আল মাহমুদের জীবনী আও তো নাতি, তোমারে হারগিলার কিচ্ছা শোনাই- ভুঁইয়া মুহাম্মদ

আল মাহমুদের জীবনী আও তো নাতি, তোমারে হারগিলার কিচ্ছা শোনাই- ভুঁইয়া মুহাম্মদ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল মোল্লাবাড়ি। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই। বর্ষাকাল। তুমুল বৃষ্টিমুখর এই দিনে জন্ম নিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এক কবি। কী নাম কবির?
কবির জন্মগ্রামটা তিতাস নদীর তীরে। এই নদীর কাদাপানিতে বেড়ে উঠেছেন কবি। এই নদীর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কবির শৈশবের দুরন্ত সময়গুলো। কাজেই কেউ যদি তিতাস নদীর কাছে গিয়ে কবির নাম জানতে চায়, তবে তিতাসের ঢেউগুলোও কবির নামটা বলে দেবে। কবির নাম মীর আবদুশ শুকুর। কী! নামটা মোটেই পরিচিত ঠেকছে না, তাই তো?
যদি বলি কবির নাম আল মাহমুদ, তাহলে বাঙালি পাঠক মাত্রই চিনে ফেলবেন।
কবি কিন্তু শৈশব থেকেই চমৎকার এক রুচিশীল পরিবারে বড় হয়েছেন। তাঁর আব্বার নাম মীর আবদুর রব। আর মায়ের নাম রওশন আরা মীর। তাঁর আব্বা আর আম্মা পরস্পর চাচাতো ভাই-বোন। তাঁর নানা আবদুর রাজ্জাক মীর ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ব্যবসায়ী। কাপড় ও জুতোর ব্যবসা করতেন। অঢেল সম্পত্তির মালিক। প্রচুর জমি, দালান-কোঠা, গরু-বাছুর ছিল তাঁর। শহরের আনন্দবাজার, জগৎবাজার এলাকায় অনেকগুলো দোকানের মালিক ছিলেন তিনি।
অন্যদিকে তাঁর দাদা আবার কবি ছিলেন। দাদার নাম আবদুল ওহাব। জারিগান লিখতেন। আরবি-ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। সংস্কৃতও জানতেন। লাঠিখেলা ও তরবারি চালনায় ওস্তাদ ছিলেন। পশু-পাখি পোষার ভীষণ শখ ছিল। লড়াইয়ের জন্য অনেকগুলো মোরগ-মুরগি পুষতেন। তাঁর জানা সবকটি ভাষার অসংখ্য বই ছিল ঘরে। তবে নানার তুলনায় দাদা ছিলেন নিতান্তই দরিদ্র। সামান্য জমিজমা থেকে কোনো রকমে সংসার চালানোর খরচ তুলতেন। যদিও বাড়ির সামনের এক স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রধান কেরানির চাকরিও করতেন। পবিত্র কুরআর তেলাওয়াত করতেন অত্যন্ত সুমধুর কণ্ঠে। বাড়ির প্রাচীন মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন মাঝে মাঝে আজান দিতেন, তখন তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠ শুনে পথচলতি মানুষও আজান শুনতে দাঁড়িয়ে যেতেন।
আল মাহমুদ শৈশবে সবচেয়ে বেশি কাছে পেয়েছেন তাঁর দাদিকে। দাদির নাম হাসিনা বানু। আল মাহমুদ নিজেই জানিয়েছেন, ‘আমার শৈশব তাঁর উষ্ণ স্নেহের ক্রোড়ে অতিবাহিত হয়েছে। আমার অতি শৈশবের স্মৃতি বলে যদি কিছু থাকে তা হলো আমার দাদির সেই পবিত্র মুখায়ব। পান খাওয়া লাল দুটি ঠোঁট ও তাঁর মুখ নিঃসৃত অদ্ভুত সব রূপকথা। সিলেটে মুসলিম বীরদের আগমনকালের রোমাঞ্চকর কাহিনির ভাণ্ডারও যেন তাঁর কাছে গচ্ছিত ছিল।’
আসলে এই দাদির কাছে গল্প শুনে শুনে নিজের একটা কল্পনার বিশাল জগৎ তৈরি করেছিলেন আল মাহমুদ। দাদির ব্যক্তিত্বও তাঁকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছে। তাঁর দাদা যখনই কোনো সমস্যায় পড়তেন, তখনই দাদির কাছে পরামর্শ চাইতে আসতেন। হয়ত দাদি তখন নাতিকে গল্প শোনাচ্ছিলেন। কিন্তু দাদাকে আগে পরামর্শ দিয়ে তারপর নাতির দিকে ফিরে বলতেন, ‘আও তো নাতি, তোমারে হারগিলার কিচ্ছা শোনাই।’
দাদির কাছে গল্প শুনতে শুনতেই বইয়ের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয় তাঁর। সেসসময় একটি পাঠাগারের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র তৈরি হয়। লালমোহন পাঠাগার। কৈশোরে এই পাঠাগার ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী।
এর মধ্যেই কবিতা লিখতে শুরু করেন আল মাহমুদ। আঞ্চলিকভাবে কিছুটা কবিখ্যাতিও জুটে যায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় কোনো এক লিফলেটে কবিতা লেখেন। ব্যস, এই অপরাধে স্কুল পড়ুয়া আল মাহমুদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়ে যায়। গ্রেফতার এড়াতে দীর্ঘ সময় পালিয়ে বেড়ান তিনি। তারপর ১৯৫৪ সালের এক শীতের সকালে কবিতা লেখার ঝোঁকে চলে আসেন সাহিত্য ও কবিতার নগরী ঢাকায়।
শীতের ওই সকালে যখন আল মাহমুদ ট্রেন থেকে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে নামেন, তখন তাঁর সম্বল বলতে ছিল প্রাচীন কালের একটি টিনের সুটকেস। টিনের ওই সুটকেসের গায়ে আবার গোলাপ ফুল আঁকা। বয়স মাত্র আঠোরো বছর। পরণে খদ্দরের জামা ও পাজামা। পায়ে রাবারের স্যান্ডেল। আর বগলের নিচে টিনের সুটকেস। আর এই নিয়েই কবিতার শহরে নিজেকে হাজির করলেন আল মাহমুদ।
ঢাকায় এসে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন। দাদাভাই তাঁকে দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার প্রুফ রিডারের চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। এরপর নিজের চেষ্টায় তিনি ‘সাপ্তাহিক কাফেলা’ পত্রিকায় সহসম্পাদক হন। এরপর যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়।
এর মধ্যেই ঢাকা ও কলকাতার পত্র পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি পরিচিত হতে থাকেন। আর লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার ইচ্ছে তৈরি হয়।
কলকাতার তখনকার বিখ্যাত পত্রিকা ‘কবিতা’। এই ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিখ্যাত এক কবি বুদ্ধদেব বসু। আল মাহমুদ ‘কবিতা’ পত্রিকার জন্য তিনটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন। কবিতা তিনটি পেয়ে বুদ্ধদেব বসু জবাব দিয়েছিলেন, ‘প্রীতিভাজনেষু, তোমার একটি বা দুটি কবিতা ছাপা যাবে বলে মনে হচ্ছে।’
এক বাক্যে পাওয়া চিঠিটি আল মাহমুদকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি তো তখন নবীন কবি। বয়স মাত্র ১৯ বছর। ‘কবিতা’ পত্রিকায় একটি কবিতা ছাপা হলেই তো তিনি খুশি। কিন্তু পরের চৈত্র সংখ্যায় তাঁকে অবাক করে দিয়ে তাঁর তিনটি কবিতাই ছাপা হলো। ওই একই সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, ওমর আলী, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ পঞ্চাশের দশকের শক্তিমান কবিতের কবিতা। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। তিনিই বরং বাঙালি পাঠকদের অবাক করে দিয়ে একের পর এক কবিতা লিখতে থাকেন। সাহিত্য সমালোচকরাও তাঁকে জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশের চেয়ে ভিন্নধারার কবিপ্রতিভা হিসেবে উল্লেখ করেন।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’। এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ নিয়েও রয়েছে মজার ঘটনা।
এদেশের প্রকাশকরা সেই সময় থেকেই তরুণ কবিদের কবিতার বই প্রকাশ করতে চাইতেন না। তখন কয়েকজন তরুণ কবি ও সাংবাদিক নিজেরাই চাঁদা দিয়ে ‘কপোতাক্ষ’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলেন। সেই প্রকাশনা সংস্থার প্রথম বইটিই ছিল আল মাহমুদের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’।
১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কালের কলস’। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। এই সোনালী কাবিন তাঁকে তুলে দিয়েছিল খ্যাতির তুঙ্গে।
শুধু কবিতাই নয়, আল মাহমুদ বেশ কিছু গল্প উপন্যাসও লিখেছেন। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’। পায় বিপুল পাঠকপ্রিয়তা। হয় তুমুল প্রসংশিত।
ছোটদের জন্য লিখেছেন বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’। অসম্ভব মায়াবী এই কাব্যগ্রন্থটি। এর সুর, ছন্দ এবং শব্দবিন্যাস সবাইকে মুগ্ধ করে। বার বার পড়ার তাগিদ তৈরি করে। নতুন লিখিয়েদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য একটি গ্রন্থ।
শৈশবে দাদির কাছে শোনা গল্প আর কিচ্ছা তাঁকে যে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, তাঁর মধ্যে কল্পনার বিশাল ভাণ্ডার তৈরি করেছে, সেটাই লেখক হওয়ার কাজে লাগিয়েছেন তিনি। দেশে-বিদেশে তাঁর লেখার অনেক ভক্ত তৈরি হয়েছে। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেও, আজীবন তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিতে। বেঁচে থাকবেন তাঁর সাহসী উচ্চারণে। আল মাহমুদ অকপটে স্বীকার করেছেন মহান আল্লাহ তাআলার অকৃত্রিম সৃষ্টিকে। তাঁর সৌন্দর্যকে। মানুষের জন্য পাঠানো আল্লাহর কিতাব কুরআন সম্পর্কে আল মাহমুদ বলেছেন, ‘পবিত্র কুরআন মানব জাতির জন্য আচ্ছাদন স্বরূপ। শুধু এই মহাগ্রন্থই পৃথিবী নামক এ গ্রহটিকে পরম শান্তিতে বসবাসের যোগ্য করে তুলতে পারে।’

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য