্ট হলাম। ষাটগম্বুজ নামের পেছনে বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যাই হোক্, গম্বুজ একাশিটিই। একটুপর জামাতের সঙ্গে মসজিদের পাটাতনে আসর আদায় করলাম। আগেকার দিনের মসজিদ হলেও এর নির্মাণশৈলী এতই চমৎকার যে ভেতরে পাখা ছাড়াই সব সময় ঠাণ্ডা অনুভব হয়। সালাত শেষে বাইরে এসে লক্ষ করলাম সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত। শুধু ব্যস্ত বললে কম হবে, মহাব্যস্ত। সবার প্রধান ব্যস্ততা এই একটাই। যেন ছবি তোলার সংস্কৃতি এদেশের মানুষের মন-মগজে মিশে গেছে। তাই প্রাচীন ঐতিহ্য ও নিদর্শনগুলোকে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করার মানসিকতা এখন সেকেলে হয়ে পড়েছে। আমি সবার ব্যস্ততার ফাঁকে ঘুরে ঘুরে মসজিদের নির্মাণশৈলী দেখছিলাম। একটুপর সবার বেরিয়ে এলাম। আমাদের গন্তব্য এখন গোপালগঞ্জ। দীর্ঘ সময় গাড়ি শুধু এগিয়েই চললো। পথ যেন ফুরোয় না। রাস্তার কাছা-কাছি কোন মসজিদ না থাকায় মাগরিব আদায়ে বেশ বিলম্ব হয়ে গেলো। অবশেষে অনেক ছোট একটি মসজিদ পাওয়া গেলো। আমরা মাগরিব আদায় করে ফের ছুটে চললাম। এশার সালাত আদায় করলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির মসজিদে। এরপর গিয়ে উপস্থিত হলাম গওহরডাঙা মাদরাসায়। প্রথমে ছদর সাহেব হুযূর আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর কবর যিয়ারত করলাম। মাদরাসা হযরতের প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানের মাদরাসাওয়ালার একটা ‘লজ্জাজনক’ কারণে এখানে বেশিক্ষণ থাকার ইচ্ছে আমার ছিলো না। বাস্তবেও তাই হলো। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বেরিয়ে এলাম এবং ফরিদপুর হয়ে ফেরীঘাটে এসে পৌঁছলাম। আসার পথে মজার একটি ঘটনা ঘটেছে। নদীর ওপারে পদ্মাসেতুর যেটুকু অংশের কাজ দৃশ্যমান হয়েছে সেখানে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু আমাদের চালক না এ নিয়ম জানে, আর না পদ্মাসেতু চিনে। ফলে গাড়ি নিয়ে পদ্মাসেতুতে উঠে পড়লো। অল্পকিছু দূর যাওয়ার পর বিষয়টা বোধগম্য হলো। ইতিমধ্যেই দূর থেকে প্রহরীর সঙ্কেত চলে এসেছে। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে চালক আবর আগের জায়গায় এলেন। মূলত তিনি পথ না চিনে এমনটা করেছেন। আর এই ফাঁকে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার আগেই আমাদের পদ্মাসেতু ভ্রমণ হয়ে গেলো।
এরপর খুঁজে খুঁজে পথ বের করে ঘাটে পৌঁছলাম। নদী পার হওয়ার জন্য গাড়িকে ফেরিতে ওঠানো হলো। ফেরি সম্পর্কে এর আগে আমার জানা ছিলো না তেমন। এই প্রথম ফেরিভ্রমণ। গাড়ি ফেরিতে ওঠার পর ধীরে ধীরে সবাই বেরিয়ে গেলো। ভাবলাম হয়তো একটু ঘুরে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু কেউ আসছে না দেখে আমিও বের হলাম। পরে জানলাম সবাই ছাদে। কৌতূহল মেটাতে ছাদে ওঠলাম। রাত গভীর ও নিবিড় হওয়ায় অনেক ভালো লাগছিলো। একটি দৃশ্য দেখে ভালো লাগা বেড়ে গেলো। ছাদের একাংশে সালাতের ব্যবস্থা রয়েছে। কিছু মানুষ সেখানে সালাত আদায় করছে। আমরা সফরে বের হয়েছিলাম ভোর চারটায়। নদী পার হয়ে মুন্সীগঞ্জ হয়ে ঢাকায় মাদরাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে সেই ভোর চারটাই বাজলো। তিনদিনের দীর্ঘ সফর শেষে আবার আমরা ইলমের উদ্যানে ফিরে এলাম।
তিনদিনের সফর ব্যাপক পরিধি নিয়ে ছিলো। তবে সময়ের কারণে আমরা দ্রুত শুধু ছুটেই চলেছি। সংগ্রহে রাখার মতো কিছু অর্জন করতে পারিনি। তবু এটি আমার জীবনের প্রথম সফরের সংক্ষিপ্ত ব্যঞ্জনা!