বাবা আর মায়ের মাঝে এত মিল, দেখে মনে হয় এমন যেন আর কোথাও নেই। অথচ সেই বাবা আর মা আচমকাই একটা ইস্যুতে এসে উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুর মতো বিপরীতমুখী হয়ে যান। সেই ইস্যু আর কেউ নয়, তাদের একমাত্র মেয়ে জুঁই। কোনো কারণে বাবা যদি বলেন জুঁইয়ের কোনো তুলনাই হয় না, অমনি মা প্রতিবাদ করে বলেন, কি করে বুঝলে তুলনা হয় না? জুঁই ছাড়া আর কয়টা মেয়েকে দেখেছ তুমি?
বাবা জবাব দেন, আমার মেয়েকে চেনার জন্য হাজারটা মেয়ে দেখে বেড়াবার দরকার নেই। আমি তোমাকে তো দেখছি। আমার মেয়ে তোমার মতো আলসে হয়নি।
মা বলেন, এ কথা আমার বাবার মুখেও অনেক বার শুনেছি। যার যার বাবার কাছে তার তার মেয়ে এমন তুলনাহীনই হয়।
বাবা বলেন, আমি অমন একচোখা বাবা নই। সব দিক যাচাই করেই বলছি, আমার মেয়ের কোনো ডুপি¬কেট নেই। সি ইজ অনলি ওয়ান—একবারেই অদ্বিতীয়া।
মা বলেন, হ্যাঁ, অদ্বিতীয়া। দুষ্টুমি আর পড়ায় ফাঁকি দেয়ার বেলায় অদ্বিতীয়া। সারাদিন তো বাইরে বাইরে থাকো, তাই মেয়ের আসল রূপ বুঝতে পারো না। আমি পাশে থাকি। আমি বুঝতে পারি কতটা লক্ষ্মী মেয়ে জুঁই।
এমন করে মা আর বাবার মাঝে কথার পর কথা চলতে থাকে জুঁইকে নিয়ে। আর সেই সারাটা সময় জুঁই মিটিমিটি হাসে। কারণ জুঁই জানে, বাবা-মা দুজনার কাছেই সে অদ্বিতীয়া। শুধু কথাটা আজ বাবা বলেছেন তাই মা প্রতিবাদ করছেন। মা বললে বাবাও প্রতিবাদ করতেন।
দুই.
আজ সকালে নাশতা খেয়ে পড়তে বসেছে জুঁই। এমন সময় বাবা এসে বলেন, তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করো। তোমাকে নিয়ে কাপড় কিনতে যাব।
: ঈদের জন্য?
চোখ বড় বড় করে জুঁই তাকায় বাবার দিকে। বাবা বলেন, হ্যাঁ, ঈদের জন্য। আজ বাদে কাল ঈদ। কিছুই তো কেনা হয়নি। আজ কিনবো।
ঈদের কাপড় কিনতে নিয়ে যাবেন বাবা, এ কথা শোনার পরও বই নিয়ে বসে থাকবে, এতোটা বোকা নয় জুঁই। তাই বই-খাতা ঝটপট গুছিয়ে নিয়ে জুঁই বলে, পড়ালেখা শেষ। চলো বাবা মার্কেটে যাই।
বাবা আর মেয়ে মার্কেটে যাবে শুনে মাও ঝটপট তৈরি হয়ে নেন। তারপর তিনজন গাড়িতে উঠে বসেন।
দোকানে গিয়ে সবচেয়ে দামি আর সুন্দর ফ্রক-প্যান্ট পছন্দ করে জুঁই। এক সেট নয়— তিন সেট। সব মিলিয়ে সেলস্ম্যান দাম বলেছে ছ’হাজার টাকা। তাতেই রাজি হয়ে যান বাবা। বিল পরিশোধ করার জন্য মানিব্যাগ বের করেন। অমনি আঁতকে ওঠেন মা—এ্যাই এ্যাই! কি করছো বোকার মতো?
বাবা হকচকিয়ে যান মায়ের কথা শুনে। বোকামিটা কি করতে যাচ্ছিলেন তা বুঝতে না পেরে থমকে যান। সে সুযোগে মা বলেন, মাথা-টাথা ঠিক আছে তো?
: কেন?
পাঁচশো টাকার চকচকে নোটগুলো গুনতে গুনতে জিজ্ঞেস করেন বাবা। মা বলেন, ছোট্ট একটা মেয়ে। তার জন্য ছ’হাজার টাকার কাপড় কিনছো তুমি।
বাবা বলেন, ছোট্ট একটা মেয়ে এটা যেমন সত্য— আমার একমাত্র মেয়ে, সে কথটাও সত্য। সুতরাং…
বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই মা চেঁচিয়ে ওঠেন, তাই বলে ছ’হাজার টাকা? একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
বাবা মুচকি হেসে বলেন, না, বাড়াবাড়ি হবে না। তোমার জন্য যখন সাত হাজার টাকার শাড়ি কিনবো, তখন ওটা ব্যালান্স হয়ে যাবে। এই তো নিয়ম।
মা আবার চেঁচিয়ে ওঠেন— রাখো তোমার নিয়ম। মেয়ে বলেছে তিনটি ফ্রক নেবে, অমনি বাবা তিনটি ফ্রকই কিনে দিচ্ছেন! এমন বোকামির কোনো মানে হয় না।
: বোকামি বলছো কেন? কন্যাস্নেহও তো বলতে পারো।
: না, বলতে পারি না। কন্যা তো আমিও ছিলাম। কিন্তু আমার বাবা তো কখনো এমন বোকার মতো কাজ করেননি। শোনো! আমিও তো জুঁইয়ের মা। ওর ভালো-মন্দ তোমার চেয়ে কিছু কম বুঝি না। জুঁই একটা ছোট্ট মেয়ে। দিনদিন বড়ো হচ্ছে। দু’মাস পর দেখবে এ ফ্রকগুলো ওর গায়ে লাগবে না। সব আনফিট হয়ে যাবে। এ সমস্যাটা জেনেও তিনটি ফ্রক কিনে দেয়ার কোনো মানে আছে?
: তো কি করবো আমি?
: আজ একটা ফ্রকই কিনে দাও। পরে আবার দিও।
বাবা অসহায় চোখে জুঁইয়ের দিকে তাকান। দেখতে পান জুঁইয়ের ভ্রমর-কালো চোখ দুটো ছলছল করছে। চোখের কোণে হীরের মতো কি যেন জ্বলজ্বল করছে। সম্ভবত কান্না— ভাবেন বাবা। আর এ সম্ভাবনার কথাটা ভাবতেই প্রচণ্ড দুঃসাহসী হয়ে ওঠেন তিনি। ঝটপট সেলস্ম্যানের হাতে নোটগুলো গুঁজে দিয়ে বলেন, তিনটাই প্যাক করে দিন।
এক মুহূর্ত আগে মায়ের কথা শুনে বাবা বোকার মতো তাকিয়েছিলেন— এবার বাবার কথা শুনে মা বোকার মতো তাকিয়ে থাকেন। সে ফাঁকে সেলস্ম্যান দারুণ সুন্দর তিনটি বাক্সে ফ্রকগুলো ভরে জুঁইয়ের হাতে তুলে দেয়।
তিন.
বাসায় ফিরে মা অন্য মানুষ হয়ে যান। যে তিনটি ফ্রক কেনার জন্য মা জোর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, সেই কাপড়গুলো নিয়েই তিনি সবার কাছে গর্ব করে বেড়ান। জুঁইয়ের বড় চাচীকে ডেকে বলেন, দেখো ভাবী দেখো, কি অ্যারিস্টোক্রেট পছন্দ আমার মেয়ের। কত কাপড় ছিল দোকানে, কিন্তু জুঁই বেস্ট তিনটাই বেছে নিয়েছে। সুন্দর না ফ্রকগুলো?
