পশ্চিমের নিস্তেজ সূর্যকিরণ ঠিকরে পড়েছে সবুজের উপর। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক। আকাশে একদল মেঘ বাতাসের সঙ্গে খেলা করছে। এমনই একটা উপভোগীয় বিকেলে জোবাইর সাহেব আনমনা হয়ে বসে আছেন। প্রকৃতির এই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য তাঁর ভালো লাগছে না। তিনি মজে আছেন বাইতুল্লাহর প্রেমে। রব্বে কাবা তাঁকে তার মেহমান হিসেবে কবুল করেছেন। স্বশরীরের পৌঁছার আগেই ভাব-তরঙ্গে জোয়ারে পৌঁছে গেছেন আল্লাহর ঘরে, রাসুলের দেশে।
দূর থেকে মায়াবী কণ্ঠে আওয়াজ আসছে ‘আব্বু আব্বু’।
ছেলের আওয়াজ জোবাইর সাহেবের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও অন্তরকুহরে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি। তিনি কল্পনায় বাইতুল্লাহর পবিত্র নূরে স্নিগ্ধ হচ্ছেন।
আওয়াজ আরো উঁচু হলো। জোবাইর সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। তাঁর একমাত্র ছেলে ফারিস এসেছে। ফারিস ক্লাস সিক্সে পড়ে। পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী ও তুখোড় মেধাবী। প্রতি ক্লাসে সে ফার্স্ট বয়ের আসন অলংকৃত করে আসছে। এজন্য স্কুলের শিক্ষকরা তাকে খুব আদর-স্নেহ করে। তার আদব-আখলাকও বেশ চমৎকার। মা-বাবা ও মুরুব্বিদের আদেশ-নিষেধ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলে। এজন্য পাড়ার সকলেরই কাছে সে স্নেহের পাত্র।
-ফারিস, বসো।
-আব্বু, তুমি নাকি বাইতুল্লাহ যাচ্ছো?
-হ্যাঁ। এই মাত্র এজেন্সি থেকে নিশ্চিত হয়েছি।
– আমি যাবো তোমার সাথে।
-বাবা, তুমি তো জানো, আমি সামান্য বেতনে চাকরি করি। তোমাকে নেওয়ার মতো সামর্থ্য আমার নেই। তুমি বড় হও। বেশি বেশি দোয়া করো যেন আল্লাহ তোমাকেও তাঁর ঘরের মেহমান হিসেবে কবুল করেন। তুমি হতাশ হয়ো না। তোমার জন্য বাইতুল্লাহ থেকে কী আনবো, বলো!
-আমার জন্য বাইতুল্লাহর কালো গিলাফ ধরে দোয়া কোরো, আমি যেন কালো গিলাফের ঝলমলে নূরে স্নিগ্ধ হতে পারি। বেশি করে জমজমের পানি আনবে। আরেকটি বিশেষ অনুরোধ, যে উত্তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়ে রাসুলে আরবী বিদায় হজ্বে এসেছেন, সে মরুভূমির একমুষ্টি বালি আনবে। হয়তো সে বালিতে রাসুলের পায়ের খোশবু পাবো।
ফজরের পর জোবাইর সাহেব কাবার উদ্দেশে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। পবিত্র ইহরামে নিজেকে আবৃত করলেন। স্ত্রী-সন্তান থেকে বিদায় নিয়ে বিমানবন্দরে ঢুকে পড়লেন। তিনি শুধু একা নন, আছে ইহরামধারী আরো বাইতুল্লাহপ্রেমী। ফারিস হেজাজের অভিযাত্রীদের দিকে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে আছে। কখন আসবে তার এই শুভক্ষণ! কখন সে হারিয়ে যাবে সাদার মাঝে! কখন স্নিগ্ধ হবে শুভ্র চাদরের স্পর্শে!
বাবা বাইতুল্লাহ যাওয়ার পর থেকে ফারিস কেমন যেন আনমনা হয়ে আছে। সবসময় নির্লিপ্তভাবে পশ্চিমের দিকে কী যেন চেয়ে থাকে। রবের কাছে সে দৈবশক্তির আশা করে, যেন সে পাখির মতো ডানা ঝাঁপটিয়ে বাইতুল্লাহয় যেতে পারে। কখনো ইচ্ছে করে সাগরের উত্তাল তরঙ্গে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে, হয়তো দৈবক্রমে সে পৌঁছে যাবে আরব সাগরের কূলে।
সাদা ধবধবে ইহরামে নিজেকে মুড়িয়ে ফারিস ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে নেমে পড়ল উত্তাল সাগরে। মনজিল তার কাবা। সাগরের উত্তাল তরঙ্গ অপত্য স্নেহে নৌকার সাথে খেলা করছে। কখনো উপরে আছাড় মারছে। কখনো নৌকার মাথা ঢেউের নিচে ডুবিয়ে রাখছে। তরঙ্গখেলায় ফারিস বেশ মজা পাচ্ছে। ডিঙ্গি নৌকাটি ডুবি ডুবি হয়েও ডুবছে না। নৌকা যত এগোচ্ছে মনজিল ততো কাছে আসছে। ডিঙ্গি নৌকা সাগরের উত্তাল তরঙ্গের ঘাত-প্রতিঘাত সইয়ে আরবসাগরের তীরে এসে ভিড়ল। হেজাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বাইতুল্লাহর এই নির্ভীক অভিযাত্রীকে বরণ করতে সমুদ্রতীরে ভিড় জমালেন। সবাই বিভিন্নভাবে তাকে অভিনন্দিত করতে লাগলেন। ফারিস গলায় মালার ভর নিয়ে উৎসুক জনতার ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলল কাবার দিকে। কাবার দরজায় পা রাখছে।
“এই ফারিস উঠো। আজান হচ্ছে। নামাজে যাও।”দেখো, আমি তোমার বাবা। হজ্ব থেকে ফিরে এসেছি। তোমার জন্য বাইতুল্লাহ থেকে কী এনেছি দেখো। এই বলে জোবাইর সাহেবে একটি ইহরামের কাপড় ফারিসের বুকের উপর রাখলেন। এখনো সে ঘুমের ঘোরে। মুগ্ধ এখনো স্বপ্নের আবেশে। তড়িঘড়ি করে ইহরামের কাপড় পরে শুরু করলো ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক….’