পরীক্ষা শেষ। মোতাহার স্যারের বা—হাতি বেতের বাড়ি থেকে বাঁচতে আমাদের দায়িত্ব ছিল শুধুকোন রকম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা। একাত্তরের দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষ হলো গত ৬ দিনে। এখন দশ দিনের বিশাল ছুটি। এই দিনগুলোতে টিচারগণ খুবই সুক্ষভাবে খাতা দেখবেন, পান থেকে চুন খসলেই দিবেন নম্বর কেটে। আর স্কুল খোলার পরদিন এক এক করে ডাকবেন, খাতা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবেনÑগরুর দল, কী লিখেছিস খাতায়! আর কাঁচা কঞ্চি বেত দিয়ে পিঠে মারতে থাকবেন দীলে দয়া না—আসা পর্যন্ত। তাতে আমার কী! আমি অলমোস্ট প্ল্যান করে রেখেছি। যেদিন স্কুল খুলবে সেদিন মিনু খালাকে সাথে নিয়ে অফিসে গিয়ে হেড স্যারের সামনে এমন ভাব নিবো যে, জ¦রে গা পুড়ে যাচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে স্যার দয়া পরবশ হয়ে ছুটি দিয়ে দিবেন। তার মানে আমার কিচ্ছা খতম। সমস্যা হলো রমিজকে নিয়ে। টিমে সবচে বড় বুদ্ধিজীবি সে, কিন্তু নিজের বেলায় অত ভাব ভঙ্গি নিতে পারে না। বাদল তো গন্ডারের চামড়া। আমাদের গবেষণা মতে বাদলের চামড়া আফ্রিকান কোন এক গন্ডারের শরীর থেকে খুলে তাকে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্যারদের বেত ভেঙে যায় কিন্তু বাদলের চোখে মুখে চুল পরিমাণ পরিবর্তন নাই। আমাদের ধারণামতে, ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে গোলা—বারুদের সামনে বাদলের চামড়া তুলে ধরলে হিটলার বাহিনীর পরাজয় আটকে যেত। সেজন্যে বাদলকে নিয়ে কোন টেনশন নেই আমাদের। আরেকজন বাকি আছে। সাবের। সাবের তো জন্মগত অভিনেতা। রসিকতায় পটু সাবেরকে এক বেত দিতেই যেই হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে, মনে হয় এই বুঝি কিছু একটা হয়ে গেল। কিন্তু এই মুহুতে রিজাল্টের ভয়াবহতা নিয়ে ভেবে ছুটির আনন্দ মাটি করতে চাই না। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে বিকেলেই মাঠে এক হলাম। প্রতিবার যা হয়, এবারও তাই। আমার সার্কেল বলে কথা! কত কিছু ভাবলাম, প্ল্যান করলাম, তারিখ ঠিক করলাম। কিন্তু যাওয়ার সময় একজনও নাই। এদিকে খায়ের মামা এসেছে মিনু খালাকে নানা বাড়ি নিয়ে যেতে। মিনু খালা আমাদের বাসায় থেকেই পড়াশোনা করে, এবার মেট্রিক পরীক্ষা দিবে। আর খায়ের মামা ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে পড়ে। কী পড়ে জানিও না, বুঝিও না। জিজ্ঞেসও করি না কোনো দিন। শুধু এতটুকু জানি, খায়ের মামা একটা ফাঁকিবাজ ছেলে। পিচ্ছি পোলাপান দিয়ে নিজের কাজ করায়া নেয়। বিনিময়ে শুধু গল্প শোনায়। তবে এই কথা স্বীকার করতেই হবে যে, তার মত গল্প আর কেউ বলতে পারে না। তার মুখে ভূতের গল্প শুনে ভরদুপুরেও অনেককে দেখেছি একা পেশাব করতে যেতে ভয় পাচ্ছে। আর নানা বাড়ির ইয়া বড় উঠানে বসে চাদের আলোতে মুড়ি খেতে খেতে কত গল্প যে শুনায় তার কোন হিসেব নেই।