শুধু বড় চাচীকেই নয়, সবাইকেই ফ্রকগুলো দেখিয়ে গর্ব করতে থাকেন মা। আর তা দেখে ভালোলাগায় ভরে যায় জুঁই আর ওর বাবার মন। এভাবে নতুন ফ্রক আর জুতা-ফিতা দেখতে দেখতে ঈদও এসে যায়।
ঈদের আগের দিন আবার মন-মেজাজ খারাপ হয়ে যায় মায়ের। শুকতারার মাকে কাকডাকা ভোরে আসতে বলেছিলেন— সে এসেছে সকাল দশটারও অনেক পরে। এসেও কেমন কেমন করছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকছে ওখানে বসে থাকছে। কোনো কাজ করছে না অন্যদিনের মতো। মাও ভয়ে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেন না। শুধু বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন আপন মনে।
জুঁইয়ের সঙ্গে সব সময়ই ভালো সম্পর্ক শুকতারার মায়ের। কারণ শুকতারাও জুঁইয়েরই বয়সী। আর শুকতারা যখন এ বাসায় আসে তখন জুঁই প্রাণ খুলে শুকতারার সঙ্গে গল্প করে। এ কারণে জুঁইকেও ভালোবাসে শুকতারারা মা।
ফ্রিজ থেকে আপেল নেয়ার জন্য জুঁই খাবারঘরের ঢুকেছিল। হঠাৎ ওর চোখ পড়ে শুকতারার মায়ের ওপর। জুঁই দেখে জানালার গ্রিল ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ থেকে নেমে আসছে কান্নার ধারা।
প্রায় চার বছর ধরে এ বাসায় কাজ করছে শুকতারার মা। তখন অনেক ছোট ছিল জুঁই। কিন্তু একটা কথা স্পষ্ট মনে আছে, এর আগে শুকতারার মাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি সে। আজ দেখে তাই অবাক হয়। তাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কাঁদছো কেন খালা? মা বকেছেন?
শুকতারার মা কথা বলে না। তবে মাথা নাড়ে। জুঁই তাতেই বুঝে নেয় মা কিছু বলেননি। তাই আবার প্রশ্ন করে, তাহলে কাঁদছো কেন?
শুকতারার মা বলে, কানতাছি মাইয়াটার কথা ভাইবা। কাইল ঈদের দিন। ভাবছিলাম ফুটপাত থিকা একটা ফোরাক কিনা দিমু। তা আর অইলো না। মাইয়াটার মনটা এক্কেবারে ছোট অইয়া গ্যাছে।
জুঁই জিজ্ঞেস করে, ফ্রক কেনা হলো না কেন? কাল না মা তোমাকে অনেকগুলো টাকা দিলেন? বাবা ভিন্ন করে টাকা দিলেন শুকতারার জন্য?
: হ মা, তেনারা দিছেন। কিন্তুক ওই যে বাড়িওয়ালা। দুই মাসের ভাড়া পাইতো। বাড়িতে গিয়া দেখি হেয় শকুনের মতন বইস্যা আছে। হাতের টাকাগুলান বেবাক নিয়া গ্যালো! তয় কও কি দিয়া মাইয়ার ফোরাক কিনুম?
জুঁই তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পায় না। তাই সেখান থেকে ধীরে ধীরে সরে যায়। । তবে প্রশ্নটা সারাদিন ওকে কুরে কুরে খায়। রাতের ঘুমও কেড়ে নেয়। সেই সময়টা ওর মনের পর্দায় ঘুরে বেড়ায় শুধু দুঃখ ভারাক্রান্ত ম্লান শুকতারার ছবি। ছেঁড়া-ফাটা জামা পরে জড়োসড়ো হয়ে বাঁশের খুঁটি হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি—এমন ছবি ঘুরে বেড়ায় জুঁইয়ের মনের পর্দায়। জুঁই ভাবে, শুধু একটা ফ্রকের জন্য ওরই মতো সুন্দর মেয়েটার সব হাসি মুছে গেছে। অথচ একটু ইচ্ছা করলেই জুঁই সেই হাসি ফিরিয়ে দিতে পারে। হ্যাঁ, তাই করবে জুঁই। বাবা যদি রেগে যান, মা যদি পিটুনি দেন, তবুও তাই করবে।
চার.
আজ ঈদের দিন।
মা রান্নাঘরে শুকতারার মায়ের সঙ্গে নানা কাজে ব্যস্ত। সে সুযোগে আলমারি থেকে একটা ফ্রক বের করে ব্যাগে পোরে জুঁই। তারপর ওটা কাজের ছেলে তনুকে দিয়ে বলে শুকতারাকে দিয়ে আসার জন্য।
কিছুক্ষণ পর নতুন ফ্রক পরে ফুলের মতো হাসি ছড়িয়ে শুকতারা জুঁইদের বাসায় আসে। গেট দিয়ে ঢুকেই চিৎকার করে ডাকে— মা!
সেই ডাক শুনে শুকতারার মা যেমন চমকে ওঠে, জুঁইয়ের মাও তেমন চমকে ওঠেন। দু’জনা ঘুরে তাকান পেছন দিকে। অমনি তাদের চোখ পড়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা শুকতারার ওপর।
মেয়ের পরনে ঝলমলে ফ্রক দেখে প্রথমে বোবা হয়ে যায় শুকতারার মা। বাকহীন কেটে যায় কয়েক মুহূর্ত। শেষে কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসে বিস্ময়ধ্বনি— কি রে শুক! এত্তো সুন্দর ফোরাক তুই পাইলি কই? কেডা দিছে?
শুকতারা গর্বের দৃষ্টিতে ওর ফ্রকটা দেখতে দেখতে বলে, কে জানে কেডা দিছে। হেই সুময় আমি ঘরে আছিলাম না। ঘরে ঢুইকা দেখি ফোরাকটা বিছানের ওপুর পইড়া রইছে । বুঝলাম এইটা আমারই ফোরাক। তাই পইরা ফালাইলাম। সুন্দর না?
শুকতারার মা বলে, হ, খুউব সুন্দর। কিন্তুক এইটা দিলো ক্যাডা? কে এমুন বান্ধব আমার?
শুকতারার মা বুঝতে পারে না কে দিয়েছে ফ্রকটা—কিন্তু জুঁইয়ের মা বুঝতে পারেন। অমনি তিনি জুঁইকে ডেকে আনেন। জুঁই এসে দাঁড়ালে মা বলেন, শুকতারা যে পরে আছে, ওই ফ্রকটা তো তোমার— তাই না?
জুঁই বলে, হ্যাঁ।
মা বলেন, তো শুকতারা ওটা পেল কোথায়? তুমি দিয়েছো?
জুই বলে, হুম্।
: কেন দিয়েছো?
জিজ্ঞেস করেন মা। জুঁই বলে, আমার তো তিনটা ফ্রক। শুকতারার কোনো ফ্রক কেনা হয়নি। তাই ওকে একটা ফ্রক দিয়েছি। তুমি রাগ করেছো?
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা ভেবে নেন। তারপর বলেন, না মা, রাগ করিনি। যে মেয়ের মন এমন ফুলের মতো সুন্দর, তার মা কি রাগ করতে পারে?
: পারে না বুঝি?
: না, পারে না। বরং তার গর্ব হয় মেয়ের জন্য।
আদর করে জুঁইকে চুমু খান মা। আর তখনই ভেসে আসে বাবার কণ্ঠ— অবশেষে তুমিও স্বীকার করছো, আমার মেয়ের মন ফুলের মতো সুন্দর। ব্যাপার কি জানো? ঠিক এ কথাটাই আমি বোঝাতে চেয়েছি তোমাকে, তুমি বোঝেনি।
মা ঘুরে দাঁড়ান বাবার কথা শুনে। অন্যদিন হলে নিশ্চয়ই বাবার এ কথার প্রতিবাদ করতেন মা, কিন্তু আজ করেন না। বরং জুঁইকে অবাক করে ওর তুলতুলে গাল দুটো টিপে দিয়ে মুচকি হাসেন মা।