জানালা খুলেই অবাক হয়ে গেল মাহমুদ। কী সুন্দর চাঁদের আলো! কিন্তু চাঁদটা কোথায়?
চাঁদের খোঁজে ইতি উতি তাকাল। আর তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল। এ কী! এও কি সম্ভব! চাঁদটা ডাব হয়ে ঝুলে আছে নারকেল গাছে। ভুল দেখছে না তো!
চোখ কচলে আবার তাকাল মাহমুদ। জানালার ওপাশে একটা লম্বা নারকেল গাছ। ওই নারকেল গাছে সত্যিই একটা চাঁদ ধরে আছে। ডাবের মতো চাঁদ। কেমন ঠাণ্ডা আর গোলগাল। জানালার ওপাশেই এত রূপ, এত বিস্ময়! দরজার ওপাশে না জানি অপেক্ষা করছে! আর কি ঘরে থাকা যায়?
কিন্তু দরজা খোলার সাহস হচ্ছে না। যদি শব্দ হয়? যদি কেউ জেগে যায়? পাশের ঘরেই বড় ভাইয়া ঘুমোয়। মাহমুদের মতো তিনিও অনেক রাত করে ঘুমান। বাবা মা অবশ্য সেই কখন ঘুমিয়ে গেছেন। তাদের নিয়ে কোনো ভয় নেই। ভয় কেবল ভাইয়াকে নিয়ে। যদি টের পান তাহলে কী হবে? ভাবতে থাকে মাহমুদ।
আবারও জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। চাঁদের আলোয় কী সুন্দর রুপালি হয়ে উঠেছে চারপাশ। যেন কাঁচা রুপোর ঝিলিক দিচ্ছে নারকেল গাছে, বকুল গাছে। ঘরে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। পরে যা হবার হবে। আস্তে করে ছিটকিনিটা খুলে বেরিয়ে পড়ল মাহমুদ। আর বেরিয়েই বুঝতে পারল পুরো শহর ঘুমে কাঁপছে থর থর করে। কথাটা মনে হতেই নিজে নিজে খানিক হেসে নিল। ঘুমে বুঝি কেউ থর থর করে কাঁপে? কাঁপতে পারে। শহর কাঁপে।
হঠাৎ সামনে কাকে দেখে যেন ভয় পেয়ে গেল মাহমুদ। চমকে তাকাল। মসজিদের মিনার। মনে হচ্ছিল কেউ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর ওই যে একটু দূরে পাথরঘাটার গির্জা। লাল গির্জার কিনার বেশ আঁকাবাঁকা। মনে হচ্ছে পাথরের লাল ঢেউ এঁকেবেকে গেছে অনেক দূর।
হাঁটতে হাঁটতে এর মধ্যেই দরগাতলা পেরিয়ে এসেছে মাহমুদ। দরগাতলা থেকে বামে মোড় নিতে নিতে না নিতেই কে যেন ডাকল, ‘এই মাহমুদ, এখানে…’
মাহমুদ ইতিউতি তাকায়। কিন্তু কাউকে খুঁজে পায় না।
আবারও ডাকল, ‘আমাকে খুঁজে পাচ্ছ না? এই তো আমি তোমার ঠিক বাঁয়ে। দেখতে পাচ্ছ?’
বাঁয়ে তাকাল মাহমুদ। একটা পাহাড়। তাহলে এই পাহাড়টাই ওকে ডাকাডাকি করছিল এতক্ষণ। পাহাড়টার কাছে গিয়ে মাহমুদ বলল, ‘ডাকছিলে কেন?’
পাহাড় বলল, ‘আমার কাছে এসো। দুটো সুখদুঃখের আলাপ করি। কত কষ্ট জমে আছে জানো?’
মাহমুদ বলল, ‘তোমার আবার কষ্ট কি? ঠায় দাঁড়িয়ে থাকো। আর পুরো শহর দ্যাখো। শহরের কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে সবই তুমি জানো।’
পাহাড় বলল, ‘আমার দুঃখ যদি তুমি বুঝতে! তুমি বলতে তোমরা মানুষরা যদি বুঝতে, তাহলে আর আমাকে কেটে কেটে এই হাল করতে না। দ্যাখো আমার অবস্থা। কবে যে তুমুল বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ি ঠিক নেই। আচ্ছা মাহমুদ, তোমরা এমন কেন? আমি তো কারো ক্ষতি করিনি। বরং তোমাদের কত উপকার করছি। অথচ তোমরা আমাকে ভালো মতো থাকতে দিচ্ছ না কেন? নিজেদের ভালোটাও কি বুঝতে পারো না?’
মাহমুদের এখন এসব কথা শুনতে একেবারেই ভালো লাগছে না। যদিও একটুও ভুল কথা বলেনি পাহাড়টা। পাহাড়ের গায়ে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিল মাহমুদ। তারপর পাহাড়ের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে এলো লাল দিঘির পারে। আর দিঘির পারে এসেই মাহমুদ দেখল…
সে এক এলাহী কাণ্ড! জোনাকিরা রীতিমতো আসর বসিয়েছে। গল্প বলার আসর।
মাহমুদকে দেখেই হইহই করে ওঠল দিঘির কালো জল, ‘এসো, এসো।’
মাহমুদ জানতে চাইল, ‘তোমরা ঘুমুচ্ছ না?’
দিঘির কালো জল বলল, ‘তুমি বুঝি জানো না! আমরা তো ঘুমোই না। আমরা সবাই না ঘুমোনোর দল। এই যে জোনাকিদের আসর দেখছ, রোজ রাতে আসর বসে এখানে। জোনাকিদের সাথে আমরাও এই আসরে যোগ দেই। গল্প বলার আসর। গল্প করতে করতে কখন যে সকাল হয়ে যায় টেরই পাই না কেউ। সেই সকাল থেকে সন্ধে অবধি গল্প জমে আমাদের। কত্ত গল্প!’
মাহমুদ বলল, ‘আজ তোমাদের গল্প শুনব।’
কালো জল বলল, ‘তা হবে না। প্রতিরাতেই আমরা নিজেরা নিজেরা গল্প করি। আজ তোমার গল্প শুনব। আজ তুমি আমাদের অতিথি।’
তারপর জোনাকিদের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল কালো জল, ‘শোন হে জোনাকিরা, আজ মাহমুদ আমাদের গল্প বলবে। শুনবে তোমরা?’
কী আশ্চর্য! অমনি জোনাকিদের আসর ভেঙে গেল। ওরা হইহই করে ছুটে এল মাহমুদের কাছে, ‘গল্প হবে! গল্প হবে! মানুষের মুখ থেকে শোনা গল্প। মানুষের গল্প।’
বাতাসের ডানায় ভর করে খবরটা ছড়িয়ে গেল কালো জলের দিঘির আশপাশে।
‘কোথায় হবে গল্প?’
‘রক্তজবার ঝোপের কাছে।’
একে একে নানান জাতের পাখি চলে এল রক্তজবার ঝোপের কাছে। রক্তজবা গাছগুলো নানান পাখির কলরবে মুখর হয়ে ওঠল। জোনাকিরাও ঘিরে রেখেছে মাহমুদকে। আকাশে গোল চাঁদ। সে-ও যেন চুপচাপ। সে-ও যেন গল্প শোনার জন্য আকাশের এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে।
মাহমুদ তখন বাসায় ফেরার কথা ভাবছিল না। ভাবছিল না রাত কতটা গভীর হয়েছে। এমনকি ঘুমের কথাও ভাবছিল না। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় যে ভয় ছিল, এখন সেটা একেবারেই নেই। কেন নেই কে জানে? প্রকৃতির কাছে এলে এমনই বুঝি হয়। আর এমন গভীর রাতে, যখন পুরো দুনিয়া ঘুমিয়ে থাকে, চারদিকে নেই কোনো কোলাহল, তখন কী আর কোনো ভয় ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে? পারে না।
মাহমুদ একবার চারদিকে তাকাল। রক্তজবা ফুলেরাও যেন চুপটি হয়ে আছে ওর গল্প শোনার আশায়। পাখিদের দিকে তাকাল। কখনো পাখিদের এতটা শান্ত হয়ে থাকতে দেখেনি ও। বিশেষ করে টুনটুনিদের। ও অবাক হয়ে দেখল টুনটুনিরাই বরং সবচেয়ে শান্ত হয়ে আছে। অপেক্ষা করছে ওর গল্প শোনার জন্য।
গল্প শুরু করার আগে আকাশের দিকে তাকাল মাহমুদ। চাঁদটা ঠিক ওর মাথার উপর। স্থির। যেন জায়গা ছেড়ে একটু সরলেই মাহমুদের গল্প শুনতে পাবে না ঠিক মতো।
মাহমুদ পকেট থেকে গল্পের খাতা বের করল। ওর গল্প তো এদের নিয়েই। এরাই হচ্ছে ওর গল্পের চরিত্র। এই ফুল, পাখি, জোনাকি, চাঁদ, দিঘির কালো জল-সবার কাছে ওর গল্প নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। মাহমুদ ওর গল্প শুরু করল। আর সবাই অবাক হয়ে ওর গল্প শুনতে লাগল। কী গল্প?
নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মত চাঁদ উঠেছে ঠাণ্ডা ও গোলগাল।
ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে গেলাম ঘর
ঝিমধরা এই মস্ত শহর কাঁপছিলো থরথর।
মিনারটাকে দেখছি যেন দাঁড়িয়ে আছেন কেউ,
পাথরঘাটার গির্জেটা কি লাল পাথরের ঢেউ?
দরগাতলা পার হয়ে যেই মোড় ফিরেছি বাঁয়
কোত্থেকে এক উটকো পাহাড় ডাক দিলো আয় আয়।
পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লালদিঘির ঐ পাড়
এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার
আমায় দেখে কলকলিয়ে দিঘির কালো জল
বললো, এসো, আমরা সবাই না-ঘুমানোর দল
পকেট থেকে খোলো তোমার পদ্য লেখার ভাঁজ
রক্তজবার ঝোপের কাছে কাব্য হবে আজ।
দিঘির কথায় উঠল হেসে ফুল পাখিরা সব
কাব্য হবে, কাব্য হবে- জুড়লো কলরব।
কী আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই
পাখির কাছে, ফুলের কাছে মনের কথা কই।