কুরবানী। ভেতরে লুকিয়ে আছে পিতা-পুত্রের অসীম ত্যাগের ইতিহাস। ঐশীপ্রেমের মালা গাঁথার অতুলনীয় এক বিরল দৃষ্টান্ত রয়েছে এই ইতিহাসে।
শাশ্বত চেতনার এই কুরবানী যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহর চেতনাকে শাণিত করেছে। এখনো পৃথিবীর সবস্থানে এই পুণ্যের বিধান সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
এসো ইতিহাসের পাতায় নজর দেই।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তখন বুড়ো হয়েছেন। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে আকুল আবেগে একটি পুত্রসন্তানের জন্যে মিনতি জানালেন। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর হৃদয়ের আকুলতা ভরা মিনতি কবুল করলেন। দান করলেন তাঁকে সুবুদ্ধির একটি পুত্রসন্তান। পবিত্র কুরআনে সেই কথাই বর্ণিত হয়েছে কী সুন্দর ধাপে ধাপে। হযরত ইবরাহীম বললেন;
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একজন সৎকর্মপরায়ণ সুসন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।
(সূরা সাফফাত: ১০০- ১০১)
বার্ধক্যের অমন জরাজীর্ণ সময়ে হযরত ইবরাহীম আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য পুত্রসন্তানের সুসংবাদ সত্যিই আকাশপুষ্ট নেয়ামত ছিল। বিবি হাজেরার মাতৃগর্ভে জন্ম নিলো ফুটফুটে এক পুত্রসন্তান।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম চোখভরে পুত্রের দিকে তাকিয়ে দেখেন। তবুও মনের ব্যাকুল আশ মিটে না। দু’চোখ কেবল নির্বাক হয়ে তাকিয়েই থাকে। হৃদয়ের মানিককে বুকে জড়িয়ে আটকে রাখেন। পরম আদরে ক্ষণে ক্ষণে কপালে চুমু দেন।
পুত্রস্নেহের এমন আনন্দঘন মুর্হূতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো- তিনি যেন স্ত্রী ও সন্তানকে নির্বাসনের জন্য সবুজহীন উপত্যকায় রেখে আসেন।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ভাবনায় পড়ে যান এতটুকু শিশুকে কীভাবে বিজন মরুভূমিতে রেখে আসবেন! তবুও আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা যাবে না, মানতেই হবে। মনের প্রবল ইচ্ছেটুকু আল্লাহর জন্য সঁপে দিয়ে বিবি হাজেরা ও আদুরে সন্তান ইসমাঈলকে উটের পিঠে নিয়ে রওনা হোন। চলতে চলতে ‘ফারান’ মরুপ্রান্তরে আসেন।
চোখের সামনে আদিগন্ত বৃক্ষহীন ধু-ধু প্রান্তর রাশি রাশি বালু চিকচিক করছে।
আল্লাহর নির্দেশের সামনে মনের ব্যাকুল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিবি হাজেরা ও ইসমাঈলকে সেখানেই রেখে আসেন।
জীবনের চঞ্চল শৈশবে শিশু ইসমাঈল ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগল। তারপর যখন একটু-আধটু বোঝার মতো বয়সে পৌঁছল তখন একদিন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্বপ্নে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদৃষ্ট হোনÑ তিনি যেন সবচে’ প্রিয় বস্তুকে কুরবানী করেন। নবীদের স্বপ্ন ছিল। তাই নবীগণ স্বপ্নে যা দেখতেন, সেটা ওহী হিসেবে গণ্য হতো। স্বপ্ন দেখার পর তিনি বুঝে ফেললেন-সবচে’ প্রিয় বস্তু কোনটি? কুরআন সে কথা বলেছে- পিতা-পুত্রের কথোপকথন। ‘তারপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহীম বললেন; ‘পুত্র আমার! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে জবাই করছি। একটু ভেবেচিন্তে বলো, তোমার কী অভিমত! পুত্র বললো; আপনাকে স্বপ্নে যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আপনি তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’
( সূরা সাফফাত: ১০২)
আহা, পিতা-পুত্রের কী অমায়িক ভালোবাসা ছিলো। পিতা আল্লাহর হুকুমের কাছে সর্মপিত। পুত্র সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজ থেকেই অর্পিত- আগুয়ান। পিতার প্রতি আনুগত্যের এমন উপমা পৃথিবীর আর কোনোকালে ছিল কী? ধীরে ধীরে চলে এলো কাক্সিক্ষত দিন। ‘জিলহজ্জের দশতারিখ’ আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নে পিতা-পুত্র চলে গেলেন মিনাপ্রাঙ্গণে।
এবার স্বপ্নাদিষ্ট হুকুমকে পূর্ণতা দেয়ার পালা। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন।
এক্ষুণি প্রিয় পুত্রের গলায় ছুরি চালাবেন।
প্রিয় পাঠক! আপনাকে এখানে একটু থামাতে চাই। হযরত ইবরাহীম আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই অসীম ত্যাগ কার জন্য?
সকল মায়া ভালোবাসা ছেড়ে নিজের সবচে’ প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সামনে অর্পণ করলেন। কিসের জন্য এত এত মায়া-মুহব্বত বিসর্জন দিলেন। আমরা কেন এমন হতে পারি না? চেষ্টা করি না ইবরাহিমের মতো আত্মত্যাগী হতে!
আজ এখানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করি।
হযরত ইবরাহীম চেতনায় উদ্দীপ্ত হতে পারি।
আকাশ পৃথিবী সে সময় কি একটু থেমে গিয়েছিলো? অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো, পিতা-পুত্রের অবিস্মরণীয় ইতিহাসের দিকে?
আল্লাহ তা’য়ালা পিতা-পুত্রের এই কুরবানী কবুল করলেও বালক ইসমাঈলের জীবন কবুল করলেন না। বেহেশত থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিয়ে তাকে প্রাণমুক্ত করে পিতার কাছে ফিরিয়ে দেন।
কুরআনে বর্ণিত ভাষায়- ‘যখন তারা উভয়ে আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করল এবং তার পুত্রকে কাত করে যমীনে শায়িত করল, তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে! এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এ ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।
আমি তাকে পুত্র ইসমাঈলকে মুক্ত করলাম একটি কুরবানীর বিনিময়ে। আর আমি এটাকে ঈদুল আযহাতে কুরবানী করার রীতি প্রবর্তন করে পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি।
(সূরা সাফফাত: ১০৩- ১০৮)
আল্লাহ তায়ালা পিতাপুত্রের এই অসীম ত্যাগ ও আনুগত্যের চেতনাদীপ্ত শিক্ষাকে পৃথিবীর বুকে চিরন্তর করে রাখতে চাইলেন। যুগের ধারাবাহিকতায়
পশু কুরবানীকে মুসলিম উম্মাহের জন্য তাদের আত্মসমর্পনের শিক্ষা বানালেন।
কুরবানীর তাৎপর্য ও ফযীলত
এক হাদীসে আছে, সাহাবী হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, একবার সাহাবীগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! কুরবানীর রহস্য কী?
নবীজি বললেন, এটা তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সুন্নত।
তাঁরা বললেন, এতে আমাদের লাভ কী?
নবীজি বললেন, কুরবানী পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে তোমরা একটি করে নেকি পাবে।
তাঁরা পুনরায় বললেন; ছাগল-ভেড়ার পশমের বিধান কী?
নবীজি বললেন; এগুলোর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি পাবে!
কত বড় ফযীলতের কথা হাদিস শরীফে উল্লেখিত হয়েছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হিজরতের পর মদীনায় দশ বছর ছিলেন, সেখানে অবস্থানকালে প্রতিবছরই কুরবানী করতেন। ইন্তিকালের আগে হযরত আলি রাদিআল্লাহু আনহুর কাছে অসিয়ত করে গিয়েছিলেন, যাতে প্রতিবছর তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করা হয়। তাইতো নবীজির তিরোধানের পর প্রতিবার যখন কুরবানীর সময় আসতো তখন হযরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু দুটি ভেড়া জবাই করতেন। একটি ছিল স্বয়ং নিজের পক্ষ থেকে, অপরটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে।
প্রিয় মুসলিম বন্ধু! কুরবানীর ইতিহাস, রাসূলের হাদিস ও তাঁর সীরাত থেকে কুরবানীর ফযীলতের শিক্ষাটুকু আমাদের জীবনে ধারণ করি। সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা কুরবানী করে গরিব দুঃখিদের সাথে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দেই। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের কুরবানীসহ সকল নেক আমল কবুল করুন। আমিন।