শরৎসুন্দর বাংলাদেশ- আহমেদ রিয়াজ

শরৎসুন্দর বাংলাদেশ- আহমেদ রিয়াজ

রাতের অন্ধকার ছেড়ে হুট করেই শুরু হয় দিনের আলো। আর যদি সেটা শরতের ভোর হয়, তাহলে তো কথাই নেই। আকাশে সাদা সাদা মেঘ ভাসতে থাকে। আর সেই সাদা মেঘে সূর্যের আলো পড়ে আকাশটা অসাধারণ রঙিন হয়ে ওঠে। জমিনও সেই রঙিন আলোর ভাগ কিছুটা হলেও পায়। তেমনি আলোয় মসজিদ থেকে বেরোল ওরা। ইয়াসিন, ইবরাহিম আর জহির উদ্দিন।
কিছুটা এগোতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় জহির উদ্দিন। একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গাছের তলায় পড়ে থাকা ফুলের দিকে তাকায়।
ততক্ষণে ইবরাহিমও অবাক হয়ে দেখতে থাকে ফুলগুলো। ‘কী ফুল এগুলো?’
ইয়াসিন মুচকি হেসে বলল, ‘এ তো শিউলি! শিউলি ফুল চেনো না? শিউলি ফুলকে শেফালি ফুলও বলে।’
ইবরাহিম বলল, ‘কী করে চিনব! অস্ট্রেলিয়ায় তো এ ফুল নেই।’
ইবরাহিম অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।
জহির উদ্দিন বলল, ‘আমেরিকাতেও নেই।’
জহির
…উদ্দিন থাকে যুক্তরাষ্ট্র। দুজনই ইয়াসিনের চাচাতো ভাই।
ইয়াসিন বলল, ‘শিউলি ফুল দেখলেই বোঝা যায়, শরৎ শুরু হয়েছে।’
আবারও অবাক হলো জহির উদ্দিন আর ইবরাহিম, ‘শরৎ!’
ইয়াসিন বলল, ‘শরৎও চেনো না? শরৎকাল। ইংরেজিতে বলে অটাম। আমেরিকায় বলে ফল।’
এবার মাথা নাড়ল দুজন। ইবরাহিম বলল, ‘এখন শরৎকাল চলছে!’
মাথা নাড়ল ইয়াসিন। ‘হুঁ’।
এবার আরো অবাক হয়ে বলল ইবরাহিম, ‘কিন্তু দেখে তো মনে হয় না।’
জহির উদ্দিনও তাল মেলালও, ‘আমারও মনে হচ্ছে না, এখন শরৎকাল চলছে।’
গলায় একটু উষ্মা মেখে জানতে চাইল ইয়াসিন, ‘কেন মনে হয় না শুনি?’
জহির উদ্দিন বলল, ‘আমেরকিায় শরৎকাল মানেই রঙের খেলা। শীত আর গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়টা ওখানে শরৎকাল। শরৎকালে দিন ছোট আর রাত বড় হতে শুরু করে। আর গাছের পাতাদের কথা কী বলব রে ভাই! গাছের পাতারা যে কত রঙিন হতে পারে, ওখানকার শরৎ না দেখলে বোঝা যাবে না। হলুদ, লাল, কমলা-কত রঙ! মনে হয় যেন কোনো আঁকিয়ে তুলি দিয়ে গাছগুলোতে রং মেখে দিয়েছেন। প্রকৃতি যখন অমন রঙিন হয়, মানুষের মনও রঙিন হয়ে ওঠে। শুরু হয় উৎসব। শরতের মতো এতো উৎসব আর অন্য কোনো সময় হয় না।’
বলেই থামল জহির উদ্দিন। এবার সুযোগ পেয়ে ইবরাহিম বলল, ‘অস্ট্রেলিয়ায় তিন মাস শরৎকাল। মার্চ, এপ্রিল আর মে। ওখানেও শরতে গাছগুলোর পাতা রঙিন হয়ে ওঠে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে একটি এলাকা আছে। নাম অরেঞ্জ। শরৎকালে ওই অরেঞ্জ এলাকার গাছপালা তো বটেই, রাস্তা-ঘাটও রঙিন হয়ে ওঠে। অরেঞ্জকে অস্ট্রেলিয়ানরা ডাকে কালার সিটি বা রঙিন শহর নামে। শরতে অরেঞ্জ সিটির সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকরা ভিড় জমায়। আমরাও গিয়েছি।’
ইয়াসিন বলল, ‘বুঝেছি। ইউরোপের শরৎকালও ঠিক এরকম। তার মানে ইউরোপ, আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ার শরতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের এখানে যেমন বর্ষাকালে সবচেয়ে বৃষ্টি হয়, তেমনি শরৎকালে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। কারণ ওদের দেশে তো আর বর্ষাকাল নেই।’
প্রবাসী দুভাই মাথা নেড়ে সায় জানাল, ‘ঠিক তাই। তবে ইউরোপ, আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ার শরৎ কিন্তু খুবই রঙিন। এমনকি শরৎকালে চীন-জাপানও নানা রঙে সাজগোজ করে। অবশ্য ওখানে শরৎ শুরু হয় সেপ্টেম্বরে। মানে বাংলাদেশের এক মাস পরে। তবে ওসব দেশের শরৎ বাংলাদেশের মতো এতটা সাদামাটা নয়। একবার নিজের চোখে দেখলে বুঝতে…’
বাকিটা আর শোনার ইচ্ছে নেই ইয়াসিনের। ইয়াসিন বরং শিউলি ফুল কুড়াতে শুরু করল। বলল, ‘আমার ছোটবোনকে দেবো। কী সুন্দর মালা গেঁথে দেবে, দেখিস!’
ইয়াসিনের দেখাদেখি জহির উদ্দিন আর ইবরাহিমও শিউলি ফুল কুড়াতে শুরু করল। আর তখনই হঠাৎ…
শিউলি গাছের কাÐ ধরে ভীষণ জোরে একটা ঝাঁকুনি দিল ইয়াসিন। আর অমনি…
গাছের পাতা, ডাল-পালায়, কিংবা বোঁটায় আলতো হয়ে আটকে ছিল অনেক অনেক শিউলি ফুল। ঝাঁকুনি খেয়ে ঝুর ঝুর করে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ল সব।
মুগ্ধ হয়ে গেল জহির উদ্দিন আর ইবরাহিম। এটা কী হলো!
মুচকি হেসে ইয়াসিন বলল, ‘ফুলবৃষ্টি। নিশ্চয়ই অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকায় এমন ফুলবৃষ্টি হয় না?’
এবার দুজনই মাথা দুলিয়ে বলল, ‘কখখনো না।’