ছোট মামির হাতে বানানো মুড়ির সে—কী টেস্ট! বড় মামির হাতে মুড়িঘন্টা আর নানুর হাতে মাছের ঝুল… নাহ্ এসব কোনভাবেই মিস করা যাবে না। আগেই খায়ের মামার সাথে সব গোপন আলাপ সেড়ে নিয়েছি। এখন মায়ের সামনে গিয়েই দিলাম মাঠিতে এক শোয়া। যেভাবেই হোক মামাবাড়ি যাবোই যাবো। কঠিন কিছু শর্ত আর এক ঝোলা উপদেশের সাথে অনুমতি পেলাম। একদম বাসার গেট পর্যন্ত আসতে আসতে মা বলে দিচ্ছিলেন, সাবধান বৃষ্টিতে ভিজবি না। পুকুরে গোসল করবি না। রোদে ঘুরাঘুরি বা দৌড়ঝাপ করিস না। বড়দের সালাম দিবি। কারো সাথে ঝগড়া করবি না সহ আরো অনেক কিছুই। অথচ আমি জানি, নানুবাড়ির কয়েক বাড়ি আগেই রাজুদের বাড়ি, রাজুদের বাড়ি পার হয়ে গেলে আর আমার এই কথাগুলোর একটাও মনে থাকবে না। কারণ রাজু যদি একবার দেখতে পায় আমি চলে আসছি, তাহলে এই কদিন ওর ঠিকানা পরিবর্তন হয়ে আমার নানুবাড়ি, ওর ঠিকানা হয়ে যায়। এদিকে দিবরাজ, তামিম, শিবু, রাসেল ওরা তো আস্তানা গেড়ে বসে। আর আমাদের সবার মধ্যমনি হয় খায়ের মামা। বড়দের কাছে সে মূল্যহীন হলেও আমাদের কাছে সে যোগ্য লিডার।
বাতাসে খবর ছড়িয়ে গেল। খায়ের মামার টিম সবাই হাজির। প্ল্যান হলো যেহেতু অনেকদিন পর বাড়ি আসছি তাহলে আজকের জন্যে বাড়ির গাছ থেকে ডাব চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লেও কেউ কিছু বলবে না। আর ধরা না পড়লে নানুর খোয়ার থেকে মোরগ চুরি করলেও কোন সমস্যা নেই। প্ল্যান মোতাবেক আমার দায়িত্ব পড়লো রাজ দরবার থেকে হিরার মুকুট চুরির মতো বিরাট গুরুত্বপূর্ণ পেয়াজ—মরিচ, আদা—রসুন, মশলা—পাতি সংগ্রহ করার। ঠিক সন্ধ্যার একটু পরই প্রায় সবাই জায়গামত উপস্থিত। ঘ্রাণে ভরা মিহি চালের পোলাও আর দুইটা দেশি মোরগ রেডি। খাওয়া শেষে বাড়ির পূবদিকে ডোবার পাশের নারকেল গাছ থেকে ডাব পারতে যাব। এরপর দরজা খোলা পেলে কাচারীঘরে নয়তো বন ভর্তি গোচালা ঘরে রাত পার করে দিব। আগে থেকেই মন সায় দিচ্ছিলো না। শুধু খায়ের মামার অতি উৎসাহী কথায় রাজি হয়েছিলাম। নয়তো আমি আসলেই অতি সাচ্চা ভদ্র একটা ছেলে। ভয়ে কলিজা পর্যন্ত কাঁপাকাপি করছে। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে একাই দৌড় দিই। কিন্তু লজ্জাশরমে সেটা করতে পারছি না। ইজ্জতের দিকে তাকিয়ে এই মুহুর্তে কাওকে বলতেও পারছি না যে, ভয়ে আমার হাত—পা অনেক আগেই শেষ এখন শুধু কলিজাটা বাকি আছে একটু। সবার ভাবসাব দেখে মনেই হচ্ছে নাÑকেউ ভয় পাচ্ছে, শুধু আমি ছাড়া। বরং মনে হচ্ছে এই বাঁশঝাড়, ডোবা, তালগাছ আর নারকেল গাছের পথটা যেন তাদের সবার কাছে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাবার রাস্তা। অগত্যা আমিও এগুচ্ছি সবার সাথে। রাতের পরিবেশ কতোটা নিরব, শান্ত! মাঝেমধ্যে দুই একটা ছোটবড় নানান পাখি উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। তিরতির করে বাতাস গায়ে এসে লাগছে। বাশ বাগানের কাছাকাছি আসতেই মনে হচ্ছিল উপর থেকে কেউ মোতাহার স্যারের বেতের বাড়ির মত একটা বাঁশ দিয়ে আরেকটা বাঁশে বাড়ি দিয়ে যাচ্ছে। আর কড়—মড় কড়—মড় করে বাঁশ ভেঙে ভেঙে পড়ছে। কিন্তু একটা বাঁশও ভাঙছে না। মনে মনে আরো ভয় পেলাম। কী হচ্ছে এসব ভাবতেই! হঠাৎ তাল গাছ থেকে ধুপধাপ আওয়াজ! দূর থেকে শুধু দেখলাম ডোবা থেকে কয়েকটা কালো ছায়া এদিকেই আসছে। চাঁদের আবছা আলোয় মনে হচ্ছিল মাথার উপর কুচকুচে কালো এমন কিছুদাঁড়িয়ে আছে— যার এক পা ডোবায় আরেক পা পশ্চিমে জারুল বাগানে। আমার ঘাড়ের উপর জোড়ালো একটা চাপ অনুভব করলাম। পা চলছে না, চোখে আর কিছু ভাসছে না। একটু ঝিরঝির করেই ক্ষ্যান্ত চোখ। এই জীবনে বোধহয় আর ডাব খাওয়া হলো না। আরব্য রজনী গল্পের দানবটা এখানেই থাকত, সেটা কেউ কেনো দিন বলেনি তো! ইয়াহ আর কিছু ভাবতে পারছি না। ধপাস…
