গানেরপাখি মাহফুজুল আলম রহ.- জিয়াউল আশরাফ

গানেরপাখি মাহফুজুল আলম রহ.- জিয়াউল আশরাফ

“যদি আঁধারের ঘনঘটা বেড়েই চলে খুব
যদি কামনার নদীটাতে দিয়েই ফেলি ডুব
যদি পথ ভুলে অলক্ষ্যে হেঁটে চলি বহু দূর
ক্লান্ত হৃদয়ে ঢেলে দিও তব নূর
ওপ্রভু ক্লান্ত হৃদয়ে ঢেলে দিও তব নূর”
গানের পাখি-প্রিয় মাহফুজের কণ্ঠে গাওয়া শেষ গান। সে আর কখনো গান করবে না। কন্ঠে সুর তুলবে না নতুন করে। মঞ্চে-কিংবা মাহফিলে-ইউটিউবে আর কখনোই নতুন করে মাহফুজকে দেখবো না। ফেইসবুকে লিখবে না দারুন দারুন স্টেটাস। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় দেখা যাবে না। সরল-মিষ্টি হাসির মাহফুজ থাকবে শুধু হৃদয়ে হৃদয়ে। মনের ক্যানভাসে ভেসে বেড়াবে মাহফুজের হাজারো স্মৃতি।
হ্যাঁ বন্ধুরা! আমি গানের পাখি, কলরবের জনপ্রিয় শিল্পী মাহফুজুল আলমের কথাই বলছি। আমাদের এই ছোট্ট বন্ধুটি মেহমান হয়েছেন মহান আল্লাহর। আল্লাহ তাঁর প্রিয়কে প্রিয় করে কাছে নিয়ে গেছেন।
মাহফুজকে নিয়ে স্মৃতি লিখতে কলম চলে না। বারবার থেমে যায়। দুচোখে অশ্রু নেমে আসে। মাহফুজ সেদিনের সেই ছোট্ট শিশু! আজ আমাদের মাঝে নেই।
বিশ জুলাই সকালে মাহফুজ ইন্তেকাল করে। সেদিন ফজর পড়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। নয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠি। মোবাইল হাতে নিয়ে ফেইসবুকে প্রথম যে সংবাদ তাতে লেখা
“কলরবের জনপ্রিয় শিল্পী মাহফুজ আর নেই।”
আৎকে উঠি! বিশ্বাস করতে পারি না। কিন্তু সবাই একি সংবাদ দিচ্ছে!! দুচোখ বেয়ে একটু অশ্রু নেমে আসে। আপন ভাই না হলেও কেমন যেন আপন ভাই হারানোর বেদনায় মনটা কেঁদে ওঠে।
তখনো ভাবছিলাম-কলরবের বদরুজ্জামান ভাই, সাঈদ কিংবা আবু রায়হান কেউ এসে বলবে-মাহফুজ বেঁচে আছে! কেউ গুজবে কান দিবেন না! এমনই কতগুজব সংবাদ হয়ে আমাদের কাছে এসেছে। কিন্তু এবার তা হলো না। ওরাও সংবাদ দিয়েদিলো।
অনলাইন জুড়ে শুধু-মাহফুজ নেই!
প্রিয় মাহফুজ নেই!
গানের পাখি নেই!
প্রিয় শিল্পী নেই!
ফেইসবুক জুড়ে আর কিছুই চোখে পড়ে না। শুধু মাহফুজ।
মাহফুজ কতটা প্রিয়, স্নেহের-ভালোবাসার তা আজ প্রমাণিত। সরল-নিরব, শান্ত শুধু একটু মিষ্টি হাসি দিয়ে মানুষের হৃদয়ে কতবড় স্থান করে নেয়া যায় তার উদাহরণ আমাদের মাহফুজ।
আমি ছোটদেরকে পিচ্চি বলতে আনন্দবোধ করি। মাহফুজকেও পিচ্চি বলতাম। ও যখন খুব ছোট তখন ঢাকায় আসে। আবু রায়হানের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। জামালপুরে কোনো অনুষ্ঠান বা মাহফিল থাকলে রায়হানকে মাঝে মধ্যে নিয়ে যেতাম। কিন্তু মাহফুজ বেশি ছোট হওয়ায় ওকে নিতে পারিনি। তবে জামালপুরে মাহফুজ গিয়েছে যখন পুরো কলরব গিয়েছে। সেই ছোট্ট মাহফুজের কণ্ঠ, গানের সুরশুনে তখন মনে মনে ভাবতাম ও আবু রায়হানকেও ছাড়িয়ে যাবে। আবু রায়হান একটু বড় হওয়ারপর আবু রায়হানের জায়গাটা মাহফুজের দখলে চলে আসে।
পল্টনে দেখা হতো। মিষ্টি হাসি দিয়ে কাছে এসে জিজ্ঞেস করতো ভাইয়া কেমন আছেন? দু’চারটি কথা হতো। চুপচাপ থাকতে ভালোবাসতো। বড়দের সামনে আগ বাড়িয়ে কখনো কথা বলতো না।
গতবছর ওর আব্বা মারা যান। এতো অল্প বয়সে বাবা হারানোর কষ্টটা আমিও বুঝি। বড় কষ্টই হয়তো পেয়েছিলো মাহফুজ! যে বাবা মাহফুজকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন- যে বাবার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে চলতো মাহফুজ। হঠাৎ করেই যদি বাবা হারিয়ে যায় তখন কষ্টরা মনের মাঝে ভিড় করবেই। সেই কষ্ট একপাশে রেখে কয়েকটি গানের কাজ করতে না করতেই তাকে চলে যেতে হলো। মাহফুজের মনে কী ধারনা ছিলো আমাদের জানা নেই। কিন্তু মাহফুজকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। ছোট্ট মাহফুজ একদিন আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ. এর মতো হবে। সংগীতে, বয়ানে, রাজনৈতিক মিছিলে সর্ববত্রই ওর কণ্ঠ কাজ করবে দাওয়াতের মিশনে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। কিন্তু মৃত্যু এমন এক সত্য যা কার জন্য কখন আসবে তা কেউ বলতে পারে না। “এই তো জীবন আজ আছি কাল নেই পরশু হবেরে মরন।”
সন্তান তার বাবাকে ভালোবাসে এটাই নিয়ম। মাহফুজও ভালোবাসতো ওর বাবাকে। বাবার বুকে ঘুম পৃথিবীর নিরাপদ ঘুম। সেই প্রিয় বাবাকে হারিয়ে মাহফুজ যেমন কেঁদেছিলো বাবাকে নিয়ে গাওয়া তার গানে আমাদেরকেও কাঁদিয়েছে……
বাবাকে নিয়ে গাওয়া গান……………..
তোমার গায়ে হাত না রেখে ঘুম হতো না আমার
তোমায় দেখে হৃদয় থেকে দূর হতো সব আঁধার।
তুমি আমার প্রথম গুরু তোমার কাছেই দীক্ষা শুরু
তুমি ছাড়া বুঝতো না কেউ মান অভিমান আমার।
আমায় নিয়ে আমার বাবার স্বপ্ন ছিলো বড়
বলেছিলেন জীবনটাকে ফুলের মতো গড়।
বাংলার কিংবদন্তী শিল্পী-আধুনিক ইসলামী সংগীতের রূপকার আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.। মাহফুজরা তারই শিষ্য। আইনুদ্দীন ভাই জীবনের শেষ দিকে যে গানগুলো গাইলেন তার একটি “পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে”কাকতালীও ভাবে সেই গানটি মাহফুজও নতুন করে গাইলো।
“পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে
কত ঢেউ চলে যায় আসে না তো ফিরে
তেমনি আমিও হারিয়ে যাবো
আসবো না কভু ফিরে”।
মাহফুজ কি জানতে পেরেছিলো সে চলে যাবে? চলে যাবে তার প্রভুর কাছে! সবুজ শ্যামল সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে সে যাবে জান্নাতের পাখি হয়ে! তাই সে কণ্ঠ দিলো…
“ডেকে নিবে যেদিন আমারে
তোমার প্রিয় করে নিও
হায়াতের দিন ফুরালে
খাতেমা ঈমান মোরে দিও।
ওআল্লাহ…….আল্লাহ
কালিমা নসিব মোর দিও”।
হ্যাঁ- মাহফুজখাতেমা ঈমান পেয়েছে। কালিমা নসীব হয়েছে। মায়ের বুকে মাথা রেখে ওবলতে পেরেছে মা! আমাকে কালিমা পড়াও! তার প্রিয় মা কালিমা পড়েছে-কালিমা পড়েছে আমাদের মাহফুজ। মায়ের হাতে মাথা রেখে মায়ের সাথে কালিমা পড়ে পড়ে মৃত্যু! এরচে সুন্দর-খুশ নসীব আর কি হতে পারে! মাহফুজকে আল্লাহ সেই পরম সৌভাগ্য দান করেছেন।

মাহফুজ আজ নেই। আমাদের প্রিয় মাহফুজ নিশ্চয় আল্লাহরও প্রিয়। আমরা দুআ করি মাহফুজের ভুলগুলো ক্ষমা করে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। তার কবরকে জান্নাতের ফুলের বিছানা করে দিন, জান্নাতের সাথে তার কবরের দরজা খুলে যাক।
মাহফুজ বেঁচে থাকুক আমাদের হৃদয়ে, তার গানের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত, ইসলামের কথা, আল্লাহর মহত্ব প্রচার হোক যুগযুগ ধরে। সুর সংগীতের মাহফুজ বেচে থাকুক সবার হৃদয়রাজ্যে।
মাহফুজ!
প্রিয় মাহফুজ!
গানের পাখি মাহফুজ!
আমরা বিশ্বাস করি তোমাকে জান্নাতে দেখা পাবো! আমরা আবারো বসাবো সংগীতের আসর! তোমার সংগীতে মুগ্ধ হবো আমরা। মুগ্ধ হবে জান্নাতি! জান্নাতের সব হুর গিলমান।

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য

দুঃখিত! এই বিভাগের অন্য কোনো পোস্ট নেই।