আশা ও আনন্দের ঋতু বর্ষাকাল। গ্রীষ্মের শেষ তাপে যখন জনজীবনে চরম অস্বস্তি নেমে আসে তখন গ্রীষ্মের রং-রূপ আর দাপট বদলে দিয়ে চির উন্নত শিরে নির্ঝণীর স্রোত নিয়ে আবির্ভুত হয় বর্ষা। কাঁচা পাতার মাচা আর চাষীর বুকে স্বপ্ন-আশার দোলা দিয়ে আবহমান বাংলার রূপ-বৈচিত্র্যে বর্ষা ঋতুর আগমন বাস্তবতায় চিরস্বপ্নীল। নদীর জেলের ফেলে আসা দিন আর নৌকার রঙিন পালে নিত্য বাতাসের দোলা দিয়ে বর্ষাকাল শ্যামলিমার দুয়ারে কড়া নাড়ে।
আষাঢ়ের টানে শহুরে জীবনে আকাশচুম্বি দালানের ফাঁকে আর বাড়ির ছাদ ছুঁয়ে পাইপের ভেতর দিয়ে অঝোরধারায় বর্ষার দেখা পাওয়া যায়। হালকা বাতাস আর রাস্তায় যান চলাচলে নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে শহরের বর্ষা বয়ে চলে। ফলে দেখা মিলে না কোনো দিগন্ত বিস্তৃত বিল বা নালার। উদোম গায়ে খোকা-খুকুরা ঝাঁপ দিয়ে পড়ার মতো কোনো পুকুর বা বিল খুঁজে পায় না। অন্যদিকে কাকপক্ষী আর দু’একটি চড়ুই পাখি আধভেজা হলেও ছেলেমেয়েরা বৃষ্টিভেজাকে তেমন অনুভব করে না। আর তাই কিছু শূন্যতার মধ্য দিয়ে পূর্ণতার টানে শহুরে জীবনের অভিমানী বর্ষা ঋতুর সমাপ্তি ঘটে।
শ্রাবণের এ বৃষ্টি খেলায় ছোট্ট বালকের কাদা-মাটি নিয়ে মেতে থাকা আর বর্ষায় দস্যি ছেলের গাঁয়ের বাড়ির হিজল বনে দাঁড়িয়ে পত্র-পল্ল¬বের মগডালে বৃষ্টি ফোঁটার টুপটাপ শব্দ শোনার মজাই আলাদা। ভিন্ন আমেজে বর্ষাকে পেয়ে শান্ত চিত্ত হর্ষে উৎফূল্ল¬ হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই মনে পড়ে যায় হাই স্কুল জীবনের সেই চিরচেনা সংগীতÑ
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’
দিনভর টিনের চালায় রিমঝিম আওয়াজে মনের মতো ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার আনন্দ সহজে ভোলা যায় না। সারাদিন বৃষ্টি পড়ার ঝুম ঝুম আলাপন মনের ভেতর এক নতুন দৃশ্যের অবতারণা সৃষ্টি করে, বেজে ওঠে ভাটিয়ালী আর মিতালী সুরের নূপুর তানে। ফলে নদী, নালা, খাল-বিল, পুকুর, ডোবা কানায় কানায় টইটুম্বুর হয়ে যায়। ধরা পড়ে নানা প্রজাতির মাছ। বাড়ির পাশের শাপলা বিলে ঝুপঝাপ টুপটাপ মোহনীয় সুরের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। রাতে ব্যাঙ পরিবারের ঘ্যাঙ্গর ঘ্যাঙ্গর ডাক বর্ষা ঋতুকে বৈচিত্র্যের কয়েকগুণ উপরে পৌঁছে দেয়। এ ছাড়াও মেঘের গর্জনে একটানা বর্ষণে চারদিকের ভিটেমাটি ভিজে কাদায় পরিণত হয়ে বর্ষাতে চিরযৌবন এনে দেয়। ফলে নদী হয়ে ওঠে উত্তাল। ছোট নদীগুলো আপন গতি ঠিক রেখে সীমানায় থেকে আগবাড়িয়ে বেশি বহমান থাকলেও বড় বড় নদীগুলোর চাপে অতিষ্ঠ হয়ে যায় সাধারণ মানুষের জীবন। ভেসে যায় বেঁচে থাকার আশ্রয়স্থল বসত-ভিটে।
এ সামান্য অপকার বর্ষার কোনো দোষ বা অপরাধ নয়, বরং বর্ষাকে কেন্দ্র করে যে সব মানুষ নিজ স্বার্থে কৃত্রিম পানির আলাদা চাপ সৃষ্টি করে অপরাধ একমাত্র তাদেরই। বর্ষার এ চিরকীর্তি মুছে দেয়ার পেছনে মানুষের এ পরোক্ষ কার্যক্রমকে বর্ষার আগের ঋতুও চরমভাবে ঘৃণা করে। স্বার্থসিদ্ধির এ খেলাতে ঋতু যেমন প্রশ্নবিদ্ধ তেমনি মানুষও অসহায়। বর্ষা কারো ক্ষতি করতে আসে না বলে কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীরা বর্ষায়কে অত্যন্ত ভালোবাসেন এবং মন-প্রাণ উজাড় করে মূল্যয়ন করে থাকেন। বর্ষার মূল্যায়নে পাঠ্যবইয়ে ছড়াকারও এঁকে দিয়েছে গ্রাম বাংলার রূপসী ছড়ার রংধনু।
‘নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসরে ঘরের বাইরে।’
মেঘের কালো চাদরে দিনভর পরিবেশ স্বচ্ছ থাকলেও পরাধীন রয়ে যায়। না চাইলেও ভিজে যেতে হয়। ঘোরলাগা বর্ষণ থেকে গাছপালা তাদের নিজ নিজ দেহ শুকনো রাখতে না পারলেও পরিষ্কার থাকে সব সময়। মাঝেমধ্যে ভীষণ বাতাস আর ঝড় কচু পাতায় পানির ঝাপটা লেপন করে তার দম্ভ অহমিকাকে শেষ করে দেয়। অনেক সময় ফসলি জমিও পানির নিচে ডুবে যায়। মাঝেমধ্যে ধানের গোছা একটু-আধটু মাথা উঁচু করে হালকা বাতাসে দোলতে থাকে।
আমাদের দেশে যে তিনটি ঋতু বা মৌসুম বাংলার মানুষের মাঝে অন্যরকম দ্যোতনা সৃষ্টি করে তার মধ্যে অন্যতম হলো বর্ষাকাল। বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে ধুলোমাখা গাছগাছালি চিরসজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। দূরবর্তী দৃশ্যমান আকাশ ছোঁয়া মাটির বুকে রিমঝিম ঝরায় বৃষ্টিস্নাত কুয়াশার শুভ্রতা দেখতে পাওয়া যায়। শান্ত শীতল আর নির্মল হয়ে ওঠে গোটা পরিবেশ-পাড়া। বর্ষাজুড়ে বাড়ির আশপাশ ও নদীর তীরে হরেক রকম ফুল ফোটে। কেয়া, কামিনী, কদম, জুঁই, টগর, বেলী, চাঁপা ফুলের স্বর্গীয় সৌরভে বিমহিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি ও পরিবেশ। তখন মৌমাছির ঝাঁক উড়ে আসে। ওরা মধু সংগ্রহ করে। ফুলের সৌরভ উপভোগ করে। শান্ত পরিবেশের ছোঁয়ায় গুনগুন গুঞ্জরণে মৌ-ওলীরা পাপড়ির সাথে মিশে যায়। কদমে ঝরে সুইয়ের বৃষ্টি। রাতের বাগান হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ কোমল ও সৌরভময়।
ঋতুর চক্রে বছরের বারো মাসে মানুষের খাবার তালিকায়ও প্রাকৃতিক পরিবর্তন চলে আসে। ফলে বর্ষায় ফলমূলের মধ্যে আনারস, পেয়ারা, কলা, করলা, চালকুমড়া, মিঠাকুমড়া, ঝিঙা, করলাসহ নানান জাতের ফল-মূল উৎপন্ন হয়। আর এগুলো বর্ষার অন্যতম নিদর্শন আল্ল¬াহর নেয়ামত। কিন্তু কিছু দুষ্টু ব্যবসায়ী (আল্ল¬াহর এসব নেয়ামতকে) জোরপূর্বক দীর্ঘ মেয়াদ নিশ্চিত করতে কৃত্রিমভাবে তাজা রাখার জন্য সেগুলোতে বিষ ঢুকিয়ে টাকায় কেনা মৃত্যুর অনিবার্য অনুসঙ্গে পরিণত করে। তারপরও বর্ষার আগমনে এগুলোর চাহিদা কোনো অংশে কমে।
চারদিকে থইথই শব্দে লাফিয়ে ওঠা পানির আলাদা দাপট থাকে বলে এ সময় বাচ্চাদের পানি থেকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে শীত, সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন রোগ থেকে হেফাজত থাকার জন্য প্রয়োজন হয় সচেতনতা অবলম্বনের।
বর্ষার এ মধুময় ক্ষণে সোনালি আঁশ পাট আর ধান বুনে ঘরে তোলার ধুম পড়ে যায়। বিশেষ করে আউশ ধান এ বর্ষার নির্মল আবেশেই উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটও এ বর্ষাসৃজনের ভিন্ন আর্কষণ। সারাদিন পাটের মৌ মৌ গন্ধ আর টিনের চালে বর্ষার সুর নীরব মনে কাব্যের উচ্ছ্বাস তরঙ্গ সৃষ্টি করে। তনুমনে ছন্দের তাল-দোল খেয়ে যায়Ñ
বর্ষা এলে টাপুর টুপুর/ পড়ে সকাল বিকাল দুপুর/ বৃষ্টি ঝুমুর ঝুম
বৃষ্টি ঝরে সাত সকলে/ দিবস রাত্রী ঘরের চালে/ পুরায় তাতে ঘুম।
এ সময় কঠোর কোমলে, করলে-শ্যামলে, দৃশ্যে-অদৃশ্যে লীলাবৈচিত্র্যের মাঝে নিত্য আলাপন নিয়ে ভেকদলের সাড়া জাগে। আর তাই পুলকিত স্বচ্ছলতার প্রগাঢ় নিকুঞ্জ বাংলার এ অপূর্ব ঋতু বর্ষাকে কোনো অংশে অবমূল্যায়ন করা চলে না।
তাই বলতে হয় বর্ষা আমার গাঁয়ের স্মৃতিকে তাজা রাখতে সহায়তা করে। শৈশবের দিকে হারিয়ে যেতে উৎসাহ জোগায়। প্রতিটি বর্ষা একেকটি জীবন সমাপ্তির বার্তা। মানুষের জীবনের সাথে বর্ষাও হারিয়ে যায়। এ জন্য প্রতিটি বর্ষাকে মানুষের অতীত জীবনের হারিয়ে যাওয়ার অধ্যায় হিসেবে তুলনা করা চলে। পাওয়া না-পাওয়া আর বিষণ্নতার চাদরে জীবন সমাপ্তির অনেক সন্ধ্যা বর্ষার মতো এভাবে গত হয়ে যায়! তাই বর্ষাকে শুধু বর্ষা হিসেবে চিত্রায়ন না করে মানব জীবনের বর্ণিল অধ্যায় হিসেবেও মূল্যায়ন করা বর্ষার চির-স্বার্থকতা। আমাদের জীবনের প্রতিটি অভিমানী বর্ষা হয়ে উঠুক পরিবেশ ও জীবন সাজানোর নতুনধারায় উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ। চিত্রশৈলীর বর্ণনাধারায় হয়ে উঠুক চির ভাষ্কর।