২.
বাড়ি ফিরতেই বাবার হালকা বকুনি খেল ইয়াসিন। ‘কোথায় ছিলি এতক্ষণ?’
জানতে চাইল ইয়াসিন, ‘কেন?’
মা বললেন, ‘আমরা এক্ষুণি গ্রামের বাড়িতে যাবো। তোর চাচা-চাচিরা এসেছেন অনেকদিন পর। সবাই একসঙ্গে গ্রামে যাওয়ার এই তো সুযোগ। টেবিলে নাশতা দেওয়া আছে, শিগগির খেয়ে তৈরি হয়ে নে।’
খুব খুশি লাগছে ইয়াসিনের। সবাই মিলে গ্রামে যাওয়ার মজাই অন্যরকম। খুশির চোটে নাশতাও খেতে পারল না ঠিক মতো।
কোনো রকমে নাশতা সেরে গাড়িতে গিয়ে উঠল সবাই। বড়সড় একটা মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে। এতে আরো খুশি হলো ইয়াসিন। নিজেদের মতো করে ধীরে সুস্থে গ্রামে যেতে পারবে। যেখানে ইচ্ছে সেখানে গাড়ি থামিয়ে চা-বিস্কুট খেতে পারবে। আর এত কিছুর পরেও, যেতে সময়ও লাগবে কম। আহা! ওর চাচাতো ভাইগুলোকে নিয়ে চাচা-চাচিরা প্রতি বছর কেন বাংলাদেশে আসেন না? তাহলে তো ও প্রতি বছরই এরকম বেড়িয়ে আসতে পারত!

৩.
পথে কোনো ঝামেলা ছাড়াই দুপুরের আগেই গ্রামে চলে এসেছে ওরা। আগেই বড় চাচাকে জানিয়ে রেখেছিলেন বাবা। গ্রামে আজ বাবারা চার ভাই একসঙ্গে হবেন-অনেক বছর পর।
বড়চাচা খুব সুন্দর বাড়ি করেছেন। ওদিকে একটা কাচারি ঘরও আছে। ইয়াসিন আগেই বলে রেখেছে-রাতে চাচাতো ভাইদের নিয়ে কাচারি ঘরে থাকবে ও।
দুুপুরে খেয়েদেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিল সবাই। কিন্তু ইয়াসিন, জহির উদ্দিন আর ইবরাহিম উসখুশ করতে লাগল। গ্রামে এসে চুপচাপ ঘরে বসে থাকা যায়? ওদিকে সাদা মেঘগুলো সেই কখন থেকে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে!
ইয়াসিন হাঁক দিল, ‘চলো, তোমাদের কিছু মজার জিনিস দেখাবো।’
হইহই করে ওঠল আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী দুভাই। চটপট বেরিয়ে পড়ল বাইরে।
ভাদ্র মাসটা তখন কেবল অর্ধেক সময় পেরিয়েছে। গরম কমেনি। বাড়ি থেকে মাটির কাঁচা রাস্তায় উঠতেই জহিরউদ্দিন আর্তনাদ করে উঠল, ‘হাউ হট!’
ইয়াসিন হাসতে হাসতে বলল, ‘হুম। একটু গরম অবশ্য আছে। এ গরমের একটা নামও আছে।’
অবাক হলো ইবরাহিম, ‘গরমের আবার নাম হয় নাকি?’
‘হয় তো!’
‘আগে কখনো শুনিনি। অস্ট্রেলিয়াও গরম দেশ। শুনেছি অস্ট্রেলিয়ার অনেক জায়গা বাংলাদেশ থেকেও বেশি গরম। কিন্তু গরমের নামকরণ কেউ করেছে বলে তো জানি না।’
ইয়াসিন মুচকি হেসে বলল, ‘তোমরা তো আর বাংলাদেশ দেখনি। একটা দেশকে পুরো দেখতে চাইলে সবগুলো ঋতু উপভোগ করতে হয়। এই যেমন বাংলাদেশের মতো ছয়টি ঋতু আর কোথায় আছে? তোমরা তো দেখ কেবল তিনটা কি চারটা ঋতু।’
জহিরউদ্দিন বলল, ‘গরমের নামকরণ নিয়ে কী যেন বলছিলে?’
ইয়াসিন বলল, ‘গ্রীষ্মকালের গরমকে আমরা নাম দিয়েছি আমপাকা গরম। জ্যৈষ্ঠমাসের গরমের নাম কাঁঠালপাকা গরম। কেউ কেউ লিচুপাকা গরমও বলে। আর এখন যে গরমটা পড়ছে, এ গরমের নাম তালপাকা গরম।’
আবারো অবাক হলো দুজন, ‘তালপাকা! তাল কী জিনিস?’
বলতে না বলতেই ধুপ!
কাঁচা মাটির রাস্তার দুপাশে বেশ কয়েকটা তালগাছ। গাছে পাকা তাল ঝুলে আছে। হঠাৎ একটা গাছ থেকে পড়ল একটা পাকা তাল। একেই বলে কপাল। নইলে তালের কথা উঠল আর তখনই কেন তাল পড়বে!
তালটা হাতে নিল ইয়াসিন। পাকা তালের সুবাস ওর খুব ভালো লাগে। জহির উদ্দিনেরও মনে হয় প্রিয়। পাকা তাল হাতে নিয়ে জহিরউদ্দিন বলল, ‘ভেরি সুইট ফ্রেগরেন্স! খেতেও নিশ্চয়ই অনেক মজা! আর অনেক মিষ্টি!’
ইয়াসিন বলল, ‘খেতে মজা তবে মিষ্টি কিনা জানি না।’
ইবরাহিম বলল, ‘হুম। মিষ্টি হলেই মজা হয় না। আবার মজা হলেই মিষ্টি হয় না। বুঝেছ!’
ইয়াসিন বলল, ‘একদম ঠিক কথা। তোমাদের পাকা তালের পিঠা খাওয়াবো।’
এর আগেও বেশ কয়েকবার গ্রামের বাড়িতে এসেছে ইয়াসিন। তবে শরৎকালে আসেনি। একবার হেমন্তে এসেছিল। মনে পড়েছে ওর। ছাতিম ফুলের গন্ধ ওকে অসম্ভব মুগ্ধ করেছিল। আর মুগ্ধ করেছিল মাঠজুড়ে পাকা ধানের দুলুনি। মাঠের দিকে তাকাল ইয়াসিন। আর দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ।
জহিরউদ্দিন আর ইবরাহিমও দাঁড়িয়ে গেল। ইয়াসিনের মতো ওরাও তাকিয়ে রইল সামনে। আর মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল…
তখন জোর বাতাস বইছিল। একবারের জন্যও বাতাস থামছিল না। কখনো একটু বেশি জোরে, কখনো আরেকটু কম জোরে। কখনো দমকা, কখনো ঝড়ের মতো। আর সেই বাতাস এসে দোলা দিচ্ছি মাঠে। বিস্তীর্ন মাঠ। সে মাঠে তখন ধানগাছ। উঁচু উঁচু ধানগাছ। তখনও ধানের কলি গজায়নি। তবে গাছগুলো একেবারে তরুণ, তরতাজা, সবুজ। বাতাসের দোলায় ধানখেতে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। সমুদ্রের মতো বিশাল বিশাল ঢেউ। পার্থক্য কেবল এটুকুই, সাগরের ঢেউয়ে গর্জন আছে, কিন্তু এ সবুজ ঢেউয়ে নেই কোনো গর্জন। কেবল ঝিরঝির শব্দ তুলছিল ঢেউগুলো। ধানের পাতায় পাতায় ঘষা লেগে তৈরি হচ্ছিল সে শব্দ। ধানসাগরের ঢেউ আর শব্দে অনেকক্ষণ মুগ্ধ হয়ে রইল ওরা। প্রবাসী দুভাই এতই তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে, ইয়াসিনের ডাক শুনে ওদের ঘোর কাটল।
ইয়াসিন বলল, শরতের এই রূপ দেখেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
‘আজ ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।’
তারপর দুভাইকে বুঝিয়ে বলল। সঙ্গে সঙ্গে ওরা আকাশের দিকে তাকাল। হুম! ঠিক তাই। আকাশে সাদা মেঘেরা ভেলার মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছে। শরৎ নিয়ে এরকম লেখা আছে জেনে ওরা আরো মুগ্ধ।
হঠাৎ তাড়া দিল ইয়াসিন, ‘চলো চলো। বিকেল হয়ে এসেছে। আরো সুন্দর জিনিস দেখাবো।’
তারপর সেই সরু পথটি ধরে আবারও হাঁটতে লাগল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে একসময় চলে এলো নদীর পারে। আর নদীর পারে এসেই, আরেকবার মুগ্ধ চোখে তাকাল। কোথায় তাকাল?
কাশফুলদের দিকে।
কাশফুলেরা তখন বিকেলের সোনা রোদ পেয়ে নিজেরাও সোনালি হয়ে উঠেছে। আর নদী থেকে আসা বাতাসে দোল খাচ্ছে। এ ওর গায়ের উপর পড়ছে, ও পড়ছে পাশের কাশফুলের উপর। পাশেই কুল কুল করে বয়ে গেছে দুরন্ত নদী। স্বচ্ছ পানি। বর্ষার শেষে শরতের এই সময় নদীর পানি থাকে সবচেয়ে স্বচ্ছ।
ইয়াসিন বলল, ‘আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই কাশফুল নিয়ে কী লিখেছেন জানো?’
‘কী?’
‘কাশফুল মনে সাদা শিহরন জাগায়, মন বলে কত সুন্দর প্রকৃতি, ¯্রষ্টার কি অপার সৃষ্টি…’
কাশফুল বনে ওরা ঘুরে বেড়াল কিছুক্ষণ। তারপর ফিরতি পথ ধরল। ততক্ষণে সন্ধে হয়ে গিয়েছে। বিকেলে যাওয়ার পথে যে মসজিদে আসর নামাজ পড়েছিল, ওখানেই মাগরীবের নামাজ পড়ে নিল। তারপর আবার নেমে এলো সেই মেঠো সরু পথে। রাস্তায় সড়কবাতির বিরক্তি নেই। মেঠো পথটাই আবছা আলো হয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ওদের। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ মেঠোপথটা আলোয় ঝলমল করে উঠল।
আকাশের দিকে তাকাল ওরা। আরে! এ যে আকাশ ভরা চাঁদের আলো। জমিনেও নেমে এসেছে সেই আলো। শরতের আকাশে পূর্ণিমা! কিছুক্ষণ প্রাণভরে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে নিল ওরা। তারপর গায়ে জোছনা মেখে আবার হাঁটতে শুরু করল।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ইয়াসিনের বুকটা দুরু দুরু করে উঠল। অনেকক্ষণ হয় বাড়ির বাইরে ওরা। বাড়ি ফিরলে মায়ের বকুনি থেকে রেহাই নেই।
বাড়িতে ঢোকার আগে ফিসফিস করে ইয়াসিন বলল, ‘কাল সকাল তোমাদের আরেকটা মজার জিনিস দেখাব!’

