মায়া- দিলরুবা নীলা

মায়া- দিলরুবা নীলা

ঘড়িতে সময় এগারোটা বিশ। এ সময়টাই অনিকের নাস্তা খাওয়ার সময়। দুপুর এবং সকালের খাবার একসাথে খাওয়া ঠিক নয়, তবে সময় বাঁচানোর জন্যই সে এ কাজটা করে। রাতে ঘুমানোর অভ্যাস নেই তার। রোজ ভোররাতের দিকে চোখে ঘুমের ঘোর আসে, সেটা ভাঙে সকাল দশটা এগারোটায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

ঘুম থেকে উঠে শহর থেকে দূরে হোটেল রাজ-এ নাস্তা নিয়ে বসেছে। সকাল এগারোটায় এই নাস্তাটা সে সব সময়ই ব্যাপক হারে করে। কারণ সারাদিনই তাকে এ খাবারের এনার্জির উপর নির্ভর করে চলতে হয়। হয়তো আবার সেই রাতে পেটে কিছু পড়বে।

হট কেক নামে আবিষ্কৃত নতুন পুষ্টিকর ও ক্ষুধা নিবারক ওষুধটার উপর এখন অধিকাংশ মানুষ নির্ভরশীল। তাই হোটেলগুলোর উপর তেমন চাপ নেই। শুধু ভোজনবিলাসীদেরই হোটেলগুলোতে আনাগোনা দেখা যায়। বেশির ভাগ মানুষই একটি ওষুধ খেয়েই সারাদিনের পুষ্টি এবং কর্মক্ষমতা পেয়ে যায়। তবে অনিক সেটা করে না। ওর কাছে হোটেলে এসে সুস্বাদু খাবার আর ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়ানোর মজাটাই আলাদা।

হোটেলটা খুব বড় না হলেও পরিষ্কার। অনিক বসে আছে জানালার কাছে। কিছুক্ষণ আগে ঝরে যাওয়া বৃষ্টির আবেশে এখনও আচ্ছন্ন প্রকৃতি। দু’একটা গাছের পাতায় এখনও বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। অনিক বরাবরই বৃষ্টির প্রতি দুর্বল। ৩০২২ সালের এই রোবটিক যুগে প্রকৃতি কাউকে টানে বলে অনিকের মনে হয় না। ওয়েটার কেন এত দেরি করছে নাস্তা দিতে বুঝতে পারে না অনিক। আলোস্য এড়াতে মোবাইল সেটটা হাতে নিয়ে নিউজ পোর্টালে ঢোকে এবং হঠাৎ একটি খবরের শিরোনাম দেখে চমকে ওঠে।

“গতকাল রাতে অভিনব পদ্ধতিতে গ্রীন লাইফ ব্যাংক ডাকাতি”
অনিক পুরো খবরটাতে চোখ বুলায় “গত ২৮/০৬/৩০২২ তারিখে মধ্যরাতে অভিনব পদ্ধতিতে গ্রীন লাইফ ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে। কে বা কারা ব্যাংকের সব লকার ভেঙ্গেছে। কিন্তু ব্যাংকের টাকাপয়সাসহ সকল মালামাল অক্ষত অবস্থায় আছে। অপরাধীরা কোনো আলামতও রেখে যায়নি। তারা আসলেই অপরাধী কি না প্রশাসন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। এটা হয়তো বড় কোনো পুকুর ডাকাতির পূর্বাভাস হতে পারে বলে প্রশাসন মনে করছে এবং সে ভবিষ্যত পুকুর ডাকাতির হাত থেকে ব্যাংকটিকে সুরক্ষার জন্য প্রশাসন, অপরাধীদের ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। অচিরেই তারা ধরা পড়বে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো অপরাধীই এ পর্যন্ত আইনের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি।”

পত্রিকার নিউজ পড়ে অনিক না হেসে পারলো না। এতকাল ধরে পুকুর চুরি শুনে এসেছে, পুকুর ডাকাতি জিনিসটা সে আজকে শুনলো। আজকাল রিপোটাররাও হালকা রসিকতা শিখে গেছে। গতরাতের ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগলো। কিছুদিন ধরেই সে নিজেকে অদৃশ্য করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। গতকালই বিষয়টি সাকসেসফুল হওয়ায় পরীক্ষাটা চালিয়েছিল গ্রীন লাইফ ব্যাংকের উপর।

স্যার আপনার নাস্তা-ওয়েটারের ডাকে বাস্তবে ফিরে আসে অনিক। কিন্তু ম্যাগসেন্স কোথায়? তাকে ঘুম থেকে ওঠার পর একবারও দেখতে পায়নি সে। অথচ কুকুরটা তাকে কাছছাড়া করে না কখনও। কোথায় গেল? চিন্তিত মনে নাস্তায় হাত লাগায় সে।

মুহূর্তেই প্যাঁ প্যাঁ সাইরেন বাজাতে বাজাতে হোটেলের বাইরে এসে দাঁড়ায় দুটো পুলিশের গাড়ি। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আইনের খাকি পোশাক পরা লোকগুলো। প্রতিটি গাড়ি থেকে চারজন করে মোট আটজন লোক বের হয়ে আসে। চারজনের সাথে রিভলভার বাকি চারজনের হাতে শর্টগান। তারা সরাসরি চলে আসে অনিকের দিকে।
আপনাকে গ্রীন লাইফ ব্যাংক ডাকাতির দায়ে গ্রেফতার করা হলো। কোনো রকম পালানোর চেষ্টা করবেন না।
সবচেয়ে হ্যান্ডসাম পুলিশ অফিসারটির ভারি কণ্ঠে অনিকের মোটেও ভ্রƒক্ষেপ হলো না। সে ব্যস্ত তার কফি শেষ করাতে। কারণ আগামী সময়টাতে তার মাথা ঠিকঠাক মতো কাজ করার জন্য এই কফির কাপটা বিশেষ জরুরি।

অনিক নিশ্চিত মনে কফির কাপে চুমুক দিতে থাকে। তৃপ্তির রেশ তার চোখেমুখে।
: সাবধান!
বলতে বলতে রিভলভারধারী দুজন সার্জেন্ট অনিকের কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। কোনো রকম চালাকির চেষ্টা করবে না, মোটেও না।
: আমি একদমই চালাকি করবো না। শুধু কফিটা শেষ করবো। আমার মাথা ব্যথার প্রবলেম আছে, কফিটা না খেলে মাথা ব্যথা করবে।
খুব স্বাভাবিক গলায় বলে অনিক। তার ভাব দেখে মনে হয় এ জাতীয় পুলিশী কার্যকলাপে সে অভ্যস্ত।
: বেয়াদব একটা।
বলতে বলতে শর্টগানধারী সার্জেন্ট এগিয়ে আসতে লাগলো। রোদে পোড়া তামাটে বর্ণের এই সার্জেন্টের নাম রোহান। বয়স পঁয়ত্রিশ- ছত্রিশের কাছাকাছি। নামটা বুকের নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে। অসম্ভব স্মার্ট, সুদর্শন ছেলেটি খুবই উত্তেজিত; দেখে বোঝাই যাচ্ছে।
এত রাগবেন না জনাব রোহান, রাগ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুকিপূর্ণ। যে কোনো সময় হার্ট এ্যাটাক হয়ে যেতে পারে। আমার কফি খাওয়াটা শেষ হলেই আমি আপনাদের সাথে যাবো। উত্তেজনার কোনো প্রয়োজন নেই।
ব্যাংক ডাকাতির দায়ে তোমাকে গ্রেফতার করা হলো। তুমি চুপ থাকতে চেষ্টা করো। দু হাত মাথার উপর তোলো এবং আমাদের সাথে চলো।
: আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ পাবো কী, স্যার?
: অবশ্যই পাবে। তবে এখানে নয়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী। নিজের পক্ষে উকিল নিয়োগ করতে পারবে। বুঝেছো?
সার্জেন্টের কাটাকাটা কথায় অনিক বুঝতে পারলো না এটা মানুষ না রোবট। ইদানিং মানুষ আর রোবটের মধ্যে কিছুতেই আলাদা করা যায় না।
: কিন্তু স্যার, কোনো প্রমাণ ছাড়া অহেতুক কাউকে হয়রানি করা কি ঠিক?
অনিক ইচ্ছা করেই সার্জেন্টকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করে।

: আমরা মোটেও প্রমাণ ছাড়া আসিনি।
অনুমতি পেয়ে একজন সার্জেন্ট গাড়ির দরজা খুলে দেয়। অমনি অনিককে অবাক করে দিয়ে ম্যাগসেন্স এসে হ্যান্ডসাম সার্জেন্ট রোহানের পাশে দাঁড়ায়।

অনিক নিজেকে এই মুহূর্তে অদৃশ্য করতে পারতো। কিন্তু করলো না। বরং পুলিশের জীপে গিয়ে বসলো। ম্যাগসেন্সও অজ্ঞাত কারণে তার গা ঘেঁষে বসে পড়লো। নিজেকে অদৃশ্য করার মেডিসিন আবিষ্কারের পাশাপাশি রোবটদের জন্য ‘বিবেক’ নামক এক নতুন সফটওয়্যার আবিষ্কার করেছিল। যেটা সে ভরে দিয়েছিল ম্যাগসেন্সের শরীরে। গতকাল ব্যাংকে ঢোকার সময় সে সাথে ছিল এবং পুরো ঘটনাটাই সে তার সফ্টওয়্যারে মেমোরিতে রেখে দিয়েছে এবং সেটাই থানায় গিয়ে জানিয়ে এসেছে।

ম্যাগসেন্সকে কোলে নিয়ে অনিক গাড়ির ভেতরেই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। কে জানে এত ঘুম কোত্থেকে আসে। এই মুহূর্তে তার মাথায় একটা আবিষ্কারের নেশা চেপে বসে। রোবটদের ভিতর মায়ার ব্যাপারটা ঢোকানো বিশেষ জরুরী। ম্যাগসেন্সের ভিতরে সুকঠিন মায়া থাকলে সে নিশ্চয়ই থানায় তার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করতে পারতো না। মায়া এক বিস্ময়কর জিনিস। এই সফ্টওয়্যার আবিষ্কার ভীষণ জরুরি।

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য