গল্প শোন প্রিয় নবীর-মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন

গল্প শোন প্রিয় নবীর-মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন

পর্ব-১১

আম্মার সুহাইব ও আবু যর
ইসলাম- সুবাসভরা এক ফুল।
ফুল লুকিয়ে রাখা যায়- তার সুবাস বেঁধে রাখা যায় না।
ইসলাম- জোসনাভরা পূর্ণিমা।
বল, চাঁদকে লুকিয়ে রাখবে কিভাবে?
গোপনে, নিশ্বাসের সঙ্গে ছড়াতে থাকে এই বিশ্বাসের সুবাস। এইখানে যে আসে, নবীজির সঙ্গে বসে, কথা বলে, শুনে ওহীর বাণী- তার কথায়ও ছড়াতে থাকে এক অলৌকিক ঘ্রাণ!
তাওহীদের ঘ্রাণ!
পবিত্রতার ঘ্রাণ!
মানবতার ঘ্রাণ!
মানুষকে ভালোবাসার ঘ্রাণ!
এই ঘ্রাণের টানে, সূর্যের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা দেখা করেন নবীজির সঙ্গে! দু’দণ্ড কথা বলে বুকটা ভরে যায় আলোয়, বিশ্বাসে এবং শ্রদ্ধা ও মমতায়।
যাদের সঙ্গে মনের সম্পর্ক খবরটা সুযোগ মতো তাকেও দিতে ভুল করেন না তারা।

হযরত আম্বার ইবনে ইয়াসির-এর নাম নিশ্চয় শুনেছ!
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের অনেক ভালোবাসতেনÑ আম্মার তাঁদের একজন। এই ভাগ্যবানদের তালিকায় আরেকটি আলোকিত নাম হযরত সুহাইব।
তারা গোপনে জানতে পারেন-আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ নবী হয়েছেন। তিনি নাকি বলেন- সব মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই। কেউ বড় কেউ ছোট নয়।
কী আশ্চর্য কথা! দাস-দাসীররাও মানুষ!
না, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে। সরাসরি কথা বলতে হবে তাঁর সঙ্গে। সব সর্তকতা ও গোপনীয়তার পরও কিভাবে যেন জানাজানি হয়ে গেছে।
বাতাসে ভয়ের তাপ!
দেখা করতে হবে গোপনে!
নবীজি এখন দারে আরকামে থাকেনÑ বেশিরভাগ সময়! ওখানেই যেতে হবে সুযোগ করে।
চারদিকে হরিণদৃষ্টি!
না, কেউ দেখছে না। বিড়ালের মতো নিঃশব্দে পা ফেলে হাঁটছেন।
একি! দরজায় সুহাইব!! সুহাইব ইবনে সিনান!!!
না, পালাব না!
: সুহাইব! এইখানে? আমিই জিজ্ঞেস করলাম।
: কিন্তু তুমি কেন? একই প্রশ্ন সুহাইবের!
: সাক্ষাৎ করতে এসেছি! ভাবছি, তাঁর কথা শুনব!
: আমিও তো দেখা করতে এসেছি।
চল তাহলে ভেতরে যাই। শুনিÑ তিনি কী বলেন!
ভেতরে যেতেই কাছে ডেকে নেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাদের কথা শুনেন। তারপর তাদেরকে ইসলামের কথা বুঝিয়ে বলেন। তাদের মন গলে যায়। আলোয় আলোয় ভরে উঠে ভেতরটা। কালেমা পড়ে নাম লেখান সৌভাগ্যের স্বর্ণ তালিকায়। রাদিয়াল্লাহু আনহু। [সীরাতুল মুস্তফা, ১: ১৬৮-১৬৯]

আবুযর গিফারী রা.।
দুনিয়ার সব মুসলমান জানেন তাঁর নাম।
নীল আকাশের মতো সরল জীবন এবং সত্য প্রকাশে আপসহীন এই সাহাবী আমাদের নবীজিকে অনেক ভালোবাসতেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ভালোবাসতেন তাঁকে।
সফরে তিনি নবীজির সঙ্গে তাঁর উটের পিঠে বসতেন।
তিনি নবীজির বিশেষ খাদেম।
আর তাঁকে বলা হতো- সাহিবুস-সির’ নবীজির কণ্ঠে শোনা গোপন জ্ঞানের ধারক। হ্যাঁ, সম্পর্কটা ছিলো অন্য অনেকের থেকে আলাদা। বড় হয়ে তোমরা তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা পড়বে। বড় মজার কথা কি জান, তিনি যখন নবীজির কোন ঘটনা শোনাতেন, কিংবা কোন বাণীÑ তিনি নবীজি কিংবা আল্লাহর রাসূল বলে শোনাতেন না। বলতেনÑ আমার খলীল’ কিংবা বলতেন আমার ‘হাবীব’ বলেছেন। জানই তো- খলীল এবং হাবীব অর্থ বন্ধু, প্রিয়তম বন্ধু! আমাদের নবীজিকে সদা তিনি ‘আমার প্রিয়তম বন্ধু’ বলে স্মরণ করতেন।
কিভাবে মুসলমান হলেন- এবার সেই গল্প শোন!

মনের ভেতরে ফুল
গিফার! আরবের পুরনো গোত্র।
ডাকাতি, খুনখারাবি এদের পেশা। নির্দয়, নির্মম এদের স্বভাব।
আবু যর গিফারী এই ডাকাত গোত্রেরই এক সাহসী যুবক। গোত্রের আর দশজনের মতোই বেড়ে ওঠেন অন্যায় দুঃসাহসে চারদিকে অগ্নি ছড়িয়ে। একা রাতের আঁধারে বিদেশি যাত্রীদলের ওপর হামলা করে ছিনিয়ে আনতেন বাণিজ্যের পণ্য, মূল্যবান উট। মনের খেয়ালের টানে একাই ছুটে যেতেন বিশাল কাফেলা লুট করতে। আর চারদিকে তার সে কি প্রশংসা।
আল্লাহ ভালো জানেন- কিভাবে হঠাৎ বাঁক বদলে যায় তার জীবনের। সিদ্ধান্ত নেন- না, আর ডাকাতি করব না।
লুটতরাজ খুনখারাবি- আজ থেকে বিদায়!
শিশুর কান্না, অসহায় নারীর কাকুতি কিংবা সর্বহারা বৃদ্ধের কাতরমুখ-কী তাকে অমন মোমের মতো গলিয়ে দিয়েছিলÑ ইতিহাস বলেনি। বলেছে, সর্বত্র আগুন ছড়ানো বীর আবু যর হঠাৎ সাধকের মতো ধ্যানী ধ্যানী হয়ে উঠেন। আরও আশ্চর্যের কথা হলো, যেখানে চারদিকে মূর্তি- আবু যর সেখানে মুখ ফিরিয়ে নেন মূর্তি থেকেও।
আসাফ নায়েলা কিংবা লাত ওজ্জা নয়।
তিনি সিদ্ধান্ত নেন- আমি আমার সব পাপের জন্যে ক্ষামা চাই আল্লাহর কাছে। আমি পূজা করব কেবল তাঁরই।
একবার নিজেই বলেছেন-
‘ভাতিজা! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা হওয়ার তিনবছর আগে থেকেই নামাজ পড়তাম।’
বদলে গেছে জীবন।
ডাকাতি ছেড়ে ভদ্রলোক।
ভদ্রলোক কেন? দরবেশ!
এভাবে যারা দল থেকে আলাদা হয়ে যান দল তাদের ছেড়ে দেয় না! দুষ্টদলের এই চরিত্র সবযুগে সবদেশে এক! কোন দুষ্টদলের সঙ্গে চোরা কারবারি চুরি ডাকাতি করবে- করো! দল তোমাকে সেফ করবে। দল ছেড়ে ভালো মানুষ হয়ে যাবে? ওই দলই তোমাকে খুন করে ফেরবে! পাছে তাদের পাপের খেলা ধরা পড়ে যায়- সেই ভয়ে।
হয়তো এমন কোন কারণেই আবু যর গিফারীকে নির্বাসিত হতে হয় জন্মভূমি থেকে। প্রথমে মা ও ভাই আনীসসহ গিয়ে উঠেন মামার বাড়ি। সেখানেও বেশি দিন থাকেননি আবু যর। মামাবাড়ি ছেড়ে পথ ধরেন মক্কার। মক্কা আরবের বিখ্যাত শহর। তারা শহরে না গিয়ে- শহরের বাইরে বাতহা উপত্যকায় তাঁবু টানালেন।
এই সময়ের কথা!
আবু যর গিফারীর তাঁবুর পাশে নোঙর করে এক মুসাফির। তার পাশে এসে বসেন আবু যর। কথায় কথায় গল্প জমে উঠে। আবু যর গিফারীর মুখে এক আল্লাহর কথা শুনে ওই মুসাফির অবাক কণ্ঠে বলেন- আবু যর! এই কথা আমি মক্কায় শুনে এসেছি। মক্কার এক ব্যক্তি! তাঁর দাবি তিনি আল্লাহর নবী। তাঁর ওপর ওহী নাজেল হয়। আল্লাহ নাকি তাঁকে বলেছেন- আল্লাহ এক! তাঁর কোনো শরীক নেই। তাঁকে ছাড়া আর কারও ইবাদত করা যাবে না।
আবু যর ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেন! আমি তো তাঁকেই খুঁজছি।
তবুও সংযত বাইরে।
: কী নাম তার? তিনি কি মক্কার মানুষ? তাঁর বংশ পরিচয়? আবু যর জানতে চান।
: হ্যাঁ, মক্কার মানুষ। নাম মুহাম্মদ! সম্ভ্রান্ত কুরায়েশ গোত্রের সন্তান।
আর কথা বাড়ায় না আবু যর।

আনীস! কবি!
আবু যর গিফারীর ভাই। মূর্তিপূজারী।
হঠাৎ করেই বললেনÑ ভাইয়া! আমি মক্কা থেকে ঘুরে আসি। আপনি আমার উটগুলোর দিকে খানিকটা খেয়াল রাখবেন। তাড়াতাড়িই চলে আসবো। আবু যর যেন এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন! বললেন : যাবে যখন যাও! সঙ্গে আমার একটা কাজ করে এসো।
শুনেছি- মক্কায় একব্যক্তি নিজেকে নবী মনে করেন। তাঁর কাছে আসমান থেকে সংবাদ আসে বলেও নাকি দাবি করেন। তাঁর খোঁজখবর নিয়ে এসো। পারলে তাঁর কথাবার্তাও শুনে এসো।
আনীস মক্কায় যান।
অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকেন আবু যর।
ফিরে আসেন কয়েকদিন পর। আবু যর আগ্রহের সঙ্গে জানতে চান- এত দেরি করে ফিরলে যে?
: সে লোকটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে এত দেরি।
: দেখা হলো শেষে?
: হ্যাঁ, দেখা হয়েছে।
: তারপর?
: তাঁর কথাবার্তা অনেকটা আপনার মতোই। মানুষকে ভালো জিনিস শেখান। আর এটা ঠিক- তিনি নিজেকে নবী দাবি করেন।
: আচ্ছা, মক্কার লোকেরা তার সম্পর্কে কী বলে? কেমন জানে তাকে?
: কেউ বলে কবি, কেউ বলে গণক।
: তুমি তো একজন বড়কবি। তাঁর কথা শুনে তোমার কি মনে হয়েছে?
: কবিতার ছন্দের সঙ্গে তাঁর ছন্দ ভালো করে মিলিয়ে দেখেছি। নিঃসন্দেহে তাঁর কথাগুলো কবিতা নয়। আর গণকের বিষয়টিও ভেবেছি। জীবনে অনেক গণকের সঙ্গে উঠা বসা করেছি। তাঁর কথাবার্তা গণকদের মতো নয়। এরা যা বলে আসলে সবই মিথ্যা। আমার কাছে তাঁকে সত্যবাদী মনে হয়েছে।
না, আমি নিজেই যাবো- ভাবেন আবু যর। ছোটভাই আনীসকে বলেন, তুমি ঘরে থেকো। আমি গিয়ে দেখে আসি আসল বিষয়টা কি? কাঁধে পানির একটি ছোট্ট মশক আর ঝোলায় সামান্য শুকনো খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়েন আবু যর। এসে আশ্রয় নেন পবিত্র মক্কায় হেরেমে। আশ্চর্য বিষয়, এখানে ত্রিশদিন পড়ে থাকেন হযরত আবু যর। অল্প কদিনের মধ্যেই তার জাম্বিলের সামান্য খাবার ফুরিয়ে যায়। শুরু হয় ক্ষুধার সংগ্রাম। ভয় পাওয়ার মানুষ আবু যর নয়। আপস শব্দ তার অভিধানে নেই। পেটে ক্ষুধার আগুনটা যখন লাভা ছাড়াতে থাকে আবু যর চলে যান জমজম কুপের কাছে। জমজমের শীতল পানি আর বরকতের বরফ ঢেলে দেন ক্ষুধার মুখে। বড় হয়ে পড়বে এই যমজমের অনেক আজব কাহিনী। জমজমের পানি খেতে খেতে আবু যরের শরীর মোটা হয়ে চামড়া ফেটে যায়। বেড়ে যায় বীরের শক্তি। দিনের পর দিন পড়ে আছেন নবীজির সাক্ষাতের আশায়। কাউকে কিছু বলেনও না। পাছে কোন বিপদ হয়- এই ভেবে।
‘সাবী’- মক্কায় পচলিত একটি শব্দ। যারা বাপ-দাদার মূর্তিপূজার ধর্ম ছেড়ে দেয় তাদের তারা সাবী বলতো। সাবী অর্থ বিধর্মী। তাদের কাছে মুসলমান সাবী। একদিনের কথা আবু যর ভদ্র-মতো একজন লোক দেখে অনুমান করলেন-একে জিজ্ঞসে করা যায়। কাছে গেলেন।
: আচ্ছা সাবীদের কাউকে তুমি চেন? বলতে দেরি। শুরু হয়ে যায় চেঁচামেচি। তুমিই সাবী। কিল ঘুষি লাথি।
বেহুশ হয়ে পড়েন আবু যর। রক্তে ভিজে যায় শরীর। সন্ধ্যার পর যখন হুশ ফিরে পান- কষ্টে উঠে দাঁড়ান। জমজমের পাড়ে গিয়ে একবার তাকান নিজের দিকে। কেঁপে উঠেন ভয়ে- আমাকেই দেখছি, না কোন জ্বিন! গা পরিষ্কার করেন। চাদরটাও। পেটভরে জমজম পান করেন। হাত তুলে কাঁদেন আল্লাহর কাছে! হে আল্লাহ! তুমি আমাকে পথ দেখাও!
একদিনের কথা। আবু যর পড়ে আছেন পাক হেরেমেই। একদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন হযরত আলী। কিশোর। কিন্তু চোখে মুখে বুদ্ধির বিদ্যুত দূর থেকেই দেখা যায়। তার চোখ পড়ে জীর্ণহাল প্রবাসী আবু যরের উপর। কাছে যান-
: বাড়ি কোথায়?
: গিফার!
: ঘরে চলুন…
মনে ভয়। খোলা মাঠে পড়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত। হযরত আলীর ছায়া ধরে হাঁটতে থাকেন। কিন্তু কোন কথা নেই। মনে আছে, একবার সাবী শব্দটা বলে কী মারটা খেয়েছেন। নিরবে রাতটা কাটিয়ে ফিরে আসেন হেরেমে। পরের রাতে ঘটে একই ঘটনা। তৃতীয় রাত! হয়তো অপেক্ষায় ছিলেন আবু যর। কিন্তু হযরত আলী আজ এপথে আসেননি। অপেক্ষায় অপেক্ষায় রাত হয়েছে। চারদিকে নিরবতা। আকাশে পূর্ণচাঁদ ভাবতে ভাবতে বুজে আসে চোখ। হেরেমের চারপাশে এখন কেবল দু’জন নারী পাশাপাশি তাওয়াফ করছে। কাবার প্রাঙ্গনে বড় দু’টি দেবতা। আসেফ ও নায়েলা। ওই দুই নারী আফেস ও নায়েলার কাছে করুণ করে সাহায্য চাইছে তাদের প্রার্থনার ভাষা আবু যরের কানে পরতেই বলে উঠেন-“ওদের একটাকে আরেকটার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দাও”। কারণ, আরবরা বিশ্বাস করতো- “এরা একে অপরের বিচ্ছেদে কাতর”। তাই বলে দেবতাদের ওমন কথা।
“আমাদের কবিলার কেউ এখানে থাকলে মজা বুঝতে”। মুখে রাগ ঝেড়ে তারা আবার নিজেদের কাজে মন দেয়। এর খানিকপরেই ওইখানে উপস্থিত হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর সিদ্দীক রা.। ওই দুই নারীর গজগজানী নবীজির কানে পড়ে জানতে চান, কি হয়েছে তোমাদের?
: কি আর হবে, কাবার পাশে সাবীরা বাসা বেঁধেছে।
: কী বলেছে তোমাদের?
: ওমন কথা মুখে আনা যায়!
তারপর তারা ঘরে ফিরে যায়। এরপর ধীরে হেরেমে প্রবেশ করেন আল্লাহর রাসূল। তাওয়াফ করেন। চুমুখান হজরে আসওয়াদে। নামাজ পড়েন। আবু যর ততক্ষণে চকিত। নামাজ শেষ হতেই সামনে এসে সালাম করে। নবীজি সালামের উত্তর দিয়ে জানতে চান- কোন গোত্রের লোক তুমি?
: গিফার!
নবীজি কপালে হাত রেখে তাকে দেখেন। তিনি নবীজির দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে আবু বকর রা. তাকে ডাকেন!
: কতদিন ধরে আছ এখানে?
: ত্রিশদিন প্রায়।
: খানাপিনা কে দেয়?
এই জমজমের পানি আমার খাবার! হযরত আবু বকর রা. নবীজির দিকে তাকিয়ে বললেন : অনুমতি দিন, আজ রাতে এ আমার ঘরে মেহমান হোক। ঘরে এসে তাকে আবু বকর রা. তায়েফের কিসমিস খেতে দেন। আবু যর বলেছেন- মক্কায় এটাই ছিলো আমার আতিথেয়তার প্রথম খাবার। ভোর হয়। কিন্তু আবু যরের রাত এখনো সামান্য বাকি। ফিরে আসেন হেরেমে। আজ সন্ধ্যায় আবার সাক্ষাৎ হযরত আলীর সঙ্গে। আজও তাকে ঘরে নিয়ে আসেন আলী। নিরব। হযরত আলীই প্রথম নিরবতা ভাঙ্গেন! জানতে চান- মক্কায় কেন এসেছেন? কি কাজে পড়ে আছেন?
: যদি কথা দাও তাহলে বলতে পারি!
: নির্ভয়ে বলুন!
: বলব, যদি তুমি আমাকে সাহায্য করতে রাজি হও।
: সম্ভব সব সাহায্য করব আপনাকে!
শুনেছি মক্কায় একব্যক্তি নবী দাবি করেছেন। বিষয়টি জানার জন্যে আমি আমার ভাইকে পাঠিয়ে ছিলাম। কিন্তু সে সন্তুষ্টজনক তথ্য নিয়ে যেতে পারেনি। ওই নবীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি আমি!