৪.
তখনও সূর্য ওঠেনি। তবে পুব আকাশে উঁকি দেওয়ার আগেই ডানা মেলে দিয়েছে সোনালি রোদ। সে রোদের রং তখন জমিন অব্দি আসেনি। আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘেরা সে রং মেখে রঙিন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবারও সেই মেঠো পথে পা বাড়াল ওরা তিনজন। পথের পাশে দুর্বাঘাস। সারারাত শিশির পড়েছে। ঘাসগুলো শিশিরে গোসল করেছে সারারাত। কারোর গা থেকে সবটুকু শিশির তখনো ঝরেনি। এক বিন্দু কিংবা দু’বিন্দু করে শিশির তখনো জমেছিল প্রতিটা ঘাসের গায়ে। রোদ পড়ে সেই শিশিরবিন্দু যেন আর মামুলি শিশিরবিন্দু নেই, একেকটা শিশিরবিন্দু তখন হয়ে উঠেছে মুক্তোদানা।
পা থেকে জুতো খুলে হাতে নিল ইয়াসিন। তারপর সেই মুক্তোদানা মাড়িয়ে মাড়িয়ে চলতে লাগল। ওর দেখাদেখি জহির উদ্দিন আর ইবরাহিমও শিশিরে পা ধুয়ে নিচ্ছে।
জহির উদ্দিন খুশিতে ডগমগ, ‘কী দারুণ!’
ততক্ষণে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাটি মনে পড়ে গেল ইয়াসিনের। আর মনে পড়তেই গুনগুন করে ওঠলÑ
‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে।
দলি শাপলা শালুক শত দল এসো রাঙায়ে তোমার পদতল
নীল লাল ঝরায়ে ঢলঢল এসো অরণ্য পর্বতে।’
হঠাৎ কিছু একটা যেন মনে পড়ল ইয়াসিনের। চেঁচিয়ে ওঠল, ‘আরো দারুণ কিছু দেখবে?’
হইহই করে উঠল দুভাই। ‘দেখব। দেখব। কোথায়?’
আজ আসার আগে মাকে বলেই বেরিয়েছে ইয়াসিন। দুভাইকে নিয়ে বতুয়া বিলে যাবে। কিছুটা দেরি হতে পারে। কাল সন্ধের মতো বকা খাওয়ার আতঙ্কে আর থাকতে চায় না।
দুপাশ দেখতে দেখতে বতুয়া বিলের পথে চলতে লাগল ওরা। সবুজ চারপাশ! শরতে যেখানে দুনিয়ার প্রায় বেশিরভাগ দেশ নানান রঙে রঙিন হয়ে ওঠে, সেখানে শরতেও এ দেশ এত সবুজ থাকে কী করে! অবাক ব্যপার! তবে নানান রঙে রঙিন হওয়া মানে, পাতাদের আয়ু শেষ। পাতা ঝরাও শুরু হয়ে যায় ওসব দেশে। তাই তো শরৎকে ওরা বলে পতন। ইংরেজিতে ফল। তারপর পাতা ঝরতে ঝরতে গাছাপালাগুলো হয়ে যায় একেবারে ন্যাড়া। একটা পাতাও থাকে না। দীর্ঘ শীতে সারা গা জুড়ে থাকে কেবল বরফ। কাজেই ওখানে শরৎ মানেই দুঃখ দিনের আগমন বার্তা। এদিকে বাংলাদেশের শরৎ মানে হেমন্তের আগমন বার্তা। আর হেমন্ত মানেই ফসল, প্রাচুর্য, সম্পদ। কাজেই শরৎ এখানে দুঃখের নয়, খুশির।
ইবরাহিম বলল, ‘বাংলাদেশের শরৎ সাদা আর সাদা।’
জহির উদ্দিনও মাথা নাড়ল, ‘ঠিক বলেছ। আকাশে সাদা মেঘ। সাদা কাশফুল। সাদা শিউলি…’
ইয়াসিন বলল, ‘সাদা তো শুভ্রতার প্রতীক।’
‘তা ঠিক। কিন্তু সাদা মানেই তো কিছুটা হলেও সাদামাটা।’
ইয়াসিন বলল, ‘মোটেই সাদামাটা নয়। শরতে আরো কিছু ফুল ফোটে! পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কামিনি, মালতি, মল্লিকা, মাধবী, বড়ই ফুল, হিমঝুরি, গগনশিরীষ, পাখিফুল, বকফুলÑ শেষ নেই। শুধু ফুল নয়, নানান ফলও হয় এসময়। যদিও বেশিরভাগই অপ্রচলিত ফল। তাল ছাড়াও জলপাই, জগডুমুর, অরবরই, আমলকী, চালতা, ডেউয়া, করমচা, টেপাফল, জাম্বুরা-কত ফল! তাহলে শরৎ সাদামাটা হলো কী করে?’
আপত্তি জানাল জহির উদ্দিন, ‘না মানে, রঙের দিক দিয়ে। সাদার ছড়াছড়ি।’
জহির উদ্দিনের কথায় ইবরাহিমও মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল। তবু কিছু বলল না ইয়াসিন।
একসময় বতুয়া বিলে পৌঁছে যায় ওরা। বিল মানে বিশাল জলাশয়। লেক। এসব বলে এসেছে ইয়াসিন। কিন্তু বতুয়া বিলে এসে অবাক হয়ে গেল ও। কোথায় পানি? কোথায় বিল?
ওই তো চোখের সামনে বিল। কিন্তু বিলের পানি দেখা যাচ্ছে না। কী করে যাবে? পুরো বিলে শাপলা আর শাপলা। নীল শাপলা, লাল শাপলা, সাদা শাপলা। একই বিলে নানা রকম শাপলা সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু বতুয়ার বিল বলে কথা!
চোখের সামনে নানা রঙের শাপলা। সেই শাপলা দেখে জহির উদ্দিন আর ইবরাহিম যেন থমকে গেল। মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল। ইয়াসিন বলল, ‘নীল শাপলা ফুলের সুন্দর একটা নাম আছে। নীল কমল। আর লাল শাপলা ফুল হলো রক্ত কমল।’
বাহ! কী সুন্দর নাম! নাম শুনে আরো মুগ্ধ ওরা। ইয়াসিন বলল, ‘আর ওই যে সাদা শাপলা-ওটা আমাদের জাতীয় ফুল।’
জহিরউদ্দিন বলল, ‘আমি জানি।’
ইবরাহিম বলল, ‘আমিও জানি। বিদেশে থাকি বলে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল কোনটা জানব না?’
ইয়াসিন জানাল, ‘শাপলা খেতে কিন্তু দারুণ মজা। সবজি হিসেবে শাপলার কান্ড খুব জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, একেবারে পুরো ফোটা শাপলা ফুলের ভিতরে গুড়ি গুড়ি বীজ থাকে। আঠালো। এই বীজ ভাজলে এক ধরনে খই হয়। অনেকে সে খই খায়। সে খইয়ের নাম ‘ঢ্যাপের খই’। আর এই শাপলাদের দেখে কী মনে হয় জানো?’
‘কী?’
‘শরৎকালে আমাদের দেশের প্রকৃতিতে রঙের কারুকাজ আছে। সবটাই সাদা নয়। এবং সবমিলিয়ে মোটেও সাদামাটা নয়।’
এবার কয়েকবার মাথা নাড়ল দুজন। ঠিক। ঠিক। সত্যিই বাংলাদেশের শরৎ অনেক অনেক সুন্দর। দুনিয়ার যে কোনো দেশের চেয়ে সুন্দর।

শরতের মজার কিছু তথ্য:

কিছু গবেষণায় দেখে গেছে শরতে যাদের জন্ম, তারা অন্য সময়ে জন্ম নেওয়াদের চেয়ে বেশিদিন বাঁচে।

শরতে কাঠবিড়ালদের খাবারের জন্য ছুটোছুটি বেড়ে যায়। শীতের জন্য খাবার জমানো শুরু করে দেয় ওরা।

শরতে জন্ম নেওয়া শিশুদের বেশিরভাগই নাকি অনেক কিছুতে তুখোড় হয়। যেমন লেখাপড়া, খেলাধুলা ইত্যাদি। লম্বায়ও তারা বেশি হয়।

শরতের অর্থনৈতিক গুরুত্বও অনেক। এ সময় মানুষের ঘোরাঘুরি বেড়ে যায়। আর এ সময় ঘোরাঘুরি অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে খরচ কিছুটা কমও হয়।

মনার্ক বাটারফ্লাই বা মনার্ক প্রজাপতি নামে এক ধরনের প্রজাপতি হচ্ছে দুনিয়ার অন্যতম দেশান্তরি বা অভিযোজিত পতঙ্গ। এই শরতে ওরা আমেরিকার দক্ষিণ থেকে উড়াল দেয় মেক্সিকো এবং ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে। এবং এরাই একমাত্র পতঙ্গ যারা আড়াই হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়!

প্রকৃতিতে মেরুজ্যোতি এক অপার বিষ্ময়। আকাশে এক ধরনের প্রাকৃতিক আলো প্রদর্শনীই হচ্ছে এই মেরুজ্যোতি। এই বিষ্ময়ের সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে শরৎকালে। কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, গ্রিনল্যান্ডের মতো দেশে দেখা এই মেরুজ্যোতি দেখা যায়।

দুনিয়ার কিছু কিছু দেশে এত সুন্দর শরতের দেখা মেলে না। বিশেষ করে বাহামা, বারবাডোস, বেলাইজ, ডমিনিকান রিপাবলিক, গায়ানা, পুয়ের্তো রিকোর মতো ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলোতে শরৎকাল নেই।

 

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য