জীনের সাথে যুদ্ধ-শরিফ আহমাদ

জীনের সাথে যুদ্ধ-শরিফ আহমাদ

মাওলানা আল-আমিন। টগবগে পূর্ণ যুবক। বাড়ি লক্ষ্মীপুর। তিনি ঢাকার বড় একটি মাদরাসায় লেখাপড়া করেছেন। মা তার শৈশবেই মারা গেছেন। বাবার দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। তাই তিনি কামরাঙ্গীরচর মামার বাসায় বড় হয়েছেন। আরো পড়াশোনা করার ইচ্ছা তার। ছোটবেলা থেকেই গ্রাম-গঞ্জের সাথে তেমন সম্পর্ক নেই। তাই জীন-ভূতের ভয় নেই বললেই চলে। তিনি শহরে থাকতেই অনেকের মুখে জীনের গল্প শুনেছেন। কুরআন -াদীসের বাইরে পড়েছেন অনেক জীন বিষয়ক গল্প-উপন্যাস। খবর নিয়েছেন তার গ্রামেই নাকি সন্ধ্যার পর জঙ্গলবাড়ির পাশে হেঁটে গেলে অশরীরী কিছুর দেখা পাওয়া যায়। তিনি কখনো এসব বিশ্বাস করেননি। ভেবেছেন ওগুলো সব কুসংস্কার আর আষাঢ়ে গল্প।
হঠাৎ একদিন গ্রাম থেকে অনুরোধ এলো বাড়িতে আসার। স্থানীয় মসজিদের ইমাম ট্রেনিংয়ে যাবেন। তাকে বদলি হিসাবে একমাস থাকতে হবে। তিনি মামার অনুমতি নিয়ে গ্রামে এলেন। মসজিদে নামাজ এবং মাদরাসায় ক্লাস করেন। রাতের বেলা মসজিদে ইমামের কামরায় থাকেন।

মসজিদ থেকে মাদরাসার দূরত্ব খুব বেশি নয়। সেদিন মাদরাসার বাৎসরিক মাহফিল কেন্দ্রিক মিটিং ছিলো। মিটিং শেষে মাওলানা সাহেব রায়পুর বাজারে গিয়েছেন। মসজিদে ফেরার পথে রাত হয়ে যায়। সফর সঙ্গী মাওলানা হেলাল সাহেবের জরুরি কল আসে লক্ষ্মীপুর থেকে। এখনই যেতে হবে। বাধ্য হয়ে তিনি তাকে হোন্ডা থেকে নামিয়ে দেন। হুজুর চলে গেলে তিনি মসজিদের পথে হাঁটতে লাগলেন। অন্ধকার নেমেছে। খুব দ্রুতই রাতের অন্ধকারে চারপাশ ঢেকে যাবে।
মোবাইলের হালকা আলো ছাড়া মাওলানার সাথে কোনো লাইট নেই। হনহন করে হাঁটছেন তিনি। পথে মানুষজন নেই। প্রায় ৪-৫ মিনিট হাঁটার পর তার পাশের একটা ঝোঁপে ধপ্ করে কি যেন পড়লো। চারপাশে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। আওয়াজটা শুনেই তিনি থেমে গেলেন। একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন ২০ সেকেন্ড। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলেন কিসের আওয়াজ হলো। কিন্তু আর কোনো শব্দ হলো না।
আলেম মানুষ। ভয়-ডর খুব কম। তিনি আস্তে আস্তে পা টিপে ঝোপের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে উকি দিলেন। অমনি চমকে উঠলেন। পাশেই একটা সাদা কাপড় মোড়া কী যেন রয়েছে। ওটা কিছু একটার উপর ঝুঁলে আছে। গন্ধ বেরুচ্ছে। ভস ভস করে। এতোক্ষণ নাকে রুমাল বাঁধা থাকায় বুঝতে পারেননি। সঙ্গে দুটো কুকুরও। অন্ধকার গাঢ় হতে যাচ্ছে। দৃষ্টি পরিষ্কার হচ্ছে না।
এরপর মাওলানা সাহেব আর না এগিয়ে জোরে কয়েকবার লা ইলাহা ইলাল্লাহ এবং আল্লাহু আকবর পড়লেন। চোখের সামনে দৃশ্যেটা ভাসছিল। শরীরটা কেঁপে উঠলো।

সেদিন রাতে ভালো ঘুম হলো না মাওলানার। ভয়ংকর স্বপ্ন দেখার মধ্যে কেটে গেলো। পরের দিন সকালে সূরা ইয়াসিন পাঠ করে কিছুটা স্বস্তি পেলেন। বাদ জোহর দুজন পানি পড়া নিতে এলেন। লক্ষ্মীপুরের মানুষ এখনো ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাসী। উপকারও পায়। সব মূলত আল্লাহর কালামের কারিশমা। আল-আমীন যখন ছোট্ট বাচ্চাকে ফুঁক দিচ্ছেন তখনই শরীর ভারি হয়ে আসছিল। মাথা ঝিমঝিম করছিল। কারেন্ট শখ খাওয়ার মতো। কাউকে কিছু বুঝতে দেননি। দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে কিছুটা হালকা লাগছিল। বাদ এশা তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন পড়তে পড়তে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। রাত দশটার দিকে এক চাচাতো ভাই এসে তাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে বললেন, বাড়িতে এক মহিলাকে জীন ধরেছে। শক্তিশালী জীন। তাকে বাড়িতে যেতে অনুরোধ করলেন।
অভিজ্ঞতা না থাকায় মাওলানা সাহেব বুঝতে পারেননি। সূরা ইয়াসিন পড়া শুরু করতেই মহিলা ক্ষেপে ওঠে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তাকে ধমক দেয়। মাওলানা খুব ভয় পান। তবুও সাহস করে অন্যান্য সুরা পড়েন। কিছুই হয় না। উল্টো মহিলা তাকে হুমকি ধমকি দেয়। তিনি নিরুপায় হয়ে আশপাশের অনেক হুজুরকে কল করেন। কেউ আসেনা না। বিপদে পড়লেই লোক চেনা সহজ হয়।
ঐ মহিলার বাচ্চাটিকে পাহারা দেবার জন্য বাড়ির সবাই হুজুরকে বাড়িতে থাকার জন্য অনুরোধ করে। রাতে হুজুর অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। কিন্তু তার ক্ষতি করে ঐ জীন। পরের দিন থেকে হুজুরের কী যে হলো কোনো কিছুতে স্বস্তি পান না। শরীর ভারী হয়ে থাকে। মাথায় যেন কেউ পাহাড় চাপিয়ে দিয়েছে। আর বড্ডো ভয় ধরেছে। টিকটিকি দেখলেই এখন তিনি ভয় পাচ্ছেন। মোবাইলে কল এলেও চমকে উঠছেন। কারো জোরে কথার আওয়াজ শুনলেও বুক কেঁপে উঠছে। এক কথায় জীন আছর করলে যা যা হয় সব তার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।
মাওলানা আল-আমীন নিজের অবস্থা মাদরাসার প্রিন্সিপাল হাফেজ মিজান সাহেবকে জানান। তিনি সব শুনে কিছু সুরা পড়ে পানি এবং তেলে ফুঁ দিয়ে ব্যবহার করতে বললেন। তিনি তাই করলেন। তেল গায়ে থাকলে ভালো লাগে আবার অযু-গোসলের সময় তেল ধুয়ে গেলে আগের অবস্থা হয়। তাই বাধ্য হয়ে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। চেহারার বিবর্ণ সূরত দেখে বাড়ির সবাই অবাক। মমতাময়ী মামী চাপ দিলেন সব শোনার জন্য। তিনি সবকিছু ভেঙে বললেন। মামী তাকে কামরাঙ্গীরচরের এক কবিরাজের বাড়িতে নিলেন। পরীক্ষা করে কবিরাজ বললেন তার পিছনে সাতটি জীন লেগেছে। তারা সুযোগ পেলেই যে কোনো বড় ধরনের হামলা করতে পারে। ইত্যাদি আরো অনেক কথা বলে তেলপড়া দিলেন। ঝাড়ফুঁক করলেন। বিনিময়ে এক হাজার টাকা নিলেন। পরে আবার যোগাযোগ করতে বললেন।
কবিরাজের দেওয়া তেল ব্যবহার করেও তেমন কোনো ফল হচ্ছে না। শুধু দিনে ভালো থাকেন। রাতে আবার আক্রমণ চালায় জীন। কখনো ইট-পাথর কখনো মাটির ঢেলা নিক্ষেপ করে।

নিরুপায় হয়ে মাওলানা অন্য উপায় বের করেন। চকবাজার এবং বাংলাবাজারের ইসলামী টাওয়ারে গিয়ে বই খোঁজা শুরু করলেন। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর রচিত আমালে কুরআনী, শাইখ সাঈদ ইবনে আলী কাহতানী রচিত এলাজে কুরআনী, মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ এছহাক রহ: এর তাবিজের কিতাব, আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ এর আমালিয়্যাতে কাশ্মীরী, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহ:-এর লেখা জীন জাতির বিস্ময়কর ইতিহাসসহ নেয়ামুল কুরআন কিনলেন। বইগুলো পড়ে উল্লেখিত আমল করা শুরু করলেন। যেদিন আমল করেন সেদিন ভালো থাকেন। আমল না করলে আবার আগের সমস্যা হয়। এভাবেই দিনের পর দিন জীনের সঙ্গে য্দ্ধু করে যাচ্ছেন এই তরুণ আলেম। কোনোদিন পরিপূর্ণ সুস্থ হবেন কিনা আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment