আদর্শের বাতিঘর, উত্তম চরিত্রের আধার- সালমান আদীব

আদর্শের বাতিঘর, উত্তম চরিত্রের আধার- সালমান আদীব

সুবহে সাদিক। কোথাও একটুও আওয়াজ নেই। হিমেল হাওয়া বইছে। খেজুর গাছ দুলছে। দুলছে বাইতুল্লাহর অদূরে অবস্থিত একটি জীর্ণ কুটিরে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা প্রদীপের শিখাটাও। ভোরের সূর্যটাও পূর্ব দিগন্তে উঁকি দেওয়ার জন্য অধীর হয়ে আছে। চারিদিকে সাজসাজ রব। যেন সকলে মিলে কারো আগমনের অপেক্ষা করছে। আকুল হয়ে। ব্যাকুল হয়ে। কে যেন আসবেন আজ এই ধূলির ধরায়। কার যেন আগমন ঘটবে। কে সে জন…
অবশেষে সবার অপেক্ষার পালা শেষ হলো। সেই জীর্ণ কুটিরে চাঁদের মতো একশিশুর জন্ম দিলেন একমা। মা আমেনা। বাতাসের গতিতে এই সুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। আকাশ থেকে নেমে এলেন ফেরেশতারা। আনন্দ-উল্লাসে লেজ উঁচিয়ে চলল মেষের পাল। দুম্বার পাল। গলা উঁচিয়ে ছুটল উটের দল। সবার একটাই লক্ষ্য- চাঁদের টুকরোকে একনজর দেখা চাই-ই চাই।
কা’বা চত্বরে এই সংবাদ পৌঁছামাত্রই কুটিরের দিকে ছুটলেন এক বৃদ্ধ। সদ্যভূমিষ্ট নবজাতকের দাদা। আবদুল মুত্তালিব। তিনি ঘরে ঢুকে কোলে তুলে নিলেন ছোট্ট নাতিকে। চুমো খেলেন তার কপালে গালে হাতে পায়ে। মা তার ছেলের নাম রাখলেন ‘আহমাদ’ দাদা রখলেন ‘মুহাম্মাদ’- উচ্চ প্রশংসিত। মক্কার লোকেরা আবদুল মুত্তালিবের কাছে জানতে চাইল, এমন নাম কেন রাখলেন? আপনার বংশে এমন নাম তো কারও নেই! আবদুল মুত্তালিব বললেন, আমার আশা সে হবে আসমান-জমিনে প্রশংসিত।
সেসময় আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারে দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকে দুধ-পানের জন্য পল্লীগ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। যাতে গ্রামের নির্মল আবহাওয়া ও সুস্থ-সুন্দর পরিবেশে শিশুরা পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠতে পারে এবং বিশুদ্ধ আরবি ভাষা রপ্ত করতে পারে।
প্রথা অনুযায়ী এবছরও দুগ্ধপোষ্য শিশুর খোঁজে মক্কায় এলো পল্লীধাত্রীরা। তাদের মাঝে তায়েফ থেকে আগত একটি কাফেলাও ছিল। আবদুল মুত্তালিব খবর পেয়ে কাফেলার নিকট এলেন। যেভাবেই হোক তার আদরের নাতিকে একজন ভালো ধাত্রীর হাতে তুলে দিতে হবে। তিনি প্রায় সবধাত্রীর সাথেই কথা বললেন। কিন্তু এতিম বলে কেউ-ই মুহাম্মাদকে নিতে চাইল না।
তারা ভাবল- এক বিধবা মা আর বৃদ্ধ দাদার কাছ থেকে কী-ই-বা আশা করা যায়? আবদুল মুত্তালবের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু তিনি নিরাশ হলেন না। হঠাৎ তার নজর পড়ল অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা একধাত্রীর উপর। সে কেমন যেন অস্থিরচিত্তে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। হয়ত সে কোনো শিশু খুঁজে পায়নি। আবদুল মুত্তালিব তার কাছে গিয়ে বললেন, মা! তোমার নাম কী?
‘হালিমা’।
কোন গোত্রের?
বনু সা’দ।
মা! আমার একটি এতিম নাতি আছে। এতিম বলে কেউ-ই তাকে নিতে চায় না। তুমি নেবে আমার নাতিকে? নাও না! আমার মনে হয় ও তোমার কাছে অনেক ভালো থাকবে। আমার নাতি কোনো সাধারণ শিশু নয়। সে অনেক বরকতময় শিশু।
এমন স্নেহ ও বিনয় মিশ্রিত কথার জবাবে হালিমা কী বলবেন খুঁজে পেলেন না। তিনি বললেন, আমি আমার স্বামীর সাথে পরামর্শ করে আসি।
স্বামীর সাথে পরামর্শ করে দ্রুতই ফিরলেন হালিমা এবং মুহাম্মাদকে নিতে সম্মতি জানালেন। শুধু তাই নয়, মুহাম্মাদকে দত্তক নেওয়ার পর হালিমা রহমতের এক বিস্ময়কর ধারা লক্ষ করতে লাগলেন। তার শূন্য স্তন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠল। তাদের উষ্ট্রীটি পাত্রভর দুধ দিতে লাগলো। এমনকি তিনি যে গাধীর পিঠে চড়ে মক্কায় এসেছিলেন সেটাও যাত্রাপথে গতির ঝড় তুলল। তার সফরসঙ্গীরা তাকে বলতে লাগলো- হালিমা! এটাই কি তোমার সেই গাধী যেটায় চড়ে তুমি এসেছিলে?
হালিমার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় সা’দ পল্লির নির্মল পরিবেশে একে একে কেটে গেল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুটি বছর। তার বয়স এখন দুই বছরের বেশি। কিন্তু দেখতে শুনতে তিনি যেন দশ বছরের বালক। হালিমার ছেলে-মেয়েরা দিনভর মেষ চরাত। এদিকে ছোট্ট মুহাম্মাদ তাদেরকে খুঁজে বেড়াত। যখন তিনি জানতে পারলেন তার ভাইয়েরা পাহাড়ের উপত্যকায় মেষ চরায়, তখন তাদেরকে সাহায্য করার জন্য তার মন উতলা হয়ে উঠল। তিনি হালিমার কাছে গিয়ে বললেন, মা! আমিও আমার ভাইয়ের সাথে মেষ চরাতে যাবো। তাকে সাহায্য করব। হালিমা বললেন, বাবা তুমি অনেক ছোট। সূর্যের তাপ সইতে পারবে না। কিন্তু যখন হালিমার ছেলে আবদুল্লাহ এসে মুহাম্মাদকে সাথে নেয়ার বায়না ধরল, তখন বাধ্য হয়ে মুহাম্মাদকে তার সাথে পাঠালেন। বললেন, সাবধান! আমার মানিকের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
ছোট্ট মুহাম্মাদ। বয়স দুই কি তিন। অথচ পরিবারকে সাহায্য করার কী আকাক্সক্ষা-আগ্রহ! তিনি হালিমার পরিবারে এসেছিলেন মাত্র কয়েক দিনের জন্য। অথচ এই অল্প সময়ের মধ্য তিনি হয়ে উঠেছিলে হালিমার চোখের মণি। পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সেই ছোট্ট মুহাম্মাদ বড় হয়ে কিন্তু মা হালিমার কথা ভুলে যাননি। বরং হালিমা যখনই তার সাথে দেখা করতে এসেছেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিয়েছেন। পাগড়ি খুলে বসতে দিয়েছেন। পরিচয় দিয়ে বলেছেন, ‘আমার মা’।
সা’দ পল্লিকে বিদায় জানিয়ে মা আমেনার কোলে ফিরলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাকে পেয়ে মা যারপরনাই খুশি। তিনি ভাবলেন, এবার মুহাম্মাদকে নিয় মদিনায় তার বাবার কবরটা জিয়ারত করে আসি। সফরের সব প্রস্তুতি সেরে উম্মে আয়মানকে নিয়ে তিনি মদিনার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। মদিনায় বনু নাজ্জারের আত্মীয়রা তাদেরকে স্বাগত জানালো। মদিনার শিশুরা মুহাম্মাদকে একান্ত আপন করে নিল। তারা ছোট্ট মুহাম্মাদের সুন্দর আচরণ ও মধুঝরা কথায় মুগ্ধ হয়ে গেল। তারা মনে মনে বলল, কেউ তো আমাদের সাথে এতো সুন্দর আচরণ করেনি! এতো সুন্দর করে কথা বলেনি! এতো গভীরভাবে মিশেনি!
মায়ের সাথে মদিনায় এসেছিলেন শিশু মুহাম্মাদ। বপন করেছিলেন ভালোবাসার বীজ। সেই বীজ থেকে জন্ম নিয়েছিল ভালোবাসার বৃক্ষ। কালের আবর্তে সেই বৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আজও সেই বৃক্ষের ছায়ায় ঘুমিয়ে আছেন তিনি।
স্বামীর কবর জিয়ারত করে মক্কায় ফিরছিলেন মা আমেনা। কিন্তু তাকদির ছিল ভিন্ন। ‘আবওয়া’ নামক স্থানে আসার পর আমেনা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি উম্মে আয়মানকে ডেকে বললেন, ‘মুহাম্মাদ তোমার কাছে আমানত। তাকে তার দাদার কাছে পৌঁছে দেবে।’ এরপর তিনি আর কথা বললেন না। চলে গেলেন রবের আশ্রয়ে।
মায়ের মৃত্যুর পর দাদার স্নেহ-ছায়ায় কেটে গেল আরও কয়েকটি বছর। মুহাম্মাদের বয়স এখন আট। কিন্তু এই ছায়াও বেশিদিন স্থায়ী হলো না। একদিন দাদা আবদুল মুত্তালিবও প্রিয় নাতিকে রেখে চলে গেলেন। মৃত্যুর আগে ছেলে আবু তালেবকে ডেকে বললেন, বাবা! মুহাম্মাদকে দেখে রেখো। নিজের ছেলের মতো মনে করো। ওর যত্নে কোনো অবহেলা করো না।
বাবা-মায়ের পর তিনি দাদাকেও হারালেন। এবার তার ঠিকানা চাচা আবু তালেবের সংসার। আবু তালেব মুহাম্মাদকে নিজের সন্তানের মতো আপন করে নিলেন। নিজেরা যা খান মুহাম্মাদকেও তাই খেতে দেন। পরতে দেন। বুঝতে দেন না কোনো অভাব।
কিন্তু তাতে কী হবে! মুহাম্মাদ জানতেন সংসারে অভাবের কথা। বুঝতে চাচার দুঃখের কথা। তিনি ভাবেন, এই অভাবের দিনে চাচাকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য। তাই তিনি মনস্থ করলেন চাচাতো ভাইদের সাথে মেষ চরাতে যাবেন। ধরবেন সংসারের হাল। যেই ভাবা, সেই কাজ। তিনি ভাইদের সাথে মেষ চরানো শুরু করলেন। সারাদিন মেষ চরিয়ে যা আয় হতো তার পুরোটাই চাচার হাতে তুলে দিতেন।
এভাবে কেটে গেল আরও কয়েকটি বছর। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখন বারো বছরের দুরন্ত কিশোর। সংসারের ভালো-মন্দটাও এখন ভালোই বোঝেন। একদিন তিনি দেখলেন চাচা আবু তালেব বাণিজ্যের জন্য বসরায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি ভাবলেন- আমিও যাই চাচার সাথে। এতে হয়ত চাচার কিছুটা সাহায্য হবে। ব্যবসা ভালো হবে। ফলে লাভও বেশি হবে। তাই তিনি আবু তালেবকে বললেন, চাচা আমিও যাবো আপনার সাথে। আবু তালেব প্রথমে রাজি না হলেও ভাতিজার তীব্র আগ্রহ দেখে অবশেষে রাজি হলেন। সঙ্গে নিলেন তাকে। রওনা হলেন বসরার দিকে।
আমাদের নবীজি হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। উত্তম চরিত্রের অবারিত বাতিঘর। যার সম্পর্কে আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, ‘নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’।
গোলাপ যেভাবে তার কলিতেই একটি সুরভিত প্রস্ফুটিত গোলাপের জানান দেয়, আমাদের নবীজির শিশুকালটাও ছিল ঠিক গোলাপের কলির মতো। পরিবারকে সহায়তা, বড়দেরকে সম্মান, সমবয়সীদের সাথে সুন্দর আচরণের মাধ্যমে ছড়িছেন গোলাপের সুভাস। দিয়েছেন নবুওতের আভাস। হয়েছেন আমাদের জন্য উত্তম চরিত্রের আধার।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য