প্রকৃতির গাঁয়ে বর্ষার আগমণ।পুবদিগন্তে মেঘের গুডুম গুডুম আওয়াজ। সারাদিন আকাশ ঝেপে রিমঝিম বৃষ্টির আনাগোনা। বর্ষাদিনের সন্ধ্যাগুলো আশ্চর্য নীরবতায় ঢাকা পড়ে যায়।নীড়হারা পাখিদের জবুথবু কাঁপুনি, আম কাঁঠালের মিষ্টি ঘ্রাণে মধুর পরিবেশ বিরাজ করে। বাতাসের ডানায় মধুর ঘ্রাণ ভাসে।
সন্ধ্যায় সবার ঘরে হারিকেনের টিমটিমে আলো,বাহিরে প্রবল ঝড়বাতাস। এ সবই স্মৃতির আঙিনায় ক্ষণে ক্ষণে ভেসে ওঠে বৃষ্টিমাখা বর্ষার ছবি।শৈশবের চঞ্চলমুখর স্মৃতির সাথে এসব গল্প মিলে মিশে লেপ্টে আছে —থাকবে চিরকাল।
আজ সারাদিন মুষলধারে বৃষ্টি ঝরেছে।
টিনের চালে রিমঝিম বৃষ্টির সেতার শুনি না সেই কবে থাকে।মন্ত্রমুগ্ধের মতো কান পেতে ছিলাম ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে।
শেষ বিকেলে বৃষ্টি থামলো।গাছ গাছালির পাতায় তখনো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো শিশিরের মতো ঝরছে। মেঠোপথে জমে আছে থিকথিকে কাঁদা। পথে পথে বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ। এমন বৃষ্টিভেজা স্যাঁতস্যাঁতে সন্ধ্যায় নানাবাড়ি পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম।থেকে থেকে মুয়াজ্জিনের আযান গ্রামজুড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে।
আশপাশের পুকুরগুলো পানিতে টইটুম্বুর।ব্যঙের দল ঘ্যানর ঘ্যানর করছে।নানাবাড়ি পৌঁছতেই মুয়াজ্জিনের কন্ঠ ভেসে আসলো।সেই আগের মতো একতালের আযান।একটা মিহি আবেশ যেন সুরের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে আছে। আযানের তালে তালে আশ্চর্য পবিত্রতায় হৃদয় মিনার ভরে ভরে উঠছে। ওনিই আমাদের শৈশবের মুয়াজ্জিন। আজ কত বছর পার হলো,—তবু তাঁর সুরের পরিবর্তন ঘটেনি।শৈশবের প্রায় দিনগুলো কেটেছে নানারবাড়ি। আগে চাইলেই এমন সন্ধ্যা যাপন করতে পারতাম—এখন ইচ্ছে থাকলেও পারি না! বড় দূর্লভ হয়ে গেছে সে দিনগুলো।
আমাদের শৈশবে বর্ষাদিনে রাতের আঁধার একটু তাড়া করেই ফিরত। ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস মনকে বারবার ছুঁয়ে দিত।আমি কোমল হাতদু’টো পুবের জানালার গ্রিল গলে বের করে দিতাম। ছুঁতে চাইতাম বৃষ্টির লক্ষ লক্ষ ফোঁটা।বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টির ছাট চোখেমুখে লেপ্টে যেত। বৃষ্টিভেজা সেই রাতটাকে মনে হতো, আপনের চেয়েও আপন।মন চাইতো মায়া-মধুর ‘বৃষ্টিবিলাস’ রাতের সাথে আলাপ করে কাটিয়ে দেই হাজার হাজার বছর।
আজ আকাশে ফকফকে জোসনা। বৃষ্টির রেশ প্রকৃতির কোলে এখনো লেপ্টে আছে।পুকুরে স্ফটিক জলে জোসনা প্রতিফলিত হচ্ছে—ধীরে ধীরে।ঢেউয়ের তালে তালে পুকুরজল কলকল শব্দে মুখর হয়ে উঠছে।জোনাকিরা এখানে ওখানে এলোপাতাড়ি উড়ে বেড়াচ্ছে।পুকুরের ঘাটলার মাথায় বিশাল বাঁশঝাড়।
সেখানে পাশাপাশি কবরে শুয়ে আছেন নানানানি। জীবনযাত্রায় দুজনে যেমন আপন ছিলেন, মৃত্যুর পরও তারা অতিআপন হয়ে আছেন। বড় ইচ্ছে জাগলো, এই বর্ষারাতের নীরব সময়ে
তাঁদের ডেকে বলি, আমরা এসেছি তোমাদের কাছে। কতকাল তোমাদের দেখি না,কতদিন তোমাদের ডাক শুনি না!
এবার উঠো! তোমাদের ডাক শোনার অপেক্ষায় আছে সবাই!
আমি নিশ্চুপ, নীরব এই পরিবেশে কোথাও কেউ নেই,ভেতরের মন বলে ওঠে, থাক! তোমার নানানানি ঘুমুক—ঘুম যে তাদের বড় তৃষ্ণা পেয়ে আছে,
বাঁশঝাড়ের চিরল পাতায় হু—হু করে শীতল বাতাসে আমি থেমে যাই। তাকিয়ে দেখি—পাতার ফাঁক গলে কবরের উপর চুয়ে চুয়ে পড়ছে মুঠি মুঠি জোসনা।বর্ষার আকাশের মেঘপালরা ছুটে যাচ্ছে সসুদ্দূরে—অজানার পানে।
বাতাসের ডানায় চুপিসারে কন্ঠ ভেসে আসে। হঠাৎ আওয়াজ করে বলে ওঠে— শোন, হে’ জীবন পথের মুসাফির!
পৃথিবীর বুকে অনেক সৌন্দর্যের সমাহার ঘটবে থাকবে, জীবনের মায়া ও ছায়ার মোহে পড়ে ভুলে যেয়ো না—অন্তত অসীম আখেরাতের কথা।তোমাকে আসতে হবে এই জগতের বুকে, তোমার প্রস্তুতি যেন সুন্দর হয়। দুনিয়ার ভালবাসা যেন তোমাকে আখেরাত বিমুখী না করে।
সতর্ক থেকো হে’ জীবনের মুসাফির!!