আনন্দে জ্বল জ্বল করে উঠে হযরত আলীর মুখ। বলতে শুরু করেন- “নিঃসন্দেহে তিনি আল্লাহর নবী। সকালে আমি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যবো। আমরা দু’জন একসঙ্গে যাবো। পথে বিপদ হতে পারে এমন কাউকে দেখলে আমি প্রস্রাবের ভান করে বসে পড়ব। আপনি সোজা হাঁটতে থাকবেন। তারপর আমি যেখানে প্রবেশ করবো আপনি সেখানে চলে আসবেন”।
সকালবেলা ভালোয় ভালোয় নবীজির দরবারে হাজির হন আবু যর। আগের রাতেই তিনি নবীজিকে চিনতে পেরেছিলেন। তাই ভেতরে ঝড় বইছিলো আবেগের। শরীর মনজুড়ে চরম উত্তেজনা! নবীজি কিছু বলবার আগেই সামনে গিয়ে আবেদন করেন : আপনি যা বলেন আমাকে শুনান!
: আমি বলি না। আল্লাহ বলেন।
নবীজি পবিত্র কুরআনের একটি সূরা তেলাওয়াত করে শোনান। পরম তৃপ্তিতে পূর্ণ আবু যর। মুখে কালিমা- আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহ…

আলোর মম হাতে আবু যর
ইসলাম কবুলের পর দুটি ঘটনার মুখোমুখি হন আবু যর। একদিন কয়েকজন মেয়েমানুষ তাওয়াফ করছিল। ইয়া আসাফ, ইয়া নায়েলা বলতেই আবু যর বলে উঠেন- ওদেরকে বিয়ে দিয়ে দাও। এবার আর যায় কোথায়! শুরু কিল ঘুষি লাথি….
আবু যর জেদি মানুষ। সোজা নবীজিকে এসে জানিয়ে দেন- আমি কুরাইশদের ছাড়বো না, এর প্রতিশোধ নেবই।
নবীজি তার সাহসে, সত্য-চেতনায় খুশি হন। সঙ্গে পরামর্শ দেন। এখন তুমি ঘরে ফিরে যাও। আমার পক্ষ থেকে তোমার সম্প্রদায়কে দীনের দাওয়াত দাও।
আবু যর এককথায় রাজি। সঙ্গে এও জানিয়ে দেন- “যাওয়ার আগে আল্লাহর ঘরের সামনে অবশ্যই কাফেরদের সামনে চিৎকার করে বলে যাব ইসলামের কথা”।
যে কথা সে কাজ। এবারও মেরে রক্তাক্ত করে কাফেরদল। আবু যর ঘরে ফিরে গিয়ে ভাই ও মাকে দাওয়াত দেন। তারা সহজেই মেনে নেন তার কথা। কারণ, আনীস আগে থেকেই নবীজির উপর দুর্বল হয়ে পড়েছিল। হয়তো মাকেও বলেছিলো ওইসব গল্প। এবার আবু যর মা ও ভাইকে নিয়ে গাসফানের একটি ঘাঁটি “সানিয়াতুল গাজাল” এ গিয়ে আস্তানা পাতেন। এই পথে কুরাইশদের ব্যবসা করতে যেতে হতো। কোন কাফেলা ওই ঘাঁটির কাছে আসামাত্র দুঃসাহসী দুইভাই হামলা করে বসতেন। সবসম্পদ হাতে নিয়ে বলতেন, যদি ইসলাম কবুল কর আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মেনে নাও সব ফেরত পাবে। নইলে একটি শস্যও ফেরত পাবে না। মজার কথা কি জান, শাবীব! অনেকেই তার কথা মেনে নিতো। কারণ, দেখামাত্রই তারা তাকে চিনত- এতো আবু যর! মক্কায় তার উপর জুলুম করা হয়েছিলো। যারা মুসলমান হতো তারা কথা রাখতো। মক্কায় ফিরে এসে নবীজির দলে যোগ দিতো। আর যারা ঘাড় বাঁকা করতো, কান মলে খালি হাতে পাঠিয়ে দিতেন মক্কায়। এভাবে একবৃদ্ধা মা ও দুঃসাহসী দুইভায়ের অপারেশনে দিনে দিনে অনেক মানুষ ইসলাম কবুল করেন। বড় হতে থাকে নবীজির পবিত্র কাফেলা!
সূত্রসহ বিস্তারিত: সায়্যেদ মানাজির আহসান গিলানী রহ. : হযরত আবু যর রা. পৃ ১৬-৭০

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment