ফুলখুকি অপরাজিতা

ফুলখুকি অপরাজিতা

রেদোয়ান সামী

সকালবেলা। তুলতুলে নরম আলো ঝরে ঝরে পড়ছে ভোরের সূর্য থেকে। ঘুম ভেঙে গেছে পাখিদের। পাখিরা সবাই সুর করে গাইছে ভোরের গান। আর তখনই প্রথম চোখ মেলে তাকাল একটি নীল অপরাজিতার কলি। এতটুকুন একটি ফুলখুকি। বাগানের আশপাশটা যখন আরেকটু আলোকিত হল তখন তাকে প্রথম দেখল পাশের গাছের একটি কাঠগোলাপ।
কাঠগোলাপ জানতে চাইল,
: ফুলখুকি! কে তুমি? কী নাম তোমার?
ফুলখুকিটা কী বলল? কিছুই বলল না। ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকল কাঠগোলাপের দিকে। ফুলখুকি মনে মনে ভাবল, নাম! এটা আবার কী জিনিস? নাম দিয়ে কী করে?
ফুলখুকির পাশে ছিল আরো বেশ কয়েকটি নীল অপরাজিতা। তাদের একজন বলল,
: ও আমার বোন। ওর নাম কলি। আমরা তো পুরোপুরি ফুটে গেছি, তাই আমরা ফুল। আর ও তো এখনো ভালোমতো ফোটেনি। একটু আগেই ও চোখ মেলে তাকাল। তাই ও হল কলি। ফুলের কলি। নীল অপরাজিতা ফুলের কলি।
কাঠগোলাপ বলল,
: বাহ, কী মিশটি দেখতে তোমার বোন। কেমন গাঢ় নীল রঙ লেপটে আছে ওর গালে, মুখে। এখনও সবটা ফোটেনি। তবু কী দারুণ দেখতে পুরোটা ফুটলে তখন ঠিক তোমাদের মতো দেখাবে। তোমাদের মতো এমন মিশটি একটি হাসি সবসময় লেগেই থাকবে ঠোঁটে। তখন সে আর কলি থাকবে না। হয়ে যাবে একটি নীল অপরাজিতা।
অপরাজিতা ফুলের ছোটো কলিটি এখনও ভালো করে দেখেনি নিজেকে। কাঠগোলাপের কথায় এবার সে নিজের দিকে তাকাল। তাকিয়েই সে অবাক না হয়ে পারল না। সত্যিই, কী মিশটি দেখতে সে। কেমন তুলতুলে তার গা। পিটপিট করে তাকায়। ছোটোরা বুঝি এমনই হয় এবার সে অন্যান্য ফুলদের দিকে কেমন কেমন চোখে তাকাতে লাগল। আর বলল,
: উঁহু, আমি মোটেই তোমাদের মতো হব না। তোমরা দেখতে খুউব পচা। তোমাদের পাপড়িগুলো দেখতে একদমই ভালো লাগে না।
কলি ফুলের এমন কথা শুনে একটি নীল অপরাজিতা বলল,
: আহা বোন আমার! এভাবে বলতে হয় না। এভাবে বললে অন্য ফুলদের মন খারাপ হয়ে যায়। কারো মন খারাপ হয় এমন কথা বলতে নেই।
কলি অপরাজিতা বলল,
: আমি তো মিথ্যা বলিনি। সত্যই তো বললাম। তুমিই দেখো না, ওই কাঠগোলাপটা দেখতে কেমন বাজে। আর আমি দেখতে কত সুন্দর!
এবার সত্যি সত্যি কাঠগোলাপের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবে সে কিছু মনে করল না। কারণ, কলি অপরাজিতা তো ছোটো। ছোটোরা তো না বুঝে কত কথাই বলে, ওদের কথায় কি আর মন খারাপ করলে চলে? কাঠগোলাপ তাই মন খারাপের ভাবটা লুকিয়ে ফেলল। মুখটা হাসি হাসি করে বলল,
: শোনো, ফুলখুকি! আমাদের যেমন করে বানানো হয়েছে আমরা সেভাবেই সুন্দর। আল্লাহর তৈরি কোনোকিছুই অসুন্দর নয়। বুঝলে, কাউকে অবহেলা করতে নেই।
একথায় ফুলখুকির খুব রাগ হল। কেন রাগ হল? কেউ বুঝতে পারল না কেন রাগ হল! কাঠগোলাপ তো ভালো কথাই বলেছিল! রোজ সকালে বাবার সাথে সাআদ বাগানে আসে। হাঁটতে। সকালে বাগানে কতরকম ফুল ফোটে। সাদা, লাল, গোলাপি, হলদে, বেগুনী, নীল। আরো কত রংবেরঙের ফুল।
সাআদ বাবার সাথে আজও এসেছে বাগানে। হাঁটতে। সকালবেলা। সাআদদের আসতে দেখে একটা ফুল ঠোঁটে আঙুল চেঁপে বলল,
: হিসস! কেউ কথা বলো না। দেখো কে এসেছে।
সবাই তাকাল সাআদদের দিকে। হেঁটে হেঁটে সাআদরা এই ফুলদের কাছে চলে এলো। কাঠগোলাপ, অপরাজিতা আর ফুলখুকির কাছে। ফুলখুকিটাকে দেখে সাআদের খুব পছন্দ হল। বাবাকে সাআদ বলল,
: বাবা! এই ছোটো ফুলটা আমি ছিঁড়ে নিই?
বাবা বললেন,
: না, বাবা! ফুল ছিঁড়তে হয় না। ফুল ছিঁড়লে গাছ ব্যথা পায়, ফুলের মন খারাপ হয়। কারণ, গাছ হল ফুলেদের মায়ের মতো। তোমাকে যদি তোমার মায়ের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে কি তোমার খারাপ লাগবে না, বলো?
সাআদ মাথা উপর—নিচ করে বলল,
: হ্যাঁ, খারাপ লাগবে। আমি খুব কষ্ট পাব।
বাবা বললেন,
: ফুলেরও এমন খারাপ লাগবে। ফুলও কষ্ট পাবে।
সাআদ তবু বলল,
: ছিঁড়ি না, বাবা! প্লিজ!
বাবা বললেন,
: শোনো, সাআদ! যার যেখানে বসবাস, সে সেখানেই সুন্দর। সেখান থেকে তাকে সরালে সেই সুন্দরটা আর থাকে না।
সাআদ আর কিছু বলল না। বাবা হাঁটতে লাগলেন। সামনে সামনে। আর সাআদ বাবার পেছনে পেছনে। হেঁটে হেঁটে বাবা একটু দূরে চলে গেছেন। এই ফাঁকে সাআদ টুপ করে ফুলটা ছিঁড়ে ফেলল। সেই ছোটো নীল ফুলখুকিটা। তারপর লুকিয়ে ফেলল পকেটে। বাবা কিছুই দেখলেন না।
ফুলখুকি এবার বেজায় খুশি। সাআদের পকেট থেকে উঁকি দিয়ে ফুলখুকি কিছু একটা বলতে গেল। অমনি টুপ করে পড়ে গেল নিচে। এতে ফুলখুকি একটু ব্যথাও পেল। ব্যথা পেয়ে ফুলখুকি বলে উঠল,
: উফ! আরেকটু হলে কোমরটা বুঝি ভেঙেই যেত।
তবে সাআদ ফুলখুকির কথা শুনতে পেল না। যেন বাবা দেখতে না পায়, তাই সে তাড়াতাড়ি করে ফুলটি ভালো মতো পকেটে পুরে নিলো। ফুলখুকি আবার সাআদের পকেট থেকে উঁকি দিল। বাকি ফুলদের বলল,
: থাকো তোমরা। তোমাদের সাথে আমি আর থাকব না। তোমরা সবাই পচা। দেখতে খুব বাজে। আমার মতো সুন্দর না। আমি এখন থেকে সাআদের সাথে থাকব। সাআদের পড়ার টেবিলে। একা একা।
ফুলখুকি চলে গেল। ফুলদের খুব মন খারাপ হল। বয়সে বড় ফুলেরা বলল,
: ফুলখুকি ছোটো, তাই সে বুঝতে পারেনি। গাছ থেকে ছেঁড়ার পর কোনো ফুলই আর বেঁচে থাকে না। খেতে না পেয়ে শুকিয়ে মরে যায়।
হলও তাই। সাআদ ফুলটা নিয়ে রাখল তার পড়ার টেবিলে। একটা ফুলদানিতে পানি দিয়ে ফুলটা তাতে রেখে দিল। একটি ফুল কি এভাবে বাঁচে? বাঁচে না। তাই ফুলখুকিও বাঁচল না। ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল। ভালোমতো ফুটতেও পারল না। মরে গেল।
ফুলটা এভাবে শুকিয়ে যাওয়ায় সাআদের খুব খারাপ লাগল। বাবার কথা তখন মনে পড়ল তার। বাবা বলেছিলেন, যার যেখানে বসবাস সে সেখানেই সুন্দর। ফুলটা আমি না ছিঁড়লে এখনও হয়তো ফুলটা বেঁচে থাকত। আরো বড় হতো। ইস, কেন যে ফুলটা ছিঁড়লাম।
ফুলটা মুঠো করে নিয়ে সাআদ ফেলে দিল বাগানে ময়লার গর্তে। দূর থেকে এটা দেখতে পেল সেই কাঠগোলাপসহ বাকি ফুলেরা। সবার মন খারাপ হয়ে গেল। ইস, ফুলখুকিটা আর বড় হল না। ফুটলও না। ফোটার আগেই শুকিয়ে চিমশে গেল। আর এখন পড়ে আছে ময়লার গর্তে।
বয়সে বড় একটা ফুল বলল,
: ফুলখুকির জন্য এখন আফসোস করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। শোনো, আমরা সবাই সুন্দর। সবাই ভালো। সবাই আমরা মিলে মিশে থাকব। কেউ কাউকে ঘৃণা করব না। অবহেলা করব না। নইলে ফুলখুকির মতো আমাদের পরিণতিও এমন হতে পারে।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment