শিশু-কিশোরদের প্রতি নবীজির ভালোবাসা- হাসান জুনাইদ

শিশু-কিশোরদের প্রতি নবীজির ভালোবাসা- হাসান জুনাইদ

হৃদয়ের গভীর ছুঁয়ে যাওয়া এক নাম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমাদের প্রিয় নবী। আমাদের চেতনার প্রাণপুরুষ। ইতিহাসের স্বর্ণমানব। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। আলোর বারিধারায় যিনি সিক্ত করেছেন পৃথিবীর ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি। আঁধার পুরীতে এসেছেন আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে। ফলে অসংখ্য মানুষ বিমোহিত হয়েছে তার সান্নিধ্য পেয়ে। মনের খুশিতে আশ্রয় নিয়েছে ইসলামের ছায়াতলে। তার ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্ট-ক্লেশ, অক্লান্ত শ্রম আর নিরলস প্রচেষ্টায় ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর দিকে দিকে। তিনি হয়ে উঠেছেন সকল মানুষের হৃদয়ের রাজপুত্র।
আমাদের প্রিয় নবী ছিলেন অসংখ্য গুণের অধিকারী। ন্যায়নিষ্ঠতা, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ছাড়াও তাঁর ছিল দয়ার্দ্রতা আর বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করার সুন্দর গুণ।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমলমতি শিশু কিশোরদের খুব স্নেহ করতেন। ভীষণ ভালোবাসতেন তাদের। শিশু কিশোরদের দুঃখের কথা শুনে তিনিও দুঃখিত হতেন। তাদের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করতেন। খুনসুটিও করতেন শিশু কিশোরদের সঙ্গে। তাঁর সৌহার্দপূর্ণ আচরণ আর মমতামাখা পরশে মুগ্ধ হতো মক্কা-মদিনার শিশু-কিশোররা।
ছোটদের যারা আদর-স্নেহ করতো না, তাদের প্রতি তিনি রাগ হতেন।
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক শিশুকে আদর করে চুমু খেলেন এবং বললেন, নিশ্চয়ই তোমরা (তোমাদের ভালোবাসা) মা-বাবাকে ভীতু এবং কৃপণ বানিয়ে ফেলো। এক সাহাবি কথা প্রসঙ্গে বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে, অথচ আমি কখনো তাদের আদর করে একটি চুমুও দিই না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘একমাত্র হতভাগা লোকদের থেকেই দয়া-মায়া ছিনিয়ে নেয়া হয়।’ (তিরমিজি)।
শিশু-কিশোররা বড়দের স্নেহের অধিকারী। বড়রা তাদেরকে স্নেহ করলে, তারাও বড়দের সম্মান করবে। সুন্দর আচার-আচরণ, আদব কায়দা, সভ্যতা ও ভদ্রতার শিক্ষা পাবে। এজন্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাদেরকে স্নেহ করতেন। অন্যদেরকেও ছোটদের স্নেহের প্রতি উৎসাহ দিতেন। ছোটদের শারীরিক শাস্তি, মানসিক নির্যাতন সহ তাদের প্রতি সর্বপ্রকার কঠোর আচরণ করতে নিষেধ করতেন। এবং বলতেন- ‘যে ব্যক্তি ছোটদের প্রতি স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান দেখায় না, সে আমাদের কেউ নয়।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)।

নবীজি শিশুদের কোলে নিতেন। চুমু খেতেন। তাদের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতেন।
একবার কয়েক সাহাবী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দাওয়াত খেতে বের হলেন। হুসাইন তখন রাস্তায় খেলা করছেন! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবার সামনে এগিয়ে গেলেন এবং তাঁকে কোলে নেয়ার জন্য উভয় হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু হুসাইন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি আরম্ভ করলেন। তখন নবীজি হুসাইনকে (ধরার জন্য এটাসেটা বলে) হাসাচ্ছিলেন। অবশেষে তাঁকে ধরে ফেললেন। তারপর তাঁর মাথা নিচু করে হুসাইনের মুখে মুখ রেখে চুমু খেলেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ)।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোটদের সাথে রসিকতাও করতেন। তাদের মন খারাপ হলে মন ভালো করার চেষ্টা করতেন। তাদেরকে হাসি-খুশি দেখতে চাইতেন সবসময়।
হজরত আনাস রাযিআল্লাহ্ আনহু বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সঙ্গে অবাধে মিশতেন। তিনি আমার ছোট ভাইকে কৌতুক করে বলতেন ‘আবু উমায়ের কী করে নুগাইর?’ অর্থাৎ তোমার নুগাইর পাখিটার কী অবস্থা? আবু উমায়েরের খেলার পাখিটা মারা গেলে সে অনেক কষ্ট পায়। তাই তার মনোরঞ্জনের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামরতাকে সান্ত্বনা দিয়ে পাখিটির অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে তার সঙ্গে কথা বলার কারণে তার দুঃখ দূর হয়, সে আনন্দ পায়। (তিরমিজি)।
তবে শিশুদের সঙ্গে আমাদের রসিকতা করতে গিয়ে মিথ্যা বা এরকম কোনো রসিকতা করা যাবে না, যার দ্বারা বাচ্চারা ভুল শিক্ষা পায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদেরকে আনন্দ দিতেন; কাঁধে চড়িয়ে তাদের আহ্লাদ-আবদার পূরণ করতেন।
আবু কাতাদা রাযিআল্লাহ আনহু বলেন, একদিন আমরা মসজিদে বসে ছিলাম। নবীজি তাঁর কন্যা যয়নব রাযিআল্লাহ আনহার মেয়ে উমামাকে কাঁধে করে আমাদের সামনে এলেন। এরপর নামাযের ইমামতি শুরু করলেন। উমামা তখনও নবীজির কাঁধে। রুকু করার সময় তাকে নামিয়ে রাখেন। সিজদা থেকে উঠে আবার উঠিয়ে নেন। পুরো নামায তিনি এভাবেই আদায় করলেন-বুখারী।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শিশু-কিশোররা কত প্রিয় ছিল- উপর্যুক্ত হাদিসসমূহ থেকে তা সহজেই বোঝা যায়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আমাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। উত্তম অনুকরণীয় আদর্শ। তাই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশু-কিশোরদের সাথে যেমন আচরণ করতেন, যেভাবে আদর স্নেহ মায়া মমতায় বুকে জড়িয়ে নিতেন- শিশু-কিশোরদের সাথে আমাদেরও তেমনি আচরণ করা উচিত। তাদের ভুলত্রুটি স্নেহের সাথে শুধরে দিতে হবে। তাদেরকে ভীত-শঙ্কিত করা যাবে না। তাদের প্রতি কঠোর আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। নয়তো তাদের কোমল হৃদয়ে বড়দের প্রতি বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হবে। ফলে তাদের হৃদয় থেকে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি ক্রমে হারিয়ে যাবে। তাই আমরা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লামের মত শিশু-কিশোরদের সঙ্গে আচরণ করবো। এবং তাদেরকে নবীজির সিরাত বেশি বেশি পড়তে দেবো। তাহলে তারা পাবে নীতি-নৈতিকতা ও সৌন্দর্যবোধের শিক্ষা। তাদের ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল। জীবন হবে আলোকময়।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে তৌফিক দান করুন। আমীন

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